আবার আইডি হ্যাক, একদিনেই ইস্যু ৩৪১ জন্মনিবন্ধন সনদ

সাত দফায় হ্যাকিং, জড়িত প্রশিক্ষিত চক্র রোহিঙ্গাসহ ভয়ংকর অপরাধীদের ব্যবহার করার শঙ্কা দক্ষিণ কাট্টলী ওয়ার্ডে সনদ ইস্যু সাময়িক বন্ধ

আজাদী প্রতিবেদন | সোমবার , ২৩ জানুয়ারি, ২০২৩ at ৪:০০ পূর্বাহ্ণ

চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের (চসিক) আইডি হ্যাক করে জন্মনিবন্ধন সনদ ইস্যু বন্ধ হচ্ছে না। হ্যাকাররা চসিকের পৃথক পাঁচটি ওয়ার্ডের আইডি ব্যবহার করে গত ১৫ দিনে ৫৪৭টি জন্মনিবন্ধন সনদ ইস্যু করেছে। সাত দফায় এ হ্যাকিংয়ের ঘটনা ঘটে। সর্বশেষ গতকাল ১১ নং দক্ষিণ কাট্টলী ওয়ার্ডের আইডি ব্যবহার করে ইস্যু করা হয় ৩৪১টি জন্মনিবন্ধন সনদ। একই ওয়ার্ডে এর আগেও একই কায়দায় ৬৮টি জন্মনিবন্ধন সনদ ইস্যু করা হয়েছিল।

জানা গেছে, হ্যাক করে জন্মনিবন্ধন সনদগুলো যাদের নামে ইস্যু করা হয় তার ঠিকানা দেখানো হয় জামালপুর, শরীয়তপুর, উখিয়া ও কক্সবাজারসহ দেশের বিভিন্ন জেলায়। হ্যাকের বিষয়টি রেজিস্ট্রার জেনারেল কার্যালয়কে অবহিত করেছে চসিক। থানায় জিডি করাসহ হ্যাকিংয়ের মাধ্যমে ইস্যুকৃত সনদগুলো বাতিলের উদ্যোগ নেয়া হয়। এছাড়া দক্ষিণ কাট্টলী ওয়ার্ডে জন্মনিবন্ধন সনদ ইস্যু সাময়িক বন্ধ ঘোষণা করা হয়।

এদিকে একের পর একে হ্যাকিংয়ের ঘটনায় চিন্তায় পড়েছেন স্থানীয় কাউন্সিলর থেকে শুরু করে জন্মনিবন্ধন সহকারীরা। তাদের ধারণা, সংঘবদ্ধ প্রশিক্ষিত কোনো চক্র এ হ্যাকিংয়ে জড়িত। হ্যাক করে ইস্যুকৃত জন্মনিবন্ধন সনদগুলো রোহিঙ্গারা ব্যবহার করছেন বলেও শঙ্কা প্রকাশ করছেন। এক্ষেত্রে বলা হচ্ছে, বাংলাদেশি নাগরিক বৈধভাবেই জন্মনিবন্ধন সনদ পেতে পারেন। তাদের অবৈধভাবে এ সনদ নেয়ার প্রয়োজন নেই। এরপরও আইনের চোখে ভয়ংকর কোনো অপরাধী নিজের আসল পরিচয় লুকাতে ভিন্ন নামে জন্মনিবন্ধন ইস্যুর বিষয়টি উড়িয়ে দিচ্ছেন না তারা। এদিকে হ্যাকিংয়ের ঘটনার বিষয়ে অবগত নন বলে আজাদীকে জানিয়েছেন সিটি মেয়র রেজাউল করিম চৌধুরী। তবে এ ধরনের ঘটনায় উদ্বেগ প্রকাশ করে তিনি বলেন, শক্তিশালী কোনো চক্র এ কাজ করতে পারে।

চসিকের সচিব খালেদ মাহমুদ আজাদীকে বলেন, এ ধরনের ঘটনা শুধু চট্টগ্রামে হচ্ছে তা না, দেশের অনেক জায়গায় হয়েছে। এ বিষয়ে আমাদের রেজিস্ট্রার জেনারেল স্যারও প্রদক্ষেপ নিচ্ছেন। আমাদের যা যা করণীয় তা করছি। জিডি করেছি, কর্তৃপক্ষকে জানিয়েছি এবং হ্যাকিংয়ের মাধ্যমে যেগুলো ইস্যু হয়েছে সেগুলো বাতিলের ব্যবস্থা করছি।

চসিকের আইটি কর্মকর্তা মোহাম্মদ ইকবাল হাসান আজাদীকে বলেন, সার্ভারের নিয়ন্ত্রণ রয়েছে রেজিস্ট্রার জেনারেলের কার্যালয়ে। তাদের লিখিতভাবে জানানো হয়েছে।

জানা গেছে, ২০০৪ সালে জন্মনিবন্ধন আইন করা হয়। কার্যকর হয় ২০০৬ সালে। পাসপোর্ট ইস্যু, বিবাহ নিবন্ধন, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ভর্তি, ড্রাইভিং লাইসেন্স নেওয়া, জমি রেজিস্ট্রেশনসহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ কাজে জন্মনিবন্ধন সনদ বাধ্যতামূলক। শুরুতে হাতে লেখা সনদ দেওয়া হতো। এরপর ২০১০ সালের শেষ দিকে এসে তা ডিজিটাল করার উদ্যোগ নেয়া হয়। জন্মনিবন্ধনের জন্য আবেদনকারীকে তার বাবা ও মায়ের জন্মনিবন্ধন বা জাতীয় পরিচয়পত্র এবং ছবিসহ আরো কিছু নথির দরকার হয়। অনলাইনে ডাটা ইনপুট দেওয়ার পর তা প্রিন্ট করে প্রয়োজনীয় কাগজপত্রসহ মুদ্রিত কপি সংশ্লিষ্ট ওয়ার্ড কার্যালয়ে জমা দেওয়ার পর সেগুলো যাচাই করা হয়। পরে একটি ক্রমিক নম্বরসহ ওয়েবসাইট থেকে জারি করা হয় জন্মসনদ এবং তা প্রিন্ট করে সনদ আকারে আবেদনকারীকে সরবরাহ করা হয়।

১৫ দিনে ৫৪৭ সনদ ইস্যু : চলতি বছরের ৮ জানুয়ারি চসিক প্রথম হ্যাকিংয়ের বিষয়টি বুঝতে পারে। ওইদিন ৩৮ নং দক্ষিণ মধ্যম হালিশহর ওয়ার্ডে ৪০টি জন্মনিবন্ধন সনদ ইস্যু করে হ্যাকাররা। এ বিষয়ে পরদিন বন্দর থানায় সাধারণ ডায়েরি করেন জন্মনিবন্ধন সহকারী মোহাম্মদ সাইফুদ্দিন অপু। এতে তিনি বলেন, সকালে কর্মস্থলে উপস্থিত হয়ে জন্মনিবন্ধন কাজ করার জন্য কম্পিউটার চালু করে তার হিসাবে অতিরিক্ত দুই হাজার টাকা জমা হয়েছে দেখতে পান। পরে কাউন্সিলর আইডি চালু করে জন্মনিবন্ধন বই চেক করে ৪০টি নিবন্ধন রেজিস্ট্রেড দেখতে পান। কিন্তু এ ৪০টি নিবন্ধনের আবেদন ওয়ার্ড কার্যালয়ে জমা করা হয়নি। আবেদনগুলো কে বা কারা করেছে অবগত নন উল্লেখ করে বলা হয়, আমাদের জন্মনিবন্ধন ইউজার আইডি হ্যাক হয়েছে। বিষয়টি আজাদীকে নিশ্চিত করেন মোহাম্মদ সাইফুদ্দিন অপু।

দক্ষিণ মধ্যম হালিশহর ওয়ার্ডের একদিন পর ১০ জানুয়ারি হ্যাক করা হয় ১১ নং দক্ষিণ কাট্টলী ওয়ার্ডের ইউজার আইডি। এদিন হ্যাক করে ১৮টি জন্মনিবন্ধন সনদ ইস্যু করা হয়। একই ওয়ার্ডের ইউজার আইডি পরে আরো দুই দফা হ্যাক হয়েছে। এর মধ্যে ১৯ জানুয়ারি ৫০টি এবং গতকাল ৩৪১টি জন্মনিবন্ধন সনদ ইস্যু করে হ্যাকাররা। হ্যাকের বিষয়ে হালিশহর থানায় জিডি করা হয়।

বিষয়টি নিশ্চিত করে জন্মনিবন্ধন সহকারী মো. রহিম উল্ল্যাহ চৌধুরী প্রথম দিনের ঘটনা প্রসঙ্গে আজাদীকে বলেন, ১০ জানুয়ারি সকালে কর্মস্থলে উপস্থিত হয়ে জন্মনিবন্ধনের কাজ করার জন্য কম্পিউটার চালু করে ১৮টি নিবন্ধন রেজিস্ট্রার্ড অতিরিক্ত দেখতে পাই। যেগুলোর আবেদন কার্যালয়ে জমা করা হয়নি। পরে বুঝতে পারি আইডি হ্যাক হয়েছে। একইভাবে পরের দুইবার হ্যাক হওয়ার বিষয়ে বলেন, সর্বশেষ কাজ করে চলে আসার পর অটো রেজিস্ট্রেশন হয়ে যায়। সেটা দেখে বুঝতে পারি।

দক্ষিণ কাট্টলী ওয়ার্ডের কাউন্সিলর মো. ইসমাইল আজাদীকে বলেন, আপাতত জন্মনিবন্ধন সনদ ইস্যু আমরা বন্ধ রেখেছি। সমাধান না হওয়া পর্যন্ত বন্ধ রাখব।

এদিকে ১০ জানুয়ারি ১৩ নং পাহাড়তলী ওয়ার্ডের ইউজার আইডি হ্যাক করে ১০টি এবং ২১ জানুয়ারি ৪০ নং উত্তর পতেঙ্গা ওয়ার্ডের ইউজার আইডি হ্যাক করে ৮৪টি জন্মনিবন্ধন সনদ ইস্যু করা হয়।

উত্তর পতেঙ্গা ওয়ার্ডের ঘটনার বিষয়ে ওয়ার্ড কাউন্সিলর আবদুল বারেকের ব্যক্তিগত সচিব মো. সাইফুদ্দীন আজাদীকে বলেন, জন্মনিবন্ধন সহকারী ১৫টি জন্মনিবন্ধন সনদ ইস্যু করে প্রিন্ট নেন। এ সময় তিনি দেখেন অনেকগুলো জন্মনিবন্ধন সনদের অপরিশোধিত অর্থ জমা হয়ে গেছে। এতে অবাক হয়ে ম্যাসেজ চেক করতে গিয়ে দেখেন একই সময়ের মধ্যে মোট ৯৯টি জন্মনিবন্ধন সনদ ইস্যু হয়েছে। তার মানে সহকারীর ইস্যুকৃত ১৫টির বাইরে আরো ৮৪টি ইস্যু হয়েছে।

এদিকে আন্দরকিল্লা ওয়ার্ডের আইডি হ্যাক করে ইস্যু করা হয় ৪টি জন্মনিবন্ধ সনদ। এ ঘটনায় কোতোয়ালী থানায় ১৪ জানুয়ারি জিডি করেন জন্মনিবন্ধন ডাটা এন্ট্রি সহকারী সঞ্জীব আচার্য্য। এতে উল্লেখ করা হয়, ৮ জানুয়ারি হ্যাকের ঘটনা ঘটেছে।

চসিক সূত্রে জানা গেছে, চসিকের জন্মনিবন্ধন আইডি প্রথম হ্যাক করা হয়েছিল ২০২১ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি। ওইদিন দেশের জন্ম ও মৃত্যু নিবন্ধনের অফিসিয়াল সার্ভারের আপগ্রেডেশনের কাজ চলার সময় হ্যাক করে ৪০ নং উত্তর পতেঙ্গা, ৬ নং চকবাজার এবং ৪১ নং দক্ষিণ পতেঙ্গা ওয়ার্ড কার্যালয়ের নাম ব্যবহার করে ১৮টি জন্মনিবন্ধন সনদ ইস্যু করা হয়। এর মধ্যে ১২টি ছিল রোহিঙ্গার নামে। এ ঘটনায় একই বছরের ৯ জুন পতেঙ্গা ও চকবাজার থানায় পৃথক তিনটি মামলা করেছিলেন সংশ্লিষ্ট জন্মনিবন্ধন সহকারীরা। ঘটনার এক বছর নয় মাস পর ২০২২ সালের ১০ নভেম্বর যশোরের শার্শা উপজেলা থেকে আশরাফুল আলম নামে একজনকে আটক করে কাউন্টার টেরোরিজম বিভাগ।

উল্লেখ্য, গত আগস্ট মাসে শরীয়তপুরে দুটি ইউনিয়ন পরিষদের সার্ভার হ্যাক করে ইস্যু করা হয় ৮০৮টি জন্মনিবন্ধন সনদ।

পূর্ববর্তী নিবন্ধসঙ্গীত পরিষদের ৮৪তম বার্ষিকী ২৭ জানুয়ারি
পরবর্তী নিবন্ধবাঁশঝাড়ে পরিত্যক্ত ২০ কার্তুজ