রেলওয়ের প্রস্তাবিত কালুরঘাট সেতুর উচ্চতা নিয়ে আন্তঃমন্ত্রণালয়ের বৈঠকেও অনড় ছিল বিআইডব্লিউটিএ। গতকাল রোববার আন্তঃমন্ত্রণালয়ের বৈঠকে কর্ণফুলীর যে অংশে সেতু হবে সেখানে ১২ দশমিক ২ মিটারের নীচে সেতু করা যাবে না বলে আপত্তি জানায় বিআইডব্লিউটিএ। বিআইডব্লিউটিএর এমন আপত্তিতে আবারো অনিশ্চয়তায় পড়তে যাচ্ছে বহুল প্রতীক্ষিত নতুন কালুরঘাট সেতু। বিআইডব্লিউটিএর মতামত অনুযায়ী সেতু করতে গেলে সেতুর ব্যয় বেড়ে দাঁড়াবে ৪ গুণ। কর্ণফুলী নদীর উচ্চতা নিয়ে রেল মন্ত্রণালয়ের সাথে নৌপরিবহন অধিদপ্তরের মতের যে অমিল দেখা দিয়েছে সহসাই এ জটিলতা নিরসনের কোনো পথ দেখা যাচ্ছে না। এক্ষেত্রে একমাত্র প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ ও সরকারি গেজেট সংশোধনই সেতু নির্মাণে আলোর মুখ দেখতে পারে। এই ব্যাপারে রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলের সাবেক অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী (সেতু), বর্তমানে বাংলাদেশ রেলওয়ের পরিচালক (প্রকিউরমেন্ট) গোলাম মোস্তফা গতকাল আজাদীকে বলেন, আন্তঃমন্ত্রণালয়ের বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়েছে। কিন্তু বৈঠকে বিআইডব্লিউটিএ তাদের সিদ্ধান্তে অনড় ছিল। বিআইডব্লিউটিএ বলেছে সেতুর উচ্চতা ১২ মিটার হতে হবে। কিন্তু রেলওয়ের প্রস্তাবিত নকশা অনুযায়ী ৭ মিটার থেকে বাড়িয়ে সর্বোচ্চ ৯ মিটার পর্যন্ত করা যাবে। এখন বিআইডব্লিউটিএ যে উচ্চতার (১২ মিটার) কথা বলছে সেটা করতে গেলে সেতুর নির্মাণ ব্যয় থেকে শুরু করে অনেক কিছু বেড়ে যাবে। তখন সেতুর ব্যয় দাঁড়াবে ৫ থেকে ৬ হাজার কোটি টাকা। তখন বর্তমান প্রস্তুতি অনুযায়ী সেতুর কাজ শুরু করা সম্ভব নাও হতে পারে। আরো অনেক বিষয় নিয়ে বৈঠকে আলাপ-আলোচনা হয়েছে। রেলওয়ের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ ও বিআইডব্লিউটিএর ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা জানান, রেল কর্তৃপক্ষের প্রস্তাবিত নকশা অনুযায়ী কালুরঘাট সেতুর উচ্চতা ৭ দশমিক ২ মিটার রাখা হয়েছে। বর্তমান রেল লাইন অ্যালাইনমেন্টে উচ্চতা সর্বোচ্চ ৯ মিটার পর্যন্ত করা যাবে। কিন্তু নৌপথের মালিক বিআইডব্লিউটিএ শুরু থেকেই বলে আসছে কর্ণফুলীর যে অংশে সেতু হবে নেভিগেশন চ্যানেল ঠিকঠাক রাখার জন্য এবং ঝড়ের সময় নিরাপদ আশ্রয়ে যাওয়ার জন্য কর্ণফুলী নদীতে অবস্থান করা নৌবাহিনীর জাহাজসহ বাণিজ্যিক জাহাজগুলো কালুরঘাট সেতু পার হওয়ার প্রয়োজন হতে পারে। ওই দুঃসময়ে জাহাজ পারাপারে সেতুটি যাতে কোনো ধরণের প্রতিবন্ধকতার তৈরি না করে সেজন্য সেতুর উচ্চতা বাড়ানোর প্রস্তাব রাখা হয়েছে।
নৌপরিবহন অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, দেশের সব নদীকে তিনটি শ্রেণীতে ভাগ করে সরকারি গেজেট প্রকাশ করা হয়েছে। বিষয়টি তদারকি করে থাকে নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়। দেশের প্রধান নদী সমূহ যেমন- পদ্মা, মেঘনা, যমুনা, গোমতী, কর্ণফুলীসহ বেশ কয়েকটি নদী প্রথম শ্রেণীভূক্ত। তেমনি বঙ্গোপসাগর থেকে শাহ আমানত সেতু পর্যন্ত কর্ণফুলী নদীর অংশকে প্রথম শ্রেণীভুক্ত করা হয়েছে। শাহ আমানত সেতু থেকে হালদা নদীর মোহনা পর্যন্ত দ্বিতীয় শ্রেণীভুক্ত।
জানা গেছে, প্রথম শ্রেণীর নদীতে সেতু করতে হলে উচ্চতা হতে হবে ১৮ দশমিক ৩ মিটার, দ্বিতীয় শ্রেণীর নদীতে সেতু হলে উচ্চতা হতে হবে ১২ দশমিক ২ মিটার আর তৃতীয় শ্রেণীর নদীতে সেতু হলে উচ্চতা হতে হবে ৭ দশমিক ২ মিটার। বর্তমানে দ্বিতীয় শ্রেণীর কর্ণফুলী নদীতে রেলওয়ে সেতু করতে চাচ্ছে তৃতীয় শ্রেণীর হিসাবে ৭ দশমিক ২ মিটার উচ্চতায়।
রেলওয়ের ব্রিজ সংশ্লিষ্ট এক প্রকৌশলী গতকাল দৈনিক আজাদীর সাথে আলাপকালে জানান, বর্তমানে কালুরঘাট সেতুর উচ্চতা ৪ দশমিক ২ মিটার। এটিকে যদি আরো আট মিটার বা ২৫ ফুটের মতো উঁচু করা হয় তাহলে সেতু নির্মাণ করা সম্ভব হবে না। কারণ হঠাৎ করে রেললাইন উঁচু করে ফেলা যায় না। বেশ দূর থেকে ক্রমান্বয়ে উঁচু করতে হয়। আবার একইভাবে বেশ দূরে গিয়ে স্লোভ মিলাতে হয়। প্রস্তাবিত কালুরঘাট সেতুর উচ্চতা যদি ৪০ ফুট করতে হয় সেক্ষেত্রে জান আলী হাট এবং গোমদন্ডী রেলওয়ে স্টেশনকে বহু উঁচু করতে হবে। যা অনেক কঠিন এবং ব্যয়বহুল। এই অবস্থায় সেতু নির্মাণের পুরো প্রকল্পটি নতুন করে হিসাব নিকেশ থেকে ডিজাইন করাসহ অনেক কিছু পাল্টে ফেলতে হবে। যা সম্ভব হবে না।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে একাধিক কর্মকর্তা বলেছেন, বিআইডব্লিউটিএ সেতুর উচ্চতা নিয়ে অহেতুক জটিলতা করছে। নদীর ওই অংশটিতে তেমন কোনো জাহাজ চলাচল নেই। নেভিগেশন চ্যানেল রক্ষার নামে এই ধরনের জটিলতা তৈরি পুরো প্রকল্পে প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি করতে পারে।
বোয়ালখালীবাসীসহ রাঙ্গুনিয়ার একাংশ এবং দক্ষিণ চট্টগ্রামের বৃহৎ জনগোষ্ঠীর যাতায়াতের একমাত্র অবলম্বন কালুরঘাট সেতু। দীর্ঘদিন ধরে এই অঞ্চলের মানুষ কালুরঘাট নতুন সেতুর স্বপ্ন দেখছে।
বহু কাঠখড় পুড়িয়ে বোয়ালখালীসহ আশপাশের এলাকার মানুষের দুর্ভোগ লাঘবে বাংলাদেশ রেলওয়ে পূর্বাঞ্চল কর্তৃপক্ষ ২০১৭ সালের ২১ সেপ্টেম্বর কালুরঘাট কর্ণফুলী নদীর উপর রেল কাম সড়ক সেতু নামে একটি ডেভেলপমেন্ট প্রজেক্ট প্রপোজাল (ডিপিপি) তৈরি করে। প্রকল্পটি যাচাই-বাছাই শেষে একনেকে পাস হয়। পরবর্তীতে অনেক ধাপ পেরিয়ে এই সেতুর একটি চূড়ান্ত ডিজাইন দাঁড় করানো হয়। ঢাকা-চট্টগ্রাম-কঙবাজার রেল প্রজেক্ট প্রিপারেটরি ফ্যাসিলিটি প্রকল্পের অধীনে কর্ণফুলী নদীর উপর সেতু নির্মাণের প্রকল্পটি অন্তর্ভুক্ত করা হয়। এ প্রকল্পের অধীনে কালুরঘাটে অবস্থিত পুরনো রেল সেতুর স্থলের ৮০ মিটার উত্তরে নতুন ‘রেলওয়ে কাম রোড সেতু’ নির্মাণের নকশা প্রণয়ন করা হয়। এই ব্যাপারে দক্ষিণ কোরিয়ার রাষ্ট্রায়ত্ত দ্য ইকোনমিক ডেভেলপমেন্ট কো-অপারেশন ফান্ড (ইডিসিএফ) এর সাথে রেলওয়ের ঋণ চুক্তিও চূড়ান্ত হয়েছে। এখন উচ্চতা নিয়ে বিআইডব্লিউটিএর এমন আপত্তিতে আবারো প্রকল্পটির গতি থেমে গেলো।