আবদুস সাত্তার চৌধুরী : নিভৃতচারী সাংবাদিক

আ ব ম খোরশিদ আলম খান | মঙ্গলবার , ১১ নভেম্বর, ২০২৫ at ৪:৫৯ পূর্বাহ্ণ

দেখতে দেখতে ছয়টি বছর কেটে গেল। ২০১৯ সনের ২৫ সেপ্টেম্বর পরপারের বাসিন্দা হন নিভৃতচারী সাংবাদিক আলহাজ্ব আবদুস সাত্তার চৌধুরী। ৭৪ বছরের কর্মময় জীবনের প্রায় পঞ্চাশ বছরই কেটেছে তাঁর স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম সংবাদপত্র দৈনিক আজাদীতে। এই প্রবীণ সাংবাদিকের মৃত্যু হয়েছে অবেলায় নয়, অত্যন্ত পরিণত বয়সে। দৈনিক আজাদীর সম্পাদনা সহকারী বিভাগের ইনচার্জ ছিলেন টানা পাঁচ দশক। এই দীর্ঘ সময়ে দৈনিক আজাদীতে অনেকেই তাঁর সহকর্মী, সতীর্থ ছিলেন। প্রায় টানা চার যুগ দৈনিক আজাদীতে সাংবাদিকতা পেশায় কাটিয়ে দেয়া আলহাজ্ব আবদুস সাত্তার চৌধুরীর সমবয়সী আর কেউ এখন বেঁচে নেই। তবে আজাদীর সম্পাদক একুশে পদকপ্রাপ্ত যশস্বী সাংবাদিক জনাব এম এ মালেকের ব্যাপার ভিন্ন। ৮৫ বছর বয়সেও তিনি আজাদীর হাল ধরে আছেন। ৬৬ বছর ধরে টিকে থাকা আজাদী নতুন ইতিহাস সৃষ্টি করেছে। সারা দেশের পত্রিকা জগতে সবচেয়ে বয়োজ্যেষ্ঠ সম্পাদক ও প্রবীণ সাংবাদিক হলেন জনাব এম এ মালেক। একুেশ পদক প্রাপ্তিসহ নানা কারণে তিনি ইতিহাসের পাতায় ঠাঁই করে নিয়েছেন। দৈনিক আজাদীর প্রতিষ্ঠাতা এদেশে সাংবাদপত্র জগতের পথিকৃৎ মরহুম আলহাজ্ব ইঞ্জিনিয়ার আবদুল খালেক এবং প্রয়াত সম্পাদক দেশের সংবিধান প্রণেতা অধ্যাপক মোহাম্মদ খালেদ আজ বেঁচে নেই। কিন্তু রয়ে গেছে তাঁদের কীর্তি ও ইতিহাস। এখানকার মাটি ও মানুষের কথা তুলে ধরতে ইঞ্জিনিয়ার আবদুল খালেকের হাত ধরে আজাদীর জন্ম ও পথচলা। এ দীর্ঘ ৬৬ বছরে দৈনিক আজাদী শত শত লেখক তৈরি করেছে, অগণিত পাঠকের আস্থা ও ভালোবাসা অর্জন করতে পারছে এর নেপথ্যে রয়েছে আজাদীর সব বিভাগের কর্মরত সাংবাদিকসহ নানা স্তরের কর্মকর্তা কর্মচারীদের শ্রম ও অবিরাম প্রচেষ্টা। তেমনি একজন আজাদী অন্তঃপ্রাণ নিভৃতচারী সংবাদকর্মী ছিলেন আলহাজ্ব আবদুস সাত্তার চৌধুরী। তিনি বর্তমান সম্পাদক মহোদয়ের একান্ত স্নেহ ও আস্থাভাজন ছিলেন। জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত আজাদীর সঙ্গে থেকেছেন। তবে তাঁর সৌভাগ্য যে, তাঁকে আজাদীর ধরাবাঁধা নিয়মে চাকরি করতে হতো না। সকালসন্ধ্যা দুই বেলা আজাদী অফিসে এসে সম্পাদনা সহকারী বিভাগে বসতেন। কিছুসময় থেকে আবার চলে যেতেন। রাতের সেকশনে অফিসে এলেও বেশিক্ষণ থাকতেন না। সুষ্ঠু সুন্দরভাবে সম্পাদনা সহকারী বিভাগ পরিচালনার জন্য আজাদী কর্তৃপক্ষের আস্থা ও বিশ্বাস অর্জন করেছিলেন তিনি। সহকর্মীদের পরিচালনা করার ক্ষেত্রে তাঁর অভিভাবকসুলভ নেতৃত্বগুণ ছিল অসাধারণ। আজাদীর বার্তা এবং রিপোর্টিংসহ সর্বস্তরের সাংবাদিকদের সঙ্গে এমনকি কম্পিউটার বিভাগের কর্মীদের সঙ্গেও তাঁর সখ্য ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল। বয়োজ্যেষ্ঠ হিসেবে তিনি সবার শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা কুড়িয়েছেন।

আমি দৈনিক আজাদীতে সম্পাদনা সহকারী হিসেবে দ্বিতীয় দফায় সাংবাদিকতা পেশায় প্রবেশ করি ২০০৫ সনের ১০ ফেব্রুয়ারি। দৈনিক আজাদীতে সম্পাদনা সহকারী হিসেবে যখন চাকরির জন্য আবেদন করি, আমার দাখিল টু কামিল সব শ্রেণিতে প্রথম বিভাগ দেখে সাত্তার সাহেব বললেন, আপনি তো কামিল পাস বেশ ভালো হুজুর, আপনার সার্টিফিকেট দেখে মনে হয় না আপনি এখানে বেশি দিন চাকরি করবেন। আমি তো নাছোড়বান্দা। তাঁকে বললাম, আমি কোথাও যাবো না। আজাদীতে চাকরি করতে চাই। সাত্তার সাহেব সেদিন সরাসরি আমার কোনো ইন্টারভিউ নিলেন না। বাস্তবে কাজ ধরিয়ে দিয়ে আমাকে যাচাই করলেন। আমার কাজ দেখে সন্তুুষ্ট হলেন তিনি। এভাবে তাঁর হাত ধরে আজাদীতে চাকরি। দীর্ঘকাল আজাদীতেই আছি।

আমাদের মাননীয় সম্পাদক স্যারের ঘনিষ্ঠ আপনজন ছিলেন আলহাজ্ব আবদুস সাত্তার চৌধুরী। সম্পাদক স্যার তাঁকে খুবই স্নেহ করতেন। উভয়ের মধ্যে নানা বিষয়ে খোলামেলা আলাপ আলোচনা হতো। এমনকি ব্যক্তিগত ও পারিবারিক নানা বিষয়েও তাঁরা পরস্পর আলাপ করতেন। উভয়ের এই হৃদ্যতা ও ঘনিষ্ঠতা অবশ্যই দৃষ্টান্তমূলক। সাত্তার সাহেব স্ত্রী, তিন পুত্র সন্তান এবং এক কন্যা রেখে গেছেন। সন্তানদের মধ্যে সবার বড় ইয়াছমিন আক্তার চৌধুরীর জামাতা হলেন শাহসূফি মোহাম্মদ হাবিবুল্লাহ। যিনি রাউজানের এক প্রসিদ্ধ পীর সাহেবের সন্তান। অন্য সন্তানরা তথা মুহাম্মদ নওশাদ চৌধুরী, মুহাম্মদ এরশাদ চৌধুরী এবং মুহাম্মদ সাজেদ চৌধুরী সবাই নিজ নিজ ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠিত।

মানুষের জীবন অতি ঠুনকো। কেউ বাঁচেন পঞ্চাশ বছর, কেউ বাঁচেন শত বছর। আবার কেউ আরো কম। সাত্তার সাহেবের ৭৪ বছরের জীবন সাফল্য ও কীর্তিতে ভরা। দৈনিক আজাদীর সঙ্গে সম্পৃক্ত থেকে তিনি অনন্য সম্মান ও মর্যাদার অধিকারী হন। ২০১৯ সনের ২৫ সেপ্টেম্বর তিনি ইন্তেকাল করেন। আগের দিনও তিনি আজাদীতে অফিসে কর্মস্থলে এসেছিলেন। ২৪ সেপ্টেম্বর বিকেলে হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়লে তাঁকে নগরীর একটি হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। পরদিন ২৫ সেপ্টেম্বর তিনি ওই হাসপাতালেই ইন্তেকাল করেন। এভাবেই সবাইকে একদিন মৃত্যুকে আলিঙ্গন করতে হবে। জীবন ও সংসারকে তিনি গুছিয়ে এনেছিলেন। অপ্রাপ্তির দুঃখবেদনা তাঁকে স্পর্শ করেনি। মৃত্যুর বছর দেড়েক আগে তিনি নগরের সাংবাদিক হাউজিং সোসাইটি এলাকায় সুন্দর পরিপাটি একটি বাড়িও বানিয়েছিলেন। সাংবাদিক হাউজিং সোসাইটির মসজিদ কবরস্থানে তাঁকে সমাহিত করা হয়। মহান আল্লাহপাক সাত্তার সাহেবকে জান্নাতের সুউচ্চ মর্যাদা নসিব করুন।

লেখক: সিনিয়র সম্পাদনা সহকারী, দৈনিক আজাদী।

পূর্ববর্তী নিবন্ধসেকাল একাল
পরবর্তী নিবন্ধপ্রস্তাবিত ফটিকছড়ি উত্তর উপজেলা: উপেক্ষিত জনআকাঙ্ক্ষা