আফ্রিকা মহাদেশের চলচ্চিত্রের ইতিহাস অনেক পুরোনো। এর রয়েছে রীতিমতো সমৃদ্ধ ঐতিহ্য। বিশ্ব–চলচ্চিত্রে আফ্রিকান সিনেমার আসনও মর্যাদাপূর্ণ। প্রকৃত চলচ্চিত্রপ্রেমীদের কাছে এর যথেষ্ট সমাদরও রয়েছে। কিন্তুু এতকিছুর পরেও আফ্রিকার চলচ্চিত্রের প্রচার ও প্রসার দুই–ই কম। সাধারণ্যে এর কদর তেমন নেই বললেই চলে। মূলতঃ আফ্রিকা মহাদেশকে ঘিরেই এ–মহাদেশের চলচ্চিত্রের আবর্তন। এশিয়া, ইউরোপ ও উত্তর আমেরিকা এবং কখনও কখনও অস্ট্রেলিয়া ও দক্ষিণ আমেরিকার ছবি যেভাবে সারা বিশ্বে ঘুরে বেড়ায় আফ্রিকার চলচ্চিত্রের আনাগোনা সে অর্থে নেই বললে চলে। অথচ এ–মহাদেশ থেকে আবির্ভূত হয়েছেন ওমরু গান্ডা, ওসমান সেমবেনে, পলিন ভিয়েরা, সুলেইমান সিসে, মেড হন্ডো, বেন বারকা, ইউসুফ শাহীন, হেইলে গেরিমা, জিব্রিল দিয়োপ মেমবেতির মতো প্রথিতযশা চলচ্চিত্রকার। যাঁদের অবদানে কেবল আফ্রিকার বিভিন্ন দেশই নয়, সমৃদ্ধ হয়েছে পুরো সিনেমা দুনিয়া।
অথচ সাধারণভাবে এখনও অনেকটাই তাচ্ছিল্যের চোখে দেখা হয় আফ্রিকাকে। এটা মনোজাগতিক ঔপনিবেশিকতার প্রকাশ। পৃথিবীর সবচেয়ে বেশি খনিজ সম্পদ আফ্রিকা মহাদেশের ভূমিতে। স্বর্ণ, হীরক, প্লাটিনাম ও ম্যাঙ্গানিজের সবচেয়ে বৃহৎ খনি এই মহাদেশে। সাহারা মরুভূমির পুরো এলাকার তলদেশে মিষ্টি পানির অবস্থান। যা এখনো অনুত্তোলিত। জীব বৈচিত্র্যে ও সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্যে সমৃদ্ধ আলোয় ভরা ‘কালো’ এই মহাদেশটি। মিশরীয় সভ্যতা পৃথিবীর আদি সভ্যতাগুলির একটি যার অবস্থান এ–মহাদেশের উত্তর প্রান্তে। এটা এখন স্বীকৃত সিদ্ধান্ত যে, মনুষ্য জাতির উদ্ভব কিংবা পূর্ববর্তী জীব থেকে চূড়ান্ত উত্তরণ অর্থাৎ মানব রূপে বিবর্তন প্রথমে ঘটেছিল আফ্রিকার পূর্ব, মধ্য ও দক্ষিণ অঞ্চলে। অনেকের মতে ইথিওপিয়ায়। অথচ রোমানরা এ–মহাদেশের নাম রেখেছিলেন, ‘আফ্রিকা’। যার অর্থ ‘অন্ধকারাচ্ছন্ন’। রবীন্দ্রনাথ বলেছেন তাঁর আফ্রিকা কবিতায় ‘হায় ছায়াবৃতা, কালো ঘোমটার নিচে অপরিচিত ছিল তোমার মানবরূপ, উপেক্ষার আবিল দৃষ্টিতে।
উন্মেষ লগ্নেই চলচ্চিত্রের পদার্পন ঘটেছিল আফ্রিকা মহাদেশে। ১৮৯৬ সালেই লুমিয়ের ভ্রাতৃদ্বয় মিশরের কায়রোতে চলচ্চিত্র প্রদর্শন করেছিলেন। ফ্রান্সের বিশ্ববরেণ্য প্রামাণ্য চলচ্চিত্রকার জাঁ রুশের হাতে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শেষে আফ্রিকান সিনেমার জন্ম এবং নাইজারের ওমরুগান্ডার হাতে আফ্রিকান সিনেমার সূত্রপাত হলেও সেনেগালের ওসমান সেমবেনের হাতেই আফ্রিকার সিনেমা সুচারুরূপে গড়ে ওঠে। তিনিই আফ্রিকার চলচ্চিত্রের প্রকৃত জনক। তিনি এমন একজন চলচ্চিত্রকার যিনি তাঁর পুরো মহাদেশকে বিশ্ব চলচ্চিত্রে পরিচিত করেছেন। তাঁর দেখানো পথরেখা ধরেই আফ্রিকার চলচ্চিত্র তার নিজের পটভূমি, নিজের মৌলিকতা, নিজের বৈশিষ্ট্য খুুঁজে পেয়েছে। আফ্রিকার চলচ্চিত্র সত্যিকার অর্থে হয়ে উঠতে পেরেছে আফ্রিকার চলচ্চিত্র ।
প্রকৃত আফ্রিকান চলচ্চিত্রের উন্মেষ আফ্রিকার নিপীড়িত নির্যাতিত কালো মানুষের সাম্রাজ্যবিরোধী সংগ্রামের পটভূমিতে ১৯৬০ সালে। সেই বছর ওসমান সেমবেনে নির্মাণ করেন তাঁর প্রথম চলচ্চিত্র ‘বোরোম সারেত’। এর আগে মূলত তথ্যচিত্র ও ইতস্তত কিছু ছোট–বড় কাহিনীচিত্র তৈরি হয়েছে আফ্রিকায় দেশি–বিদেশি নির্মাতাদের পরিচালনায়। ওসমান সেমবেনের ‘মানি অর্ডার’ ছবিটি আফ্রিকান সিনেমাকে বিশ্ব চলচ্চিত্র পাদপ্রদীপে নিয়ে আসেন ১৯৬৮ সালে।
বিশ্ব চলচ্চিত্রের ঝাঁপি খুললে সেখানে আফ্রিকার কিছু রত্নের দ্যুতি আজ চোখে পড়ে যে রত্ন সঞ্চিত হয়েছে ঘানা, মালি, ক্যামেরুন, বারকিনা ফেসো, মরিতানিয়া, তিউনিশিয়া, ইথিওপিয়া, মিশর, আলজিরিয়া এবং আফ্রিকার চলচ্চিত্রের স্বর্ণভূমি সেনেগাল থেকে। এসব রত্নের সঞ্চয়নে প্রথমে যে মানুষটি উদ্যোগী হন তিনি একজন ফরাসি চলচ্চিত্রকার–জাঁ রুশ, যাঁর কথা আগেই বলা হয়েছে। সেজন্য তাঁকে আফ্রিকান সিনেমার পথিকৃৎ বলা হয়ে থাকে। রুশ এবং তাঁর শিষ্য নাইজারের ওমরু গান্ডার উদ্যোগে নাইজারের রাজধানী নিয়ামোতে ১৯৬০–এর দশকে শুরু হয় চলচ্চিত্র সংসদ আন্দোলন যা ধীরে ধীরে পুরো আফ্রিকায় ছড়িয়ে পড়ে। জাঁ রুশ মূলত একজন প্রকৌশলী। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের শেষে তিনি নাইজারে গিয়েছিলেন এবং ক্রমশঃ ভালোবেসে ফেলেন দেশটিকে। যুক্ত হন সে দেশে চলচ্চিত্র নির্মাণে এবং বন্ধু ও শিষ্য হিসেবে পাশে পান ওমরু গান্ডাকে।
পুরো আফ্রিকা শুরু থেকে বলতে গেলে এখনও হলিউডি এবং বলিউডি ছবির বড় বাজার। যদিওবা মিশরের চলচ্চিত্র শিল্পের শুরু থেকেই বেশ নাম ডাক। ইউসুফ শাহীন, দাউদ আবদুল সায়েদ, আইতেন আমিন, খালেদ ইউসুফ, নাদের জালালের মতো পরিচালক, ওমর শরীফ, উম্মে কুলসুম, ইসমাইল ইয়াসিন, আহমেদ মাযহার, মীনা শাফাবি, লুবনা আবদেল আজিকের মতো অভিনয়শিল্পী এবং মোহাম্মদ আল ফায়েদের মতো প্রযোজক এই দেশ থেকে এসেছেন। তবে ভাষা ও সংস্কৃতিগত কারণে মিশরের সঙ্গে আফ্রিকার মূলধারার অনেক পার্থক্য লক্ষণীয়। কিন্তু মিশরও হলিউডের ছবির বড় বাজার।
এছাড়া আফ্রিকার দেশে দেশে দল–উপদল, গোত্র–উপগোত্র এবং বিভিন্ন ধর্মীয় গোষ্ঠীর মধ্যে গৃহযুদ্ধ জিইয়ে রাখা হয়েছে মূলতঃ ঔপনিবেশিক স্বার্থে। সবকিছু মিলিয়ে আফ্রিকার চলচ্চিত্রকে প্রতিনিয়ত লড়াই করে টিকে থাকতে হচ্ছে এবং এর মধ্যে দিয়েই এখনও তৈরি হয়ে চলেছে চমৎকার সব চলচ্চিত্র।
চট্টগ্রামে আফ্রিকার চলচ্চিত্রের উৎসব
আফ্রিকার চলচ্চিত্রের বিশ্বজুড়ে প্রসারের ক্ষেত্রে ফরাসি সাংস্কৃতিক কেন্দ্র অলিয়ঁস ফ্রঁসেজ–এর এক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। বিশ্বের সব বড় বড় শহরগুলোতে আলিয়ঁস ফ্রঁসেজের যেসব কেন্দ্র রয়েছে সেখানে তারা নিয়মিতভাবে আফ্রিকান চলচ্চিত্র প্রদর্শন করে থাকেন। তবে এক্ষেত্রে তারা ফ্রাংকোফোন অর্থাৎ আফ্রিকার ফরাসিভাষী দেশগুলোতে প্রাধান্য দেন। চট্টগ্রাম আলিয়ঁস ফ্রঁসেজও এর ব্যতিক্রম নন। তাদের উদ্যোগে বিভিন্ন সময় প্রচুর আফ্রিকান চলচ্চিত্র নিয়মিত প্রদর্শিত হয়েছে। তবে আফ্রিকান চলচ্চিত্র নিয়ে তারা প্রথম উৎসবটির আয়োজন করেন ১৯৯৪ সালের মার্চে। এরপর ২০১২ সালে দ্বিতীয় উৎসবটি অনুষ্ঠিত হয়। ১১ বছর পর চট্টগ্রামে আফ্রিকান চলচ্চিত্র উৎসব আয়োজিত হতে যাচ্ছে আগামী ১০ ও ১১ নভেম্বর। আলিয়ঁস ফ্রঁসেজ চট্টগ্রাম ও চট্টগ্রাম ফিল্ম ইনস্টিটিউটের যৌথ আয়োজনে অনুষ্ঠিত এ–উৎসবে সেনেগাল, চাদ, মালি ও কঙ্গোর চারটি উল্লেখযোগ্য চলচ্চিত্র প্রদর্শিত হবে। আলিয়ঁস ফ্রঁসেজ চট্টগ্রামের মিলনায়তনে আয়োজিত এই উৎসবের প্রদর্শনীসমূহ সবার জন্যে উন্মুক্ত থাকবে। ১০ নভম্বের ২০২৩ শুক্রবার বিকেল ৪ টায় উৎসবের উদ্বোধন করবেন চট্টগ্রাম ফিল্ম ইনস্টিটিউটের উপদেষ্টা বিশিষ্ট সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব ও শিশু সংগঠক অধ্যাপক ডা. এ কিউ এম সিরাজুল ইসলাম। বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত থাকবেন গবেষক–লেখক–চলচ্চিত্রবিশেষজ্ঞ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সাংবাদিকতা ও গণযোগাযোগ বিভাগের অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ সহিদ উল্যাহ। উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথি হিসেবে থাকবেন আলিয়ঁস ফ্রঁসেজ চট্টগ্রামের পরিচালক ব্রুনো ল্যাকরাম্পে।
উৎসবে ১০ নভেম্বর বিকেল ৪.৩০ মিনিটে উদ্বোধনী চলচ্চিত্র হিসেবে প্রদর্শিত হবে ওসমান সেমবেনে পরিচালিত বিশ্ববিখ্যাত সেনেগালের চলচ্চিত্র ‘মানি অর্ডার’। এরপর সন্ধ্যা ৬ টায় প্রদর্শিত হবে চাদের বহু পুরস্কৃত চলচ্চিত্র মাহমুত–সালেহ হারুন পরিচালিত ‘আ স্ক্রিমিং ম্যান’। ১১ নভেম্বর শনিবার বিকেল ৪ টায় প্রদর্শিত হবে সুলেইমান সিসে পরিচালিত মালির বিশ্ববিখ্যাত চলচ্চিত্র ‘ইয়েলিন’ এবং সন্ধ্যা ৬ টায় প্রদর্শিত হবে উৎসবের সমাপনী চলচ্চিত্র মালির মাশেরি একওয়া বাহাঙ্গো পরিচালিত বহু পুরস্কৃত সাম্প্রতিক চলচ্চিত্র ‘মাকিলা’। উৎসব উপলক্ষে চট্টগ্রাম ফিল্ম ইনস্টিটিউটের মুখপাত্র ডিপ ফোকাসের আফ্রিকান চলচ্চিত্র উৎসব সংখ্যা প্রকাশিত হবে।