আফ্রিকান কাসাভা চাষে পরিবেশে মারাত্মক ক্ষতি

খাগড়াছড়িতে দুই কোম্পানির হাতে জিম্মি চাষিরা

সমির মল্লিক, খাগড়াছড়ি | রবিবার , ৫ জানুয়ারি, ২০২৫ at ৮:০৬ পূর্বাহ্ণ

খাগড়াছড়িতে আফ্রিকার কৃষিজ ফসল কাসাভার চাষ সম্প্রসারিত হচ্ছে। এতে পাহাড়ের মাটি ক্ষয়ে উর্বরতা হারাচ্ছে পাহাড়। এছাড়া বন উজাড় করে কাসাভা চাষের কারণে জীববৈচিত্র্যও হুমকির মুখে পড়েছে।

মৃত্তিকা বিজ্ঞানীরা পাহাড়ে কাসাভা চাষকে ক্ষতিকর হিসেবে উল্লেখ করেছেন। ঢাকার দুটি বাণিজ্যিক কোম্পানি সুদমুক্ত ঋণসহ সার্বিক সহায়তা দানের মাধ্যমে চুক্তিভিত্তিক কাসাভা চাষে উৎসাহ যোগাচ্ছে গরিব লোকজনদের। অন্যদিকে, কোম্পানি দুটি কেবলমাত্র ক্রেতা হওয়ায় তাদের নির্ধারিত দামেই কাসাভা বিক্রি করতে বাধ্য হচ্ছেন চাষিরা। ফলে তারা ন্যায্যমূল্য থেকেও বঞ্চিত হচ্ছেন।

পার্বত্য এলাকায় ঠেংগা আলু নামে অধিক পরিচিত কাসাভা বা শিমুল আলুর চাষাবাদ শুরু হয় ১৫২০ বছর আগে। প্রথম দিকে সীমিত আকারে চাষ হলেও দিন দিন ব্যাপক হারে হচ্ছে কাসাভার চাষ। খাগড়াছড়ির মাটিরাঙ্গা, রামগড়, মানিকছড়ি, লক্ষ্মীছড়ি, গুইমারার বিস্তীর্ণ এলাকায় হাজার হাজার একর পাহাড়ি টিলায় কাসাভার চাষ হচ্ছে। সরকারিভাবে বন্দোবস্তিমূলে পাওয়া ব্যক্তিমালিকাধীন পাহাড়ি টিলার বনজঙ্গল কেটে কাসাভা গাছের কাণ্ড ছোট ছোট টুকরা করে রোপণ করা হয়। এর ৭৮ মাস পর মাটি খুঁড়ে তোলা হয় আলু। এভাবে মাটি উপড়ে আলু তোলার কারণে বর্ষাকালে বৃষ্টির পানির স্রোতে টিলাগুলোতে মাটি ধস হয়। জানা যায়, খাগড়াছড়িতে দুটি কোম্পানির আওতায় প্রায় ৭ হাজার একর পাহাড়ি টিলায় কাসাভা চাষ হচ্ছে। এর মধ্যে মাটিরাঙ্গায় চাষ হচ্ছে ১৩শ একর। সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, ২০২৬ অর্থবছরের মধ্যে খাগড়াছড়িতে কাসাভা চাষ ১৫ হাজার একর পর্যন্ত সম্প্রসারণের পরিকল্পনা রয়েছে ওই কোম্পানি দুটির। রাঙামাটি ও বান্দরবানেও কাসাভা চাষ সম্প্রসারণ করা হচ্ছে। খাগড়াছড়িতে দীর্ঘদিন দায়িত্ব পালনকারী বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের অবসরপ্রাপ্ত মুখ্য বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. মো. জুলফিকার আলী ফিরোজ বলেন, পাহাড়ে যে পদ্ধতিতে কাসাভার চাষ হচ্ছে তা সম্পূর্ণ অবৈজ্ঞানিক। কাসাভার গাছের মূলই আলু হিসাবে ব্যবহার হয়। মাটির অনেক গভীরে থাকা এ মূল তোলার জন্য টিলার মাটি কোদাল দিয়ে উপড়ে ফেলা হয়। এভাবে এলোপাথাড়ি খোঁড়াখুঁড়ির কারণে পুরো টিলার মাটিই আলগা হয়ে পড়ে। বর্ষার সময় অল্প বৃষ্টি হলে সহজেই ধসে পড়ে টিলাগুলোর মাটি। এছাড়া ভূমির উপরিভাগে থাকা মাটির উর্বর উপাদান বা টপ সয়েলও ধসে যায়। ফলে টিলাগুলো হয়ে পড়ে অনুর্বর। তিনি বলেন, এক ইঞ্চি উর্বর মাটি বা টপ সয়েল সৃষ্টি হতে একশ বছরের মতো সময় লেগে যায়। অথচ এ মূল্যবান উপাদানই নষ্ট করা হচ্ছে কাসাভা চাষের কারণে।

খাগড়াছড়ি কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগের উপপরিচালক মো. বাছেরুল আলম বলেন, সমতল ভূমিতে চাষাবাদ করলে ক্ষতি নেই। কিন্তু পাহাড়ি টিলায় কাসাভা চাষ করায় মারাত্মক ক্ষতি হচ্ছে। তিনি জানান, কৃষি বিভাগ এ ব্যাপারে চাষিদের সচেতন করতে উদ্যোগ নিয়েছে।

জানা যায়, ঢাকার রহমান কেমিক্যালস লি. নামে একটি প্রতিষ্ঠান দেশের সমতল জেলার মতো পার্বত্য এলাকায় সর্বপ্রথম কাসাভার চাষাবাদ শুরু করে। পরবর্তীতে ২০১৪ সাল হতে অপর একটি কোম্পানিও এ প্রজেক্ট শুরু করে। কাসাভা চাষে কোম্পানি দুটি চাষিদের কাছে অর্থ বিনিয়োগসহ সার্বিক তত্ত্বাবধান করে থাকে। উৎপাদিত কাসাভা তাদের নির্ধারিত মূল্যেই চাষিদের কাছ থেকে কিনে নেয় তারা।

চাষিদের সাথে কথা বলে জানা গেছে, উৎপাদিত কাসাভা সংশ্লিষ্ট কোম্পানির কারখানায় পৌঁছানোর পর মণপ্রতি ৪৬০ টাকা হারে দেওয়া হয় চাষিদের। একটি কোম্পানির কারখানা হবিগঞ্জের অলিপুর এবং অপরটির কারখানা নারায়ণগঞ্জ অবস্থিত।

নূরুল আফসার নামে এক চাষি জানান, এক গাড়িতে ১২ মেট্রিক টন কাসাভা হবিগঞ্জে কোম্পানির কারখানায় পৌঁছানোর পর ৪৫ হাজার টাকাও লাভ হয় না। চাষাবাদ, পরিবহন এবং সড়কের লাইন খরচ বাদ দিলে পকেটের লাভের অংশ থাকে অতি সামান্য। তবুও পেটের ভাত যোগাড় করতে এ আলুর চাষ করা।

জানা যায়, চাষাবাদের খরচ হিসাবে কোম্পানি বিনা সুদে চাহিদামতো অগ্রিম ঋণ সুবিধা দেওয়ার কারণে দরিদ্র লোকজন কাসাভা চাষে উৎসাহী হয়। মাটিরাঙ্গার জনৈক চাষি বলেন, কাসাভা চাষের জন্য কোম্পানি প্রায় ৮০ শতাংশ টাকা অগ্রিম দেয়।

খাগড়াছড়ি বিভাগীয় বন কর্মকর্তা এবং জেলা পরিবেশ ও বন উন্নয়ন কমিটির সদস্য সচিব মো. ফরিদ মিয়া বলেন, খাগড়াছড়িতে সরকারের বন্দোবস্তি দেওয়া পাহাড়ি টিলাগুলোতেই কাসাভা চাষ হচ্ছে। ফলে বনবিভাগের কিছু করার এখতিয়ার নেই। তিনি বলেন, বনজঙ্গল কেটে আগুনে পোড়ানোর পর মাটি কর্ষণ করে পাহাড়গুলোতে কাসাভা চাষ করা হচ্ছে। এতে শত শত পাহাড়ের বন ধ্বংসের পাশাপাশি জীববৈচিত্র্যও বিপন্ন হচ্ছে। এক কথায় পাহাড়ে কাসাভা চাষের কারণে এ পার্বত্য এলাকার প্রকৃতি ও পরিবেশ মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।

তিনি বলেন, জেলা প্রশাসন, পরিবেশ অধিদপ্তরসহ সংশ্লিষ্ট অন্যান্য বিভাগের সমন্বিত উদ্যোগ ব্যতীত পাহাড়ে কাসাভা চাষ বন্ধ করা সম্ভব নয়। এ ব্যাপারে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে বন ও পরিবেশ মন্ত্রণালয়েও তিনি চিঠি লিখেছেন বলে জানান।

মাটিরাঙ্গার পিটাছড়া বন ও বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ উদ্যোগের প্রতিষ্ঠাতা মাহফুজ রাসেল বলেন, পার্বত্য চট্টগ্রামে কাসাভা চাষের দ্রুত বিস্তার উদ্বেগজনক। আগামী কয়েক বছরের মধ্যে এখানকার বনাঞ্চল পুরোপুরি বিলীন হয়ে যেতে পারে। তিনি বলেন, ক্ষতিকর কাসাভা চাষাবাদ বন্ধ করার দাবিতে বেলা ও তাদের সংগঠনের উদ্যোগে চট্টগ্রামে মানববন্ধন কর্মসূচিও পালন করা হয়। খাগড়াছড়ির জেলা প্রশাসক, পরিবেশ অধিদপ্তরসহ বিভিন্ন বিভাগের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে লিখিতভাবে অভিযোগআবেদন পেশ করা হয়েছে। কিন্তু এর কোনো ফল পাওয়া যায়নি।

পূর্ববর্তী নিবন্ধযুক্তরাষ্ট্রের সর্বোচ্চ বেসামরিক পদক পাচ্ছেন মেসি
পরবর্তী নিবন্ধকী কী করলে ভালো নির্বাচন হয়, ঠিক করুন : মান্না