বাংলাদেশের চলচ্চিত্র শিল্পে কয়েকজন সিনেমাটোগ্রাফার তারকাখ্যাতি অর্জন করেছিলেন যা রীতিমতো অভাবনীয়। কারণ তারকাখ্যাতি পান কেবল প্রধান অভিনয় শিল্পীরা প্রচলিতভাবে যারা নায়ক নায়িকা অভিধায় অভিহিত হয়ে থাকেন। পরিচালকদের মধ্যেও সকলে এই সৌভাগ্য অর্জনে সমর্থ হয়ে ওঠেন না। কিন্তু এদেশের চলচ্চিত্র শিল্পে বেশ কয়েকজন পরিচালক ও চিত্রগ্রাহক ছিলেন প্রথিতযশা এবং তারকাখচিত। চিত্রগ্রাহকদের মধ্যে সাধন রায়, বেবী ইসলাম, রফিকুল বারী চৌধুরী, এম. এ. সামাদ (মোহাম্মদ আবদুস সামাদ), অরুণ রায়, আবদুল লতিফ বাচ্চু, রেজা লতিফ, এম এ মোবিন, হারুন আল রশীদ এঁরা ছিলেন অগ্রগণ্য। এঁদের পরবর্তী প্রজন্মে আমরা পেয়েছি আনোয়ার হোসেন, শফিকুল ইসলাম স্বপন, মাকসুদুল বারী, মিশুক মুনীর, পংকজ পালিতকে। তবে এঁদের মধ্যে একজনের নাম পৃথকভাবে উল্লেখ্য তাঁর কাজের বিশেষত্বে, তিনি আফজাল এইচ চৌধুরী (আফজাল হোসেন চৌধুরী), আফজাল চৌধুরী নামে যিনি পরিচিত ছিলেন। আমাদের সিনেমার শুরুর দিকের একজন যশস্বী সিনেমাটোগ্রাফার।
কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্যি এ–প্রজন্ম তাঁর নামও শোনেননি। পূর্ববর্তী প্রজন্মও বিস্মৃত হয়েছেন। অথচ তিনি এদেশের আধুনিক সিনেমাটোগ্রাফির প্রবর্তক। মৃত্যুর পরেও তিনি পাননি প্রাপ্য সম্মান। তাঁর জন্মভূমি তাঁকে জীবদ্দশায় রাষ্ট্রীয়ভাবে সম্মানিত করেনি। হয়তো তাঁর অপরাধ তিনি ১৯৭১ সালে পাকিস্তানে ছিলেন এবং দেরিতে দেশে ফিরেছেন। এটা যদি অপরাধ হয়ে থাকে, তবে এদেশে এরকম অপরাধী অনেকেই ছিলেন বা রয়েছেন যারা বেশ সম্মান ও দাপটের সঙ্গে বিচরণ করেছেন ও করছেন। অনেকেই তো দেশে থেকেই দেশের বিরুদ্ধে কাজ করে পরবর্তী সময়ে ভূষিত হয়েছেন নানা পদক, পুরস্কার আর ক্ষমতায়।
তবে এদেশের বিকল্প চলচ্চিত্র আন্দোলন আফজাল চৌধুরীকে সম্মান জানিয়েছিল। আন্তর্জাতিক স্বল্পদৈর্ঘ্য ও মুক্ত চলচ্চিত্র উৎসব ২০১৬ সালে তাঁকে ‘হীরালাল সেন স্মারক সম্মাননা পদক’ প্রদান করে।
আইজেন স্টাইনের নামের পাশে যেমন উচ্চারিত হয় তাঁর চিত্রগ্রাহক এডওয়ার্ড টিশের নাম, গোদারের পাশে রাউল কুতার, সত্যজিতের পাশে সুব্রত মিত্র ও সৌম্যেন্দু রায়, তেমনি জহির রায়হানের পাশে আসে আফজাল চৌধুরীর নাম। কেবল জহির রায়হানের পরিচালিত প্রায় সব ছবিই নয়, তাঁর প্রযোজিত অনেক ছবির চিত্রগ্রাহক ছিলেন আফজাল চৌধুরী।
জহির রায়হান ১৯৬১ সালে তাঁর প্রথম ছবি কখনো আসেনি নির্মাণ করেন। ৬২ তে কলিম শরাফীর সঙ্গে যৌথভাবে পরিচালনা করেন সোনার কাজল। কিন্তু ছবি দুটির চিত্রগ্রহণ নিয়ে তিনি অসন্তুষ্ট ছিলেন। তৃতীয় ছবি কাঁচের দেয়ালের কাজ শুরু করলেন ৬২ তে। ছবিটি ছিল চেম্বার সিনেমা। শেষ দৃশ্য ছাড়া পুরোটাই ইনডোরে একটি বাড়ির সেটে। বাজেট কম। একমাসে শুটিং শেষ করার পরিকল্পনা। বেবী ইসলামকে নিলেন ক্যামেরায়। কিন্তু এত অল্প সময়ে তিনি কাজ শেষ করতে অপারগতা জানালেন। আফজাল চৌধুরীর কাজের প্রশংসা জহিরের কানে এসেছিল।
আফজাল তখন করাচি ও লাহোরের ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রিতে কাজ করছেন। খান আতাউর রহমান কাঁচের দেয়াল ছবির নায়ক। আনিস নামে কখনো আসেনিতেও অভিনয় করেছেন তিনি। খান আতা চিনতেন আফজালকে। তাঁর পরামর্শে জহির আফজালকে নেবেন মনস্থ করে খান আতাকে চিঠি দিয়ে লাহোরে পাঠিয়ে আফজালকে আনিয়ে নিলেন। জহির যে ধরনের ক্যামেরার কাজ চাইছেন আফজাল সেটা বুঝতে সমর্থ হলেন। মূলত ক্লোজ আপ এবং লো কি লাইটের কাজ। ডিপ ফোকাসের কাজও রয়েছে প্রচুর দৃশ্যে। দুজন দুজনকে বুঝলেন এবং জহির রায়হান–আফজাল চৌধুরীর গাঁটছড়া বাঁধা হলো। একের পর এক তৈরি হলো ; কাঁচের দেয়াল (১৯৬৩), পাকিস্তানের প্রথম রঙিন ছবি সঙ্গম (৬৪), পাকিস্তানের প্রথম সিনেমাস্কোপ ছবি বাহানা (৬৫), প্রথম ত্রয়ী চরিত্রের (নাদিম) ছবি জলতে সুরজকে নিচে (৭০) (অবশ্য উর্দু ছবিটির টাইটেলে পরিচালক হিসেবে নুরুল হক বাচ্চুর নাম লেখা রয়েছে) এবং প্রথম রাজনৈতিক চলচ্চিত্র জীবন থেকে নেয়া (৭০)।
খান আতা পরিচালিত প্রথম ছবি অনেক দিনের চেনা (৬৪)-র চিত্রগ্রহণে ছিলেন আফজাল। ঢাকায় তিনি প্রায় একশোটি ছবির চিত্রগ্রহণ করেছেন। যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য নজরুল ইসলামের আপন দুলাল (৬৬), সুভাষ দত্তের আয়না ও অবশিষ্ট (৬৭), কাজী জহিরের নয়নতারা (৬৭) আবদুল জব্বার খানের বাঁশরী (৬৮), রহিম নেওয়াজের মনের মত বউ (৬৯)। তাঁর সিনেমাটোগ্রাফির মূল বিশেষত্ব ছিল ক্লোজ আপের বুদ্ধিদীপ্ত ও নান্দনিক প্রয়োগ। জীবন থেকে নেয়া এর একটি উৎকৃষ্ট দৃষ্টান্ত। এ ছবির কোর্টসিকোয়েন্স, যেটি পুরো ছবির ভরকেন্দ্র, সিকোয়েন্সটি প্রায় পুরোটাই ক্লোজ শটের কম্পোজিশনে তৈরি। এ ছবির ‘আমার সোনার বাংলা’ গানটির সিকোয়েন্সও আরেকটি নান্দনিক দৃষ্টান্ত ক্লোজ শটের। তেমনি আরেকটি স্মরণীয় উদাহরণ মনের মত বউ ছবির ‘না না না যেওনা’ গানের সিকোয়েন্স।
জহির রায়হানের পরে নজরুল ইসলামের সঙ্গেও আফজাল চৌধুরীর ভালো বোঝাপড়া ছিল। পাকিস্তানের সবচেয়ে ব্যবসাসফল ছবি নজরুল ইসলাম পরিচালিত আয়না চিত্রগ্রহণও ছিল আফজাল চৌধুরীর করা। পাকিস্তানের প্রথম আদর্শিক ছবি গুলে বাকালি (৬১)র চিত্র গ্রাহকও ছিলেন তিনি। পাকিস্তানে তিনি বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর আরো বেশ কয়েক বছর ছিলেন এবং এরপর ঢাকায় ফিরে আসেন। পাকিস্তানে তিনি প্রচুর ছবির চিত্রগ্রহণ করেন। জলতে সুরজ কা নিচে ছবির প্রযোজক ছিলেন তিনি। পাকিস্তানে আরো কয়েকটি ছবি তিনি প্রযোজনা করেন।
আফজাল চৌধুরীর ক্যামেরা স্কুলিং পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশে ও পাকিস্তানে অনেকেই অনুসরণ করেছেন। বাংলাদেশে অরুণ রায়, রেজা লতিফ এঁদের কাজে আফজাল সাহেবের প্রভাব লক্ষণীয়। শৈশব থেকেই তিনি ফটোগ্রাফিতে অনুরাগী ছিলেন। ১৯৫০ সালে মাত্র ১৯ বছর বয়সে তিনি সিনেমাটোগ্রাফি শিখতে মুম্বাই চলে যান। সেখানেও বিখ্যাত সিনেমাটোগ্রাফার ভ্রাতৃদ্বয় জাল মিস্ত্রি ও ফলি মিস্ত্রির বেশ কিছুদিন কাজ শেখার পর ঢাকায় ফিরে ইউএস আইএসে যোগ দেন। সেখানে কিছুদিন কাজ করার পর চলে যান লাহোরের ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রিতে। জহির রায়হানের আমন্ত্রণে ১৯৬২ সালে ঢাকায় এসে এ খান ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রিতে যুক্ত হন।
১৯৩১ সালের ৩১ অক্টোবর সিরাজগঞ্জে জন্ম আফজাল চৌধুরীর। স্ত্রী সুরাইয়া আফজাল ও দুই কন্যা নিয়ে তাঁর সংসার। ৯২ বছর বয়সে ২০২৩ সালের ১ সেপ্টেম্বর ঢাকায় তিনি প্রয়াত হলেন। সমাহিত হলেন ৩ সেপ্টেম্বর জন্মস্থান সিরাজগঞ্জে। আমাদের চলচ্চিত্রের প্রথিতযশা এই আলোকচিত্রশিল্পীর স্মরণে সকৃতজ্ঞ শ্রদ্ধাঞ্জলি।
তথ্য ও ছবি ঋণ: মীর শামসুল আলম বাবু