“আশির দশকে আমি টুকটাক গান করছি। আধুনিক গান গাই। আগে এদেশের গীতিকবিরা কোলকাতার আবহে গান লিখতেন। আশির দশকে তার থেকে বেরিয়ে কয়েকজন গীতিকবি নতুনভাবে গান লেখার চেষ্টা করেন। শহীদ মাহমুদ জঙ্গী সেই নতুনধারার গীতিকবি, যা আমাদের বাংলা গানের নতুন ধারা এনে দিয়েছে। ঐ সময়ে শহীদ মাহমুদ জঙ্গীর নাম কানে আসে। কিন্তু তার লেখা গান করা হয়ে উঠছিল না। সমপ্রতি তার লেখায় গান করার সৌভাগ্য হলো। মনে হলো আমার সংগীত ক্যারিয়ার পূর্ণতা পেল”–এভাবেই নিজের অনুভূতি প্রকাশ করলেন দেশের প্রবীণ সংগীতশিল্পী রফিকুল আলম
“আপন আলোয় শহীদ মাহমুদ জঙ্গী : গানে গানে সত্তর ” অনুষ্ঠানে।
১২ ডিসেম্বর ২০২৫ শুক্রবার বিকেলে ঢাকার ধানমন্ডিস্থ রাশান হাউজে “আপন আলোয় শহীদ মাহমুদ জঙ্গী : গানে গানে সত্তর” শিরোনামে অনুষ্ঠানে দেশ বরেণ্য সংগীত শিল্পীদের অংশগ্রহণে গীতিকবি শহীদ মাহমুদ জঙ্গীর লেখা গান পরিবেশন এবং তাকে নিয়ে লেখা গ্রন্থের মোড়ক উন্মোচন হলো।
বাংলা গানের লিরিকে বাঁক বদলের অন্যতম কান্ডারি শহীদ মাহমুদ জঙ্গী। গানের কথায় কাব্যময়তা আর বিষয়বৈচিত্র্যের মিশেলে তিনি সত্তর দশকের শেষদিকে বাংলা গানে করে নিয়েছেন এক স্বতন্ত্র অবস্থান। অনুষ্ঠানে আগত অতিথিরা সেই কথাই বলছিলেন। নিজেদের ভালো লাগার অনুভূতি প্রকাশ করছিলেন।
গায়ক, সুরকার রেনেসাঁর প্রতিষ্ঠাতা সদস্য নকীব খান বলেন: “জঙ্গী ভাইয়ের লেখা গানের বক্তব্যগুলো সমাজকে বার্তা দেয়। প্রজন্মকে বার্তা দেয়। এটা অনেক বড় ব্যাপার।” নিঃসন্দেহে নকীব খানের এই বক্তব্য গভীরভাবে ভাবায়। কারণ, গান যদি সমাজ ও প্রজন্মকে বার্তা দেয়, তাহলে সেই গান কালজয়ী। হয়েছেও তাই। শহীদ মাহমুদ জঙ্গীর বেশ কয়েকটি গান তো কালজয়ী। যেমন: আজ যে শিশু, হৃদয় কাদামাটির কোন মূর্তি নয়, একদিন ঘুম ভাঙা শহরে, যতিন স্যারের ক্লাশে, হে বাংলাদেশ তোমার বয়স হলো কত, তৃতীয় বিশ্ব, সময় যেন কাটে না, আণবিক আঘাতে–এমন অনেক গান আজও গাইছেন বিভিন্ন প্রজন্মের শিল্পীরা।
একবছর আগে এলিটা করিমের “চিনি দেড় চামচ” শিরোনামে গানের রিলিজ অনুষ্ঠানে ( ২৪ ডিসেম্বর, ২০২৪) দেশের আরেক বরেণ্য গীতিকবি লিটন অধিকারী রিন্টু বলেছিলেন: “শহীদ মাহমুদ জঙ্গী বাংলাদেশের ব্যতিক্রমী গীতিকার। যিনি সময় ও আধুনিকতাকে সাথে নিয়ে চলেন। যা তার সৃষ্টির মাধ্যমে শ্রোতারা শুনতে পায় ও উপলব্ধি করছেন। সুরকার ও কণ্ঠশিল্পীও সমৃদ্ধ হচ্ছেন। এটা অনেক বড় বিষয়।” এক বছর পরে এসে লিটন অধিকারী রিন্টুর কথাটি নতুন করে উপলব্ধি করা গেল, অনুষ্ঠানে আগত অতিথিদের কথা শুনে।
ড্রামার, সুরকার, গায়ক ও রেনেসাঁ ব্যান্ডের প্রতিষ্ঠাতা সদস্য পিলু খানের উপলব্ধি: “আমাদের ব্যান্ডের যে টাইপ, চরিত্র ও যে কালচারে আমরা এসে পৌঁছেছি, সেটা অবশ্যই শহীদ মাহমুদ জঙ্গীর কথাতেই সৃষ্টি হয়েছে।” আসলেই কিন্তু তাই। বাংলাদেশের ব্যান্ড জগতে ‘রেনেসাঁ’ শুরু থেকেই স্বতন্ত্র অবস্থানে আছে। এবং সেটা ধরে রেখেছে। আর তার কারণটাও পিলু খান বললেন।
মূলত: শহীদ মাহমুদ জঙ্গীর সত্তরতম জন্মদিন উপলক্ষে আয়োজন করা হয় এই অনুষ্ঠানের। আজব কারখানার উদ্যোগে এই অনুষ্ঠানে সূচনা হয় ‘লার্ন গিটার উইথ আসাদ’ নামের একটি গিটার শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিশু শিল্পীদের পরিবেশনার মধ্য দিয়ে। একেবারেই নবীন প্রজন্মের শিল্পীরা গিটার বাজিয়ে শোনালো “আজ যে শিশু” এবং “একদিন ঘুম ভাঙা শহরে” গান। যা লিখেছেন শহীদ মাহমুদ জঙ্গী। এটিও চমকপ্রদ উপস্থাপন ও পরিবেশন।
অনুষ্ঠানে এই বরেণ্য গীতিকবিকে বাংলাদেশের জাতীয় পতাকা খচিত উত্তরীয় পরিয়ে দেন প্রবীণ সংগীতশিল্পী খুরশিদ আলম, সংগীতশিল্পী রফিকুল আলম, বামবার প্রতিষ্ঠাতা ফায়সাল সিদ্দিকী বগী, সুরকার ও গায়ক নকীব খান, ড্রামার, সুরকার ও গায়ক পিলু খান। এরপর “আপন আলোয় শহীদ মাহমুদ জঙ্গী : গানে গানে সত্তর” শিরোনামে গ্রন্থের মোড়ক উন্মোচন। জয় শাহরিয়ারের সম্পাদনায় প্রকাশিত এই গ্রন্থে শহীদ মাহমুদ জঙ্গীকে নিয়ে তেত্রিশ জন লিখেছেন। একজন গীতিকবিকে নিয়ে এমন একটা সমৃদ্ধ গ্রন্থ সমসাময়িক কালে প্রকাশিত হয়নি।
চট্টগ্রামের কৃতী সন্তান শহীদ মাহমুদ জঙ্গী। যার বেড়ে ওঠা দেওয়ানবাজারে। বিশাল অভিজ্ঞতা পেরিয়ে আজ তিনি বাংলাদেশের কিংবদন্তি গীতিকবি। তার জীবনকর্ম নিয়ে লিখেছেন কণ্ঠশিল্পী, সুরকার, গীতিকবি, ছোটবেলার বন্ধু, পরিবারের সদস্য, সংগীত গবেষক, সাংবাদিক। বইটি উৎসর্গ করা হয়েছে স্বাধীন বাংলা বেতারকেন্দ্রের সব যোদ্ধাকে। বইটি সহ–সম্পাদনায় যুক্ত ছিলেন নিশীথ সূর্য এবং শাহরিয়ার আদনান।
অনুষ্ঠানটি ছিল শহীদ মাহমুদ জঙ্গীর লেখা গানে গানে সাজানো। মঞ্চে গাইলেন রফিকুল আলম, কিশোর দাশ, সুমন কল্যাণ, নিশীথ সূর্য, পান্থ কানাই, জয় শাহরিয়ার, নাসীম আলী খান, সামিনা চৌধুরী, নকীব খান, পিলু খান ও ব্যান্ড রেনেসাঁ।
অনুষ্ঠানের মঞ্চে সামিনা চৌধুরী গাইছিলেন “হৃদয়ের নীল যদি সাগরের নীল হতো” – গাইবার ফাঁকে সামনে উপস্থিত গানটির লেখক শহীদ মাহমুদ জঙ্গীর কাছ থেকে জানতে চাইলেন, “কেমনে লিখেছেন এই গান–বলুন তো জঙ্গী ভাই? কি অসাধারণ সৃষ্টি।” দর্শক–শ্রোতারাও মেতে উঠলেন এমন অসাধারণ সংগীত পরিবেশনের আবহ পেয়ে। পরে তো সামিনা চৌধুরী বললেন: “আসলে তো যে গান গায়, তাকেই চেনেন সবাই। পরিচিতি পায়। কিন্তু যারা নেপথ্যের কাজ করেন, তাদের তেমন জানেন না। গীতিকবি, সুরকার, যন্ত্রশিল্পীদের নিয়ে তেমন আলোচনা হয় না। তাই জঙ্গী ভাইয়ের মতো গীতিকবিকে নিয়ে এই ধরনের আয়োজন প্রশংসনীয়।”
নাসীম আলী খান যখন গাইলেন–চায়ের কাপে পরিচয়, যতিন স্যারের ক্লাশে–ফিরে যেতে হলো সেই আশির দশকের সময়টাতে। তুমুল আলোড়ন তুলেছিল তার গান।
রেনেসাঁ ব্যান্ডের পরিবেশনা পুরো হলভর্তি শ্রোতাকে মাতিয়ে রাখে। হে বাংলাদেশ তোমার বয়স হলো কত, হৃদয় কাদামাটির কোন মূর্তি নয়, আঁরো দেশত যাইয়ু তুঁই, আজ যে শিশু–ইত্যাদি কালজয়ী গানগুলো ভীষণ রকমের নস্টালজিক করে দেয়। নকীব খানের অর্গান বাজানো এবং পিলু খানের ড্রাম বাজানোর কারিশমা এবং সর্বোপরি এই দুইজনের কণ্ঠে সমগ্র অনুষ্ঠান রূপ নেয় বর্ণিলে। অসাধারণ অভিজ্ঞতা।
“আপন আলোয় শহীদ মাহমুদ জঙ্গি : গানে গানে সত্তর ” অনুষ্ঠানটি সমসাময়িক সময়ের স্মরণীয় অনুষ্ঠান। এমন সুন্দর ও সার্থক আয়োজনের জন্য আয়োজক আজব কারখানাকে আন্তরিক ধন্যবাদ জানাই। পরিশেষে “আঁরার জঙ্গী বদ্দার লাই বহুত ভালোবাসা। আরও নোয়া নোয়া গান আঁরা হুনিত ফারি–এই আবদার গরিলাম।”











