লাক্বাদ কা–না লাকুম ফী রাসূ–লিল্লা–হি উস্ওয়াতুন হাসানাতুল্ লিমান কা–না ইয়ারজুল্লা–হা ওয়াল ইয়াউমাল আ–খিরা ওয়া যাকারাল্লা–হা কাসী–রা–। অর্থ: নিশ্চয় তোমাদের পথপ্রদর্শনের জন্য আল্লাহ্র রসূলের জীবনে সর্বোৎকৃষ্ট নমুনা রয়েছে। এ নমুনা তার জন্য, যে আল্লাহ্ তা‘আলার সাথে সাক্ষাৎ করার ও ক্বিয়ামত আসার আশা রাখে আর বেশী পরিমাণে আল্লাহ্কে স্মরণ করে। (সূরা আহযাব : আয়াত ২১)
‘উস্ওয়া’ শব্দের অর্থ ও মাহাত্ম্য
‘উস্ওয়াতুন’ ফু’লাতুনএর সমার্থক শব্দ। এটা ই–তিসা–উন থেকে গৃহীত। যেমন ক্বুদ্ওয়াতুন শব্দটি ‘ইক্বতিদা–উন থেকে গৃহীত। আল্লামা ক্বাযী সানা উল্লাহ পানিপথী বলেন, আল্ উসওয়াতু মা’না–হু আলক্বুদ্ওয়াতু হুয়া মা– ইয়ুক্বদাতা– বিহী–। ‘উস্ওয়া শব্দের অর্থ ক্বুদ্ওয়া। অর্থাৎ যার অনুসরণ করা যায়।
(ক্বাযী সানা উল্লাহ্ পানিপথী : তাফসীর–ই মাযহারী : ৫ম খণ্ড : পৃ. ৫০২)
আল্লামা ক্বুরত্ববী ‘উস্ওয়া’র আরেকটি সুৃন্দর অর্থ বর্ণনা করেছেন, আল–উস্ওয়াতুল ক্বুদ্ওয়াতু ওয়াল উস্ওয়াতু উস্ওয়াতু মা– ইয়ুতাআস্সা– বিহী– আয় ইয়ুতা‘আয্যা– ফাউয়ুক্বতাদা– বিহী– ফী– জামী-‘ই আহ্ওয়া–লিহী– ওয়া উযুতা‘আয্যা– বিহী– ফী– জামী-‘ই আফ‘আ–লিহী–। অর্থ: উস্ওয়ার এক অর্থ রাহনুমা (পথপ্রদর্শক)। আর তাঁকেও উস্ওয়া বলা হয়, যিনি দুঃখক্লিষ্ট অন্তরের শান্তির কারণ বা মাধ্যম হন, যাঁর সর্বাবস্থায় অনুসরণ করা যায়। আর তিনি সমস্ত কাজ ও অবস্থায় তৃপ্তির কারণ হন।
(আল্লামা ক্বুরত্বভী আন্দালূসী মালেকী : তাফসীর–ই
ক্বুরত্বভী, আল–জামি‘উ লিআহকা–মিল ক্বোরআন :১৪শ খণ্ড : পৃ. ১৫৫)
এটা মানে সমগ্র সৃষ্টির প্রাণ সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়া সাল্লাম–এর মহান সত্তা। কারণ তাঁর প্রশংসিত সত্তায় আল্লাহ্ তা‘আলা সমগ্র সৃষ্টির সমস্ত সৌন্দর্য ও গুণ সন্নিবিষ্ট করে এরশাদ করেছেন, আমার ক্বুদরতের কারখানায় আমার হাবীবই এমন এক মহান সৃষ্টির কৃর্তি, যাঁর পদাঙ্কই দুনিয়া ও আখিরাতের সমস্ত সাফল্য ও উজ্জ্বলতার উৎস।
আয়াত শরীফের দ্বিতীয় অংশে একথা সুষ্পষ্ট করা হয়েছে যে, হুযূর–ই আকরামের প্রশংসিত সত্তা ওইসব সৌভাগ্যবানের জন্য নমুনা, যারা আল্লাহ তা‘আলার সাক্ষাৎপ্রার্থী আর হাশরের দিনে পুনরায় জীবিত হবার আশা পোষণ করে। তারাই এ উসওয়া–ই হাসানাহ্ থেকে উপকৃত হয়। আর তাদেরকেই হুযূর মোস্তফা সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়া সাল্লাম–এর সৌন্দর্য নিজের দিকে টেনে আনে।
ইসলাম নিছক দার্শনিক দৃষ্টিভঙ্গিগুলোর সমষ্টি নয় যে, আপনি নিজের ড্রয়িং রূমে আরামদায়ক পশমী আসনে বসে সেগুলোকে আলোচনার বিষয়বস্তু করে নেবেন, নিজের মন থেকে নানা ধরনের সংশোধনী পেশ করবেন, আলোচনা সভার আয়োজন করে কথিকাদি পড়বেন, তারপর মনে করে বসবেন যে, আমি আমার উপর অর্পিত ফরয কাজগুলো সমপন্ন করে নিয়েছি; বরং এটাতো একটা জীবন–বিধান, যা মানব–জীবনের প্রতিটি মোড়ে পথপ্রদর্শন করে আর প্রতিটি সোপানে পয়গাম পৌঁছায়। তদনুযায়ী আমল করা আর সেটার শিক্ষাগুলোকে কাজে পরিণত করা ওই সময় পর্যন্ত সহজ নয়, যতক্ষণ পর্যন্ত একটি কাজের নমুনা আমাদের নিকট থাকবেনা। এজন্য মহামহিম আল্লাহ্ তাঁর সৃষ্টির উপর শুধু ক্বোরআন নাযিল করে ক্ষান্ত হননি, বরং সেটা পৌঁছানোর জন্য নিজের মহান হাবীব সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়া সাল্লামকে নির্বাচন করেছেন, যাতে তিনি খোদাওয়ান্দ তা‘আলার বাণীগুলো অনুসারে নিজে আমল করে দেখান, আর সেগুলো অনুসারে আমল করলে জীবনে যেই সৌন্দর্য ও স্বচ্ছতার সৃষ্টি হয় সেটার কার্যত: নমুনা উপস্থাপন করেন, যাতে যারা সত্যের অনুসন্ধানী হয় তারা ক্বোরআনী শিক্ষাগুলোর কার্যত: আকৃতি দেখে সেটাকে নিজের বুকের সাথে লাগায়।
এ আয়াত শরীফ খন্দক্বের যুদ্ধের সময় নাযিল হয়েছে। দৃশ্য এ ছিলো যে, শত্রুরা সমগ্র আরবকে সাথে নিয়ে হামলা করে বসেছে। হামলাটা এমনি আকস্মিক ছিলো যে, সেটাকে পেছনে সরানোর জন্য যেই প্রস্তুতির প্রয়োজন ছিলো সেটার জন্য মনঃপূতও যথেষ্ট সময় ছিলোনা। সৈন্য সংখ্যা কম, জীবন যাপনের সামগ্রী এত কম ছিলো যে, কয়েক ওয়াক্বত অনাহারেও থাকতে হয়। মদীনা মুনাওয়ারার ইহুদীরা মূল সময়টুকুতে বন্ধুত্বের সম্পর্ক ছিন্ন করে নিলো। তাদের গাদ্দারীর কারণে অবস্থাদি আরো সঙ্গীন হয়ে গেছে। এমতাবস্থায় সরওয়ার–ই ‘আ–লামিয়াঁ– সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়া সাল্লাম তাঁর সাহাবীদের সাথে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে সদয় উপস্থিত ছিলেন। খন্দক খননের পালা আসলে একজন সাধারণ সৈনিকের মতো খন্দক খননের কাজে লেগে গেছেন। মাটি তুলে তুলে খন্দকের বাইরে ফেলছিলেন। অন্য মুজাহিদদের মতো অনাহারে থাকার কষ্টও সহ্য করে যাচ্ছিলেন। যদি কোন সাহাবী নিজের পেটের উপর একটি পাথর বাঁধছিলেন, তাহলে রসূলে আকরাম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়া সাল্লামকে আপন পেট মুবারকে দু’টি পাথর বাঁধতে দেখা গেছে। গোটা মাসের প্রচণ্ড শীতে যুদ্ধের ময়দানে সাহাবা–ই কেরামের সাথে অবস্থান করেছেন। শত্রুদের হামলাকারী সৈন্যদের দেখেও তিনি চিন্তিত হননি। বনূ ক্বোরায়যার বিশ্বাসঘাতকতার সংবাদ শুনেছেন। তাঁর নূরানী চেহারায় হতাশার কোন ছাপ পড়েনি। মুনাফিক্বগণ নানা ধরনের বাহানা–অজুহাত দেখিয়ে পলায়ন করছিলো। তবুও তিনি মোটেই চিন্তিত হননি। এসব অকথ্য অবস্থায়ও দৃঢ় প্রতিজ্ঞা ও দৃঢ় প্রতিষ্ঠার অজেয় পর্বত হয়ে দাঁড়িয়ে ছিলেন তিনি। প্রতিটি কদমে সাহাবা–ই কেরামের মনোবলকে চাঙ্গা রেখেই যাচ্ছিলেন। মুনাফিক্বদের দিকে শুধু তাকাচ্ছিলেন এবং শত্রুদেরকে আতঙ্কিত করার কোন ব্যবস্থাই বাদ দেননি। তাছাড়া, রণক্ষেত্রে ও রাজনৈতিক সব নিয়ম বজায় রেখে এমনসব গোপন ব্যবস্থাপনা করে যাচ্ছিলেন যে, শত্রুরা নিজেদের মধ্যে বিবাদে জড়িয়ে পড়ছিলো, সর্বোপরি, তারা হামলা করতে এসে নিজেরাই অবরোধ তুলে নিতে বাধ্য হচ্ছিলো এবং তজ্জন্য একে অপরকে গালি পর্যন্ত দিয়ে যাচ্ছিলো এবং পরস্পর পরস্পরকে বিশ্বাসঘাতকতা ও বিশ্বাস ভঙ্গের অপবাদ দিয়ে পালিয়ে যাচ্ছিলো।
এমন পরিস্থিতিতে এ আয়াত শরীফ নাযিল হয়েছে। আর এরশাদ হয়েছে যে, এমন ভয়ানক অবস্থায় তোমরা আমার প্রিয় রসূল সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়া সাল্লাম–এর রণকৌশল ও কর্মপদ্ধতি দেখে নিয়েছো– এটা কতোই সততা, সত্যতা, নিষ্ঠা ও লিল্লা–হিয়্যাতের রঙে রঞ্জিত ছিলো! এটাই তোমাদের জীবনের প্রতিটি মোড়ে তোমাদের জন্য এক অতি সুন্দর নমুনা। তাঁর কদমের নকশাকে যাত্রাপথের সঠিক দিশারী বানিয়ে নাও আর হুযূর–ই আকরামের স্নেহপূর্ণ আঁচলকে আঁকড়ে ধরো। নিশ্চিত ভাবে গন্তব্যস্থলে পৌঁছে যাবে।
বিশ্ব–ইতিহাস পাঠ–পর্যালোচনা করলে জানা যায় যে, জীবনের বিভিন্ন সোপানে বড় বড় সফল ও বিশাল ব্যক্তিত্বের মানুষ অতিবাহিত হয়েছেন, কিন্তু যখনই সরওয়ার–ই ‘আলমিয়াঁ– সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়া সাল্লাম–এর পবিত্র সত্ত্বার কথা আসে, তখন এই রসূল সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়া সাল্লাম–এর চলার পথের ধূলির স্মরণে বলতে হয়– ‘ছেহ্ নিসবৎ খাক রা বা ‘আলমে পাক’ (পবিত্র জগতের সাথে এ মাটির কী সম্পর্ক থাকতে পারে?)
ড. হামীদ উল্লাহ্ হুযূর সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়া সাল্লাম–এর ব্যাপক উস্ওয়াহ্ বা আদর্শের আলোচনা করতে গিয়ে বলেছেন,“দুনিয়ার মধ্যে কোন এক দিকের বিবেচনায় বড় লোকের কমতি নেই, কিন্তু যদি আমরা সেকান্দর–ই আ’যম, নেপোলিয়ন ও হিটলারের কথা বলি, তবে তাদের জীবন শুধু একজন যুদ্ধের সিপাহ্ সালার ও দেশ বিজয়ীর জন্য পাঠ–পর্যালোচনার উপযোগী। গৌতম বুদ্ধ একজন সংসারত্যাগী ও হোমার একজন কবি ছিলেন, প্লেটো ও এ্যারিস্টোটল শুধু জ্ঞানী ও দার্শনিক ছিলেন। জীবনের অন্য কোন বিভাগে তাঁদের কোন অবদান নেই। পক্ষান্তরে, যদি আমরা রসূলে আকরাম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়া সাল্লাম–এর আদর্শ জীবনের দিকে দেখি, তবে তাঁকে প্রতিটি দিক দিয়ে অতুলনীয় হিসেবে দেখা যায়।
রসূলে আকরাম একজন রাজনীতিবিদের জন্য উত্তম আদর্শ। রাজনীতিবিদ হিসেবে দেখুন! তিনি মাত্র দশ বছরের সংক্ষিপ্ত সময়ের মধ্যে গোটা আরব ব–দ্বীপে, যেখানে গোত্রগুলোর মধ্যে শুধু গৃহযুদ্ধই চলতো, সেখানে এক সুপ্রশস্ত ও মজবুত ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করে দিয়েছেন। মাত্র দশ বছরে ১২লক্ষ বর্গমাইলের একটি ভূ–খণ্ড আনুগত্য প্রকাশ করেছে।
এটা হুযূর্–ই আকরাম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়া সাল্লাম–এর শিক্ষা ও প্রশিক্ষণের সুফলই ছিলো যে, আরবের মতো পড়াবিহীন ও অখ্যাত জাতি আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে যখন সর্বপ্রথম পা রেখেছিলো, তখন তাদের থেকে বেশী সভ্য কোন জাতি রাজ্য বিজয়ের জন্য বের হয়নি। রাজ্য বিজয়ের প্রশস্ততা ও গভীরতার যেই রেকর্ড তাঁরা কায়েম করেছেন, তা আজ পর্যন্ত কোন জাতি বা জনগোষ্ঠী ভাংতে পারেনি। সুতরাং পরবর্তী দশ বছরের মধ্যেই তাঁরা ইরাক, ইরান, ফিলিস্তীন, সিরিয়া, মিশর, ত্রিপলী, তিউনিস, তুর্কিস্তান ও আর্মেনিয়াকে করায়ত্ত করে নিয়েছেন। এসব অঞ্চল এখনো মজবুত ইসলামী অঞ্চলই । আর তাদের অধিকাংশের ভাষাও আরবী হয়ে গেছে।
হুযূর–ই আকরাম একজন সুব্যবস্থাপকের জন্য আদর্শ
ব্যবস্থাপনার দিকে দেখলে দেখা যাবে যে, যেই রাজ্যে কোন হুকূমতই কায়েম হয়নি, তাতে লালিত–পালিত হওয়া স্বত্ত্বেও আঁ–হযরত সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়া সাল্লাম যেই রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থা কায়েম করেছেন, তা অনুসারে আমল এক বিশাল রাষ্ট্রের জন্য সব দিক দিয়ে শুধু কল্যাণকর ও যথেষ্ট প্রমাণিত হয়নি, বরং যতদিন পর্যন্ত সেটা অনুসারে কাজ হতে থাকে, ততদিন পর্যন্ত তা একটি সভ্যতম শাসনব্যবস্থা হয়েই থাকে। গান্ধির মতো কট্টরপস্থি হিন্দুও সেটাকে মানবতার সোনালী যুগ বলে মনে করেছেন। আর কংগ্রেসপন্থী হিন্দু রাষ্ট্রগুলোকে পরামর্শ দিতে থাকেন যেন সেটাকেই নিজেদের জন্য নমুনা হিসেবে গ্রহণ করে।
একজন সামাজিক শিক্ষকের জন্য উত্তম আদর্শ
সামাজিক ও চারিত্রিক দিক দিয়েও হুযূর–ই আকরামের মহান জীবন এমন বিরল নমুনা যে, তিনি কাউকে কিছু শিক্ষা দেয়ার পূর্বে তা নিজেই আমল করে দেখাতেন। অন্য কাউকে যতটুকু আমল করতে বলতেন তার চেয়ে বেশী নিজে আমল করতেন। একজন পিতা, একজন স্বামী, একজন বন্ধু একজন শাসক, একজন ব্যবসায়ী, একজন মানুষ হিসেবে তাঁর কাজ এতই নিষ্কলুষ, আলোকিত ও অনুকরণযোগ্য যে, একজন কট্টর শত্রুও এর প্রশংসা না করে পারেনা।*
(ড. হামীদুল্লাহ্ কৃত রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু তা‘আলা
আলায়হি ওয়া সাল্লাম–এর রাজনৈতিক জীবন)
ভাষান্তর : মাওলানা মুহাম্মদ আবদুল মান্নান, মহাপরিচালক–আনজুমান রিসার্চ সেন্টার, চট্টগ্রাম।