প্রবীণরা আমাদের অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়েও তারা অবহেলিত। তাই জাতিসংঘ বার্ধক্যকে মানব জীবনের প্রধানতম চ্যালেঞ্জ হিসেবে উল্লেখ করে প্রবীণদের সুরক্ষা এবং অধিকার নিশ্চিতের পাশাপাশি বিশ্বব্যাপী ব্যাপক গণসচেতনতা সৃষ্টির লক্ষ্যে ১৯৯০ সালে জাতিসংঘ প্রতি বছর ১ লা অক্টোবর আন্তর্জাতিক প্রবীণ দিবস ঘোষণা করে এবং প্রতিবছর বিশ্বব্যাপী তা পালন করা হয়। বাংলাদেশেও এর ব্যতিক্রম নয়। জাতীয় ও আন্তর্জাতিক উন্নয়ন আলোচ্য সূচিতে বার্ধক্য ইস্যুটি গুরুত্বের সঙ্গে স্থান পায়। জাতিসংঘ এশিয়া–প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের জন্য ৬০ বছর ও তদূর্ধ্ব; উন্নত বিশ্বের জন্য ৬৫ বছর বয়সীদের প্রবীণ হিসাবে চিহ্নিত করা আছে, বাংলাদেশ সরকার ৬০ বছর ও তদূর্ধ্ব সিনিয়র সিটিজেন হিসাবে মর্যাদা দিয়েছেন। পরিসংখ্যানে দেখা যায় বাংলাদেশ আগামী ২০২৫ সাল নাগাদ প্রবীণদের সংখ্যা ১ কোটি ৮০ লক্ষ পৌঁছে যাবে। যদিও আমাদের দেশে কোনো সরকারের আমলে সিনিয়র সিটিজেনরা মর্যাদা পায় না। কোনো প্রকার সুযোগ সুবিধাও পায় না। ‘মরিতে চাহি না আমি সুন্দর ভূবনে/ মানবের মাঝে আমি বাঁচিবারে চাই/এই সূর্যকরে পুষ্পিত কাননে / জীবন্ত হৃদয়–মাঝে যদি স্থান পাই’। কবি বলে গেছেন আমরা যারা আজ বৃদ্ধ কিন্তু আমাদের প্রাণ আছে। তাই যতক্ষণ প্রাণ আছে ততক্ষণ এ পৃথিবীর এই সূর্যকরে কাননের রূপ রস গন্ধ সমস্ত ভোগ করার অধিকার আমাদের আছে। তাই যতক্ষণ জীবন ধারণ করবেন ততক্ষণ তাঁকে আনন্দে বেঁচে থাকার উপযুক্ত ব্যবস্থা করে দিতে হবে। হয়ত মানব জীবনের ন্যাচারাল কোর্সে শারীরিকভাবে প্রবীণরা অনেক কিছুতেই অসমর্থ তবুও পরিবারের কাউকে না কাউকে প্রবীণদের জীবন ধারণের দায়িত্ব নিতে হবে। প্রবীণদের বলবো তবুও ‘আমরা মনের শক্তিতে বলিয়ান হয়ে বলবো যৌবন আমার চিরদিনকার’। তবুও প্রবীণদের বলবো সহায় সম্বলহীন নিঃস্ব হবেন না। যতক্ষণ অর্থসম্পদ নিজের হাতে থাকে, পরিবারের বা সন্তানদের কাছে আর আপনি এখনও মর্যাদা পাবেন–অবহেলার পাত্র হবেন না। আবার বলতে ইচ্ছে হয় প্রবীণরা সমাজে ও পরিবারের বোঝা নয়–সম্পদ। রাষ্ট্র, সমাজে, পরিবারে রয়েছে প্রবীণদের অমূল্য অবদান, তাদের প্রজ্ঞা, অভিজ্ঞতা ও কর্মময়তা সব সময়ের জন্য প্রাসঙ্গিক। তারপরেও বর্তমান সমাজ ও পারিবারিক জীবন ধারা পরিবর্তনের ফলে প্রবীণদের প্রতি নেমে আসে অবহেলা ও দুর্ব্যবহার। ‘জাতীয় কবি বলেছেন ‘ঘুমিয়ে আছে শিশুর পিতা সব শিশুদের অন্তরে’, অর্থাৎ আজ শিশু সে ধীরে ধীরে প্রবীণ মানুষে পরিণত হবে। কথায় আছে অতীত না হলে বর্তমান সুন্দর হয় না। প্রাচীন না হলে আধুনিক হওয়া যায় না। সুতরাং প্রবীণদের প্রতি যত্নশীল হওয়া খুবই দরকার। বর্তমান সময়ে চিকিৎসা বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে আশাতীত সাফল্য এবং সাধারণ মানুষের মধ্যে স্বাস্থ্য সচেতনতা বৃদ্ধি ও সর্বোপরি আর্থিক অবস্থার উন্নতির ফলে দেশে দেশে ষাটোর্দ্ধ মানুষের সংখ্যা বাড়ছে। আমাদের দেশে মানুষের গড় আয়ু বাড়ছে। এখন ৭৩ বৎসর। কিন্তু প্রবীণদের সংখ্যা বাড়ার সাথে সাথে তাদের সুরক্ষার জন্য সরকারি বেসরকারি বা ব্যক্তি পর্যায়ে তেমন প্রস্তুতি নেই।
জাপান খুবই উন্নত একটা দেশ। খবরে প্রকাশ সে দেশে নিঃসঙ্গ অবস্থায় ৪০ হাজার মানুষের মৃত্যু ঘটেছে। সে দেশে দিন দিন প্রবীণদের সংখ্যা বাড়ছে। কারণ জাপানে জন্মহার কমেছে। দেশটির অনেক মানুষই বিয়ে করেন না। ফলে শেষ বয়সে তাদের দেখার মতো কেউই থাকে না। তাদের একাকিত্ব জীবন বয়ে আনে নিঃসঙ্গতা, রোগে জর্জরিত সেবা শুশ্রূষা বঞ্চিত। এমনকি নিয়মিত খাদ্য পায়না। ধীরে ধীরে কঙ্কাল সার হয়ে ঘরের এককোণে মরে থাকে। মৃতদেহ মাসের পর মাস পড়ে থাকে, দুর্গন্ধ বের হয়। সেদেশের পুলিশ বলছে (২০২৪ সাল) চলতি বছরে প্রথম ছয়মাসে বাড়িতে একা থাকা ৩৭ হাজার ২২৭ জনকে মৃত অবস্থায় বাড়ির ভেতর পাওয়া গেছে, এই সংখ্যার মধ্যে ৪০ শতাংশ মৃত্যুর একদিন পর উদ্ধার করা হয়েছে। ১৩০ জনের মৃত দেহ উদ্ধার করা হয়েছে একবছর পর। এদিক দিয়ে চিন্তা করলে আমাদের দেশের প্রবীণরা অনেক অনেক ভালো আছে।
আমাদের দেশে দুই একটা ঘটনা ছাড়া তেমন মর্মান্তিক কোনো ঘটনা ঘটে না। আমাদের দেশে যে ঘটনাগুলো ঘটছে সেই গুলোর বেশির ভাগ, মধ্যবিত্ত ও উচ্চমধ্য বিত্তের মধ্যে আর অসহায় গরীবদের মধ্যে ঘটছে। বৃদ্ধাশ্রমের অনেক করুণ কাহিনি বলে শেষ করা যায় না। চোখে জল আসে, খুবই দুঃখ লাগে তখনি যখন শিক্ষিত ছেলেরা মোটামুটি সচ্ছল থাকা সত্ত্বেও মা, বাবাকে বৃদ্ধাশ্রমে পাঠায়। এমনকি তাদের পিতামাতা চোখের পানি ফেলতে ফেলতে দিনের পর দিন রাস্তার পানে চেয়ে থাকে কখন তাঁর ছেলে বা মেয়ে তাদের একটু দেখতে আসবে। নাতি নাতনিদের তাদের দেখাবে। তাদের দীর্ঘশ্বাস কখনো ফুরাবে না। খুবই উৎসাহব্যঞ্জক আমাদের সিনিয়র সিটিজেন সোসাইটি চট্টগ্রাম শাখা সংগঠনকে সচল রাখার জন্য নিয়মিত মত বিনিময় সভা করেন। বাৎসরিক অনুষ্ঠান করেন। এবার স্মরণকালের বন্যাদুর্গতদের সাহায্য ত্রাণ তহবিল গঠন করেছেন। তাতে ভালো সাড়া পাওয়া গেছে। প্রবীণ সদস্যদের পরিচয়পত্র আছে। আজীবন সদস্যদের আই, ডি, কার্ড দেওয়া হয়েছে। প্রবীণরা স্বল্প খরচে উন্নত চিকিৎসা পাওয়ার ব্যবস্থা হয়েছে। ডায়াগনস্টিক সেন্টার ও ক্লিনিকের সাথে সম্পৃক্ততা ও যোগাযোগ বজায় রাখছে। এই মুহূর্তে একটা দাবী–আমাদের প্রচার দরকার। তাই টেলিভিশন ও সামাজিক মিডিয়াতে প্রবীণদের জন্য অনুষ্ঠান বাধ্যতামূলক করতে হবে, ‘ওগো প্রবীণ চলো এবার সকল কাজের শেষে নবীন হাসি মুখে নিয়ে চরম খেলার শেষে’।
লেখক: প্রাক্তন চিফ অ্যানাসথেসিও লজিস্ট,
বাংলাদেশ রেলওয়ে হাসপাতাল, চট্টগ্রাম।