আন্তর্জাতিক পর্যটকদের আকৃষ্ট করতে পর্যটন শিল্পকে ঢেলে সাজাতে হবে

শেখ মনোয়ার হাসান | বুধবার , ২৭ সেপ্টেম্বর, ২০২৩ at ৭:৫৯ পূর্বাহ্ণ

আজ ২৭ সেপ্টেম্বর বিশ্ব পর্যটন দিবস। বিশ্ব পর্যটন দিবসের এবাবের প্রতিপাদ্য বিষয় হচ্ছে ‘পর্যটন ও সবুজ বিনিয়োগ’। পর্যটন মানুষের প্রাচীনতম সখ এবং পর্যটনকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠে ব্যবসায়বাণিজ্য। আজ এই একুশ শতকে ডিজিটাল সংস্কৃতির ছোঁয়ায় পর্যটন এক বৈচিত্র্যময় শিল্পের রূপ লাভ করেছে। পর্যটন বিশারদগণ বলেন, পর্যটন হচ্ছে পৃথিবীর একক বৃহত্তম শিল্প। কোনও কোনও রাষ্ট্রের ক্ষেত্রে এটি SingelEconomic Boster হিসাবে কাজ করে যেমন সাইপ্রাস, মালদ্বীপ ও থাইল্যান্ড ইত্যাদি দেশের নাম উল্লেখযোগ্য। দেউলিয়া শ্রীলংকা শুধুমাত্র এই পর্যটন দিয়েই তাদের অর্থনৈতিক সংকট মোকাবেলা করছে। বাংলাদেশ থেকে গৃহীত ঋণ ইতিমধ্যে পরিশোধ করেছে। সৌদি আরবের মত দেশও পর্যটনে বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগের মাষ্টার প্ল্যান নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে। আরব আমিরাত দুবাইতে পারস্য উপসাগরে যে পাম সিটি গড়ে তুলেছে তা দেখার জন্য প্রতি বছর লাখ লাখ পর্যটক সেখানে যায়। শুধু কি তাই! বুর্জ আল আরব এর মত বহুতল ভবনটিও যেন পর্যটন আকর্ষণের অন্যতম স্থান। আমাদের প্রতিবেশী দেশ ভারত কন্যা কুমারি থেকে কাস্মীর পর্যন্ত পর্যটন শিল্পকে ঢেলে সাজিয়েছে এবং পর্যটন থেকে ভারত প্রতি বছর বিলিয়ন ডলার আয় করে। প্রথাগত ট্যুরিজম ছাড়াও মেডিক্যাল, শিক্ষা ও ধর্মীয় পর্যটন থেকে ভারত প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা আয় করে। বাংলাদেশের পর্যটন শিল্পও অনেক এগিয়ে গেছে। এখন বাংলাদেশের পর্যটন আর গতানুগতিক পাহাড় এবং সমুদ্রের মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই। প্রতিনিয়ত পর্যটনের নতুন নতুন ক্ষেত্র তৈরী হচ্ছে। এমনকি গরীবেরও পর্ণকুটিরও একজন আদর্শ পর্যটকের নিকট পর্যটন স্পট হিসাবে পরিণত হয়েছে। বিগত দশ বছরে বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ পর্যটন শিল্প একটা এৎবধঃ খবধঢ় বা মহা উল্লম্ফন দিয়েছে। এই ফেইসবুকইউটিউবের যুগে মানুষ বাড়ির পাশে সবুজ ধান ক্ষেতে বেড়াতে গিয়েও সেল্ফি কিংবা ভিডিও কনটেন্ট আপলোড দেয়। যদিও একটি দেশের পর্যটন শিল্পের টার্গেট গ্রুপ হচ্ছে বিদেশী পর্যটক কিন্তু বাংলাদেশে বিদেশী পর্যটক আগমনের হার অত্যন্ত হতাশাব্যঞ্জক। এটার কারণ হচ্ছে আমরা বাংলাদেশের পর্যটন শিল্পের ইউনিক প্রোডাক্ট কোনটি সেটি নির্ধারণ করে প্রমোট কিংবা ব্র্যান্ডিং করতে পারি নাই। আমরা কক্সবাজারকে প্রমোট করি পৃথিবীর দীর্ঘতম অখণ্ড বালুকাময় সমুদ্র সৈকত হিসেবে। এটা আসলে একটা রেটরিক্যাল বয়ান। এই প্রচার দিয়ে আসলেই কি বিদেশী পর্যটক টানা যাবে? যেমন একজন বিদেশী পর্যটক ভারতে এসে বঙ্গোপসাগর, আরব সাগর কিংবা ভারত মহাসাগর দেখার পর শুধুমাত্র সাগর দেখার জন্যে কক্সবাজার বা পটুয়াখালীতে আসবে না। তারপর যদি তারা শুনে যে, কক্সবাজাররের সমুদ্র সৈকতে ভ্রমণরত যুগল থেকে বৈধতা যাচাইয়ের জন্য বিয়ের কাবিন চাওয়া হয় তখন তারা আসার ন্যুনতম ইচ্ছাটাও হারিয়ে ফেলবে। এতে বুঝা যায় পেশাদারিত্বের দিক থেকে আমাদের পর্যটন শিল্প কতটুকু পিছিয়ে আছে। এরপর কক্সবাজারে বিদেশী পর্যটকদের জন্য কোনও ধরনের বীচ স্পোর্টস বা রাত্রিকালীন বিনোদনের ব্যবস্থা নেই। তাছাড়া বিদেশী পর্যটকরা একটু নির্জনতা পছন্দ করে অথচ কক্সবাজারে অবকাশ যাপনের যে হোটেল রিসোর্টগুলো গাদাগাদি করে গড়ে উঠেছে। পৃথিবীতে এখন সুবজ ও টেকসই পর্যটনকে প্রমোট করা হচ্ছে অথচ আমাদের একমাত্র প্রবাল দ্বীপ সেন্টমার্টিন ইটের দালানের ভারে ন্যুব্জ। আমাদের ইউনিক একটা প্রোডাক্ট হচ্ছে সুন্দরবন কারণ এটি পৃথিবীর বৃহৎ ম্যানগ্রোভ বন এবং বিখ্যাত রয়েল বেঙ্গল টাইগারের বাস এই বনে। তাই সুন্দরবনকে বিশ্বের পর্যটকদের কাছে তুলে ধরার জন্য সব ধরনের পদক্ষেপ নিতে হবে। সেখানে সবধরনের পর্যটন সুবিধাদি প্রবর্তন করতে হবে। তাছাড়া সেখানে নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করতে হবে। প্রয়োজনে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে দিয়ে চিরুনি অভিযান পরিচালনা করে সুন্দরবনকে সম্পূর্ণভাবে জলদস্যু মুক্ত করতে হবে।

আমাদের আরো একটি ইউনিক প্রোডাক্ট হচ্ছে আমাদের গ্রামের মানুষের জীবনযাত্রা। একাডেমিক্যালি এটাকে এথনিক ট্যুরিজম নামে অবিহিত করা হয়। ইতিমধ্যে কিছু কিছু বিদেশী পর্যটক এথনিক ট্যুরিজমের স্বাদ নিতে বাংলাদেশে এসেছে। তবে এখানেও নিরাপত্তা ও সুযোগ সুবিধার বিষয়টি জড়িত। এছাড়া গ্রামে যারা পর্যটকদের গাইডিং করেন তাদেরও পেশাদারীত্বের অভাব রয়েছে। সরকারকে এসব বিষয়গুলোর উপর নজর দিতে হবে। আমাদের যে অভ্যন্তরীণ পর্যটকরা আছেন তারাও বিভিন্ন স্থানে বেড়াতে গিয়ে স্থানীয় মানুষ কর্তৃক হয়রানির শিকার হন। কক্সবাজারের প্রাইভেট হোটেল রিসোর্টগুলো পিক টাইমে যার থেকে যেভাবে পারে রুম ভাড়া আদায় করে। সমুদ্র সৈকতে কিছু ধান্দাবাজ লোক থাকে এরা সাধারণ পর্যটকদের নানাভাবে হয়রানি করার চেষ্টা করে। সরকারকে এগুলো কঠোর হস্তে দমন করতে হবে। বর্তমানে বাংলাদেশের তরুণদের কাছে এডভেঞ্চার ট্যুরিজম খুব জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে যেমন তারা গভীর অরণ্যে চলে যায়, পাহাড়ে ট্র্যাকিং করে কিংবা ঝর্নার ধারে ক্যাম্পিং করে। তবে এখানে কিছু ঝুঁকিও আছে সরকারকে সে ব্যাপারে সজাগ থাকতে হবে। বুটক্যাম্পিং ট্রেইনিং এর মাধ্যমে পর্যটন স্থানের স্থানীয় যুবকদের থেকে দক্ষ ট্যুরগাইড তৈরী করতে হবে। বর্তমান সরকার জিডিপিতে পর্যটন শিল্পের অবদান ১০% উন্নীত করতে বদ্ধপরিকর। এটার জন্য সরকারকে পর্যটন সুবিধাদি ও অবকাঠামো খাতে বড় বিনিয়োগ করতে হবে। পাশাপাশি বড়বড় কর্পোরেটদের এখাতে বিনিয়োগে উৎসাহিত করতে হবে। এছাড়া সবচেয়ে কার্যকরী বিনিয়োগ হচ্ছে সামজিক মাধ্যমে বিনিয়োগ। এখানে এক টাকা বিনিয়োগ করলে একশত টাকা রিটার্ন আসবে। বাংলাদেশের যেসব ট্রাভেল ব্লগার আছে তাদের মধ্যে টপ রেটারদেরকে দিয়ে ট্রাভেল কন্টেন্ট তৈরী করে ফেসবুকইউটিউবে পর্যটনের ডিজিটাল মার্কেটিং করতে হবে এবং বিদেশী যে সব ট্রভেল ব্লগার আছে যেমন লিউক ডামান্ট, দাউদ কিম, কিংবা অমিত আগরওয়ালদের হায়ার করে বাংলাদেশের পর্যটন শিল্পের প্রচারণা চালানো যেতে পারে। সর্বোপরি সরকারকে পর্যটন শিল্প নিয়ে একটা মাস্টারপ্ল্যান করে তা বাস্তবায়ন করতে হবে এবং ঢেলে সাজাতে হবে সেন্টমার্টিন থেকে বাংলাবান্ধা পর্যন্ত বিস্তৃত বাংলাদেশের পর্যটন শিল্পকে।

লেখক : নির্বাহী কর্মকর্তা, বাংলাদেশ পর্যটন করপোরেশন

পূর্ববর্তী নিবন্ধজাতীয় মাছ
পরবর্তী নিবন্ধমুকুট মণি জননেত্রী শেখ হাসিনা