আন্তর্জাতিক নার্স দিবস ২০২৫ : সেবার ছায়ায় লড়াইয়ের প্রতিচ্ছবি

ফজলুল কবির মিন্টু | সোমবার , ১২ মে, ২০২৫ at ৯:৫৩ পূর্বাহ্ণ

আজ আন্তর্জাতিক নার্স দিবস। বিশ্বব্যাপী এই দিনটি পালিত হয় আধুনিক নার্সিং পেশার পথিকৃৎ ফ্লোরেন্স নাইটিঙ্গেলের জন্মদিন উপলক্ষে। ১৮২০ সালের এই দিনে জন্মগ্রহণকারী এই মানবিক নারী প্রমাণ করে গেছেন যে, নার্সিং একটি পেশা নয় এটি নিঃস্বার্থ সেবার নীরব সংগ্রাম। এই দিবসে তাই কৃতজ্ঞচিত্তে শ্রদ্ধা জানানো হয় তাঁকে এবং সেই সব নার্সদের, যারা প্রতিদিন নিজেদের কষ্ট ভুলে রোগীর মুখে আশার আলো ফেরানোর দায়িত্ব পালন করেন। তবে দুঃখজনক বাস্তবতা হলো, বাংলাদেশে এই মহান পেশাটি এখনও তার যোগ্য সম্মান এবং মর্যাদা পায়নি। নার্সদের অবদান সর্বজনবিদিত হলেও, এই পেশাকে এখনো সামাজিকভাবে মর্যাদাপূর্ণ পেশা হিসেবে গণ্য করা হয় না। অথচ একটি দেশের স্বাস্থ্যসেবার ভিত্তিই গড়ে ওঠে দক্ষ, যত্নশীল ও পেশাদার নার্সদের কাঁধে ভর করে।

নার্স সংকট : পরিসংখ্যানের আড়ালে চাপের গল্প: বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার গাইডলাইন অনুযায়ী, একজন চিকিৎসকের বিপরীতে তিনজন নিবন্ধিত নার্স থাকা প্রয়োজন। অথচ ২০২৪ সালে নার্স দিবসে প্রকাশিত তথ্যমতে, বাংলাদেশে ১ লাখ ৩৬ হাজার নিবন্ধিত চিকিৎসকের বিপরীতে রেজিস্টার্ড নার্স রয়েছেন মাত্র ৯৫ হাজার ১৬৮ জন। এই হিসেবে দেশে আরও অন্তত ৩ লাখ ১২ হাজার ৮৩২ জন নার্সের প্রয়োজন রয়েছে। এই ঘাটতির ফলাফল স্বরূপ আমরা দেখতে পাই, হাসপাতালগুলোতে নার্সদের উপর অসহনীয় কাজের চাপ। এই চাপ একদিকে যেমন রোগীর সেবার মানে ঘাটতি ঘটায় তেমনি নার্সদের মানসিক ও শারীরিক অবসাদ তৈরি করে।

বেতন কাঠামো ও শ্রমের মূল্যায়ন:সেবা’র পেশায় শোষণের শিকার? বাংলাদেশের শ্রম আইন ও আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা (ILO) কনভেনশন ১ অনুযায়ী একজন শ্রমিকের দৈনিক কর্মঘণ্টা ৮ ঘণ্টা নির্ধারিত। কিন্তু বাস্তবে নার্সদের কাজের সময় এই সীমা অতিক্রম করে যায়। অনেক নার্সকে একই প্রতিষ্ঠানে দিনে ২ শিফটে কাজ করতে হয় কিংবা দুটি আলাদা প্রতিষ্ঠানে পালাক্রমে কাজ করতে হয় শুধুমাত্র জীবন ও জীবিকার লড়াই এ টিকে থাকার জন্য। কারণ বর্তমান দুর্মূল্যের বাজারে তাদের বেতন এতটাই কম যে, শুধুমাত্র এক চাকরির উপর নির্ভর করে সংসার চালানো প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়ে।

এভাবে নার্সদের ‘সেবা’র আবেগ এবং বেকারত্মকে পুঁজি করে যেভাবে ‘শ্রম’কে অবমূল্যায়ন করা হচ্ছে, এ যেন সেবামূলক ও মহৎ পেশায় যুক্ত হয়ে তারা এক ধরনের প্রাতিষ্ঠানিক শোষণের শিকার হচ্ছে। ফলে পেশাগত দক্ষতা ও মানসিক প্রস্তুতির অভাব ঘটছে, যা শেষ পর্যন্ত রোগীদের জন্যও ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়াচ্ছে।

প্রশিক্ষণ ও স্বীকৃতির সংকট: অতীতে যারা নার্সিং পেশায় যুক্ত হয়েছেন, বিশেষ করে ৮০ ও ৯০ দশকের এইড নার্সরা, তাদের অনেকেরই কোনো স্বীকৃত প্রশিক্ষণ সনদ নেই। অথচ তারা বছরের পর বছর চিকিৎসকদের সহকারী হিসেবে কাজ করে দক্ষতা অর্জন করেছেন। আজ তাদের অনেকেই চাকরিচ্যুতির ভয় নিয়ে দিন কাটান। সনদ না থাকার অজুহাতে তাদের চাকরি হারানোর ঘটনা বাড়ছে। এই অবস্থায় চট্টগ্রাম বেসরকারি স্বাস্থ্য প্রতিষ্ঠান কর্মচারী ইউনিয়ন তাদের পাশে দাঁড়িয়েছে এবং জানিয়ে দিয়েছে, যদি কেউ শুধুমাত্র সনদের অভাবে চাকরি হারায়, তবে তা প্রতিহত করা হবে।

নার্সিং শিক্ষা প্রতিষ্ঠান : যথেষ্ট কি?

বর্তমানে দেশে সরকারি নার্সিং ও মিডওয়াইফারি ইনস্টিটিউট আছে ৪৩টি এবং বেসরকারি ১২০টি। সরকারি নার্সিং কলেজ রয়েছে ১৭টি এবং বেসরকারি ৬০টি। সংখ্যায় এই প্রতিষ্ঠানগুলো বাড়লেও, কোর্স কারিকুলাম আধুনিকীকরণ, মানসম্পন্ন প্রশিক্ষণ, পর্যাপ্ত শিক্ষক এবং ইন্টার্নশিপ সুবিধার অভাবে কাঙ্ক্ষিত মানের পেশাদার নার্স তৈরি হচ্ছে না। নার্সিং শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বৃদ্ধি করে আরো বেশী সংখ্যক দক্ষ নার্স তৈরি করা গেলে দেশের চাহিদা মিটিয়ে তাদের বিদেশেও পাঠানো যেতে পারে। দক্ষ নার্সদের চাহিদা বিদেশেও প্রচুর রয়েছে। ফলে দক্ষ নার্স বিদেশে রপ্তানী করা গেলে প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের পথ সুগম হবে। যা দেশের অর্থনীতির ভিতকে মজবুত করতে সহায়ক ভূমিকা পালন করতে পারে।

বেসরকারি স্বাস্থ্যখাত ও নার্সদের ভবিষ্যৎ:বাংলাদেশে ৭০% স্বাস্থ্যসেবা এখন বেসরকারি খাতের মাধ্যমে হয়ে থাকে। এই খাত ৮০’র দশকে যাত্রা শুরু করলেও তখন নার্স তৈরির জন্য আলাদা কোনো ইনস্টিটিউশন ছিল না। তাই সে সময়ের নার্সদের বড় একটি অংশ চিকিৎসকদের অধীনে হাতেকলমে কাজ শিখেই পেশাগত জীবন শুরু করেছেন। তাদের অবদান আজও অনেক প্রতিষ্ঠানের ভিত্তি।

কিন্তু বর্তমান বাস্তবতায়, স্বীকৃত সনদ, পেশাগত মর্যাদা, জীবিকা নির্বাহে উপযুক্ত ও ন্যায্য বেতন এবং স্বাস্থ্যকর কর্মপরিবেশ ছাড়া এই পেশায় দক্ষ মানবসম্পদ ধরে রাখা সম্ভব নয়। এতে কেবল নার্সদের ক্ষতি নয়, সার্বিকভাবে দেশের স্বাস্থ্যসেবার মানও প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে পড়ে। তাই নার্সদের পেশাগত দক্ষতা ও মর্যাদা বাড়াতে স্বীকৃত সনদের গুরুত্ব রয়েছে। বর্তমানে চাকরিরত নার্সদের চাকরির নিশ্চয়তার বিধান করে ভবিষ্যতে নার্স নিয়োগের ক্ষেত্রে প্রত্যেকের স্বীকৃত সনদ থাকা বাধ্যতামূলক হওয়া বাঞ্চনীয়।

শেষ কথা:আন্তর্জাতিক নার্স দিবস কেবল একটি আনুষ্ঠানিকতা নয়, এটি একটি উপলক্ষ্য আমাদের সমাজ, রাষ্ট্র এবং নীতিনির্ধারকদের জন্য। এই দিনে শুধুমাত্র শ্রদ্ধা জানানো নয়, সময় এসেছে নার্সদের দীর্ঘদিনের অবহেলা ও বঞ্চনার প্রতিকারের জন্য কার্যকর পদক্ষেপ নেয়ার।

নার্স পেশাকে মর্যাদাপূর্ণ, সুরক্ষিত ও মানবিক করতে হলে চাই: সঠিক বেতন কাঠামো ও ওভারটাইম সুবিধা (শ্রম আইন অনুযায়ী সর্বোচ্চ ওভারটাইম ২ ঘণ্টা), বর্তমানে চাকরিরত সনদবিহীন অভিজ্ঞ নার্সদের চাকরির নিশ্চয়তার বিধান, আধুনিক কারিকুলাম ও নিয়মিত প্রশিক্ষণ সুবিধা, সুরক্ষিত ও সম্মানজনক কর্মপরিবেশ, আইনী সুরক্ষা ও কর্মঘণ্টা নিশ্চিতকরণ, নার্সদের পেশাগত স্বাস্থ্য ও নিরাপত্তার নিশ্চয়তার বিধান, নার্সদের সামাজিক নিরাপত্তা নিশ্চয়তার বিধান, এই পেশা যতটা সেবামূলক, ততটাই তা সামাজিক মূল্যায়নের দাবিদার।

নার্স মানেই শুধুমাত্র ‘সেবিকা’ নয় তারা এক একজন নীরব যোদ্ধা। তাদের অধিকার রক্ষা করা মানেই মানবতার রক্ষা করা।

লেখক: সংগঠক, কেন্দ্রীয় কমিটি, বাংলাদেশ ট্রেড ইউনিয়ন কেন্দ্র

পূর্ববর্তী নিবন্ধউপজেলার সদরের প্রাচীনতম মীরসরাই কলেজটি আজও বৈষম্যের শিকার, জাতীয়করণ দাবি
পরবর্তী নিবন্ধদক্ষিণ চট্টগ্রামে মুক্তিযুদ্ধের ক্যান্টনমেন্ট বরকল, শাহজাহান ইসলামাবাদী জিওসি