আন্তর্জাতিক নারী দিবস ও প্রাসঙ্গিক ভাবনা

অধ্যাপক লতিফা কবীর | সোমবার , ৮ মার্চ, ২০২১ at ৮:৩২ পূর্বাহ্ণ

৮ মার্চ আন্তর্জাতিক নারী দিবস। বাংলাদেশসহ বিশ্বের সব নারীকে নারী দিবসের শুভেচ্ছা ও অভিনন্দন। এ দিবসটি প্রতি বছরই আমাদের জীবনে বারে বারে ফিরে আসে। ৮মার্চ আন্দোলনরত নারীদের রাখী বন্ধন, কুশল বিনিময় ও সংহতি প্রকাশের দিন। এই দিনে নারীরা সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ভাবে কতদূর এগিয়েছে এবং সেই সাথে শান্তি, সমতা ও উন্নয়নের ক্ষেত্রে নারী আদৌ অগ্রসর হয়েছে কিনা তা নির্ণয় করার দিন। ১৮৫৭ সালে ৮মার্চ আমেরিকার নিউইয়র্ক শহরে সুতা কারখানায় কর্মরত বৈষম্যের শিকার নারী শ্রমিকেরা তাদের বেতন বৈষম্য, নির্দিষ্ট কর্মঘণ্টা, কাজের পরিবেশের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ ও ভোটের দাবী জানাতে একজোট হয়ে আন্দোলন করার জন্য রাস্তায় নামতে বাধ্য হয়। সেদিন আন্দোলনরত নারীদের উপর কারখানার মালিকেরা এবং তাদের মদদপুষ্ট প্রশাসন দমন – পীড়ন চালায়। ফলে দাবী নিয়ে নারীর অধিকার আদায়ের সংগ্রাম আরো বিকশিত হতে থাকে, নিউইয়র্ক শহরে প্রায় ১৫ হাজার নারী শ্রমিক মিছিল করে, প্রায় অর্ধ-শতাব্দীর পর ১৯০৮ সালে জার্মানিতে এ দিনটির স্মরণে প্রথম নারী সম্মেলন হয়। ১৯১০ সালে ডেনমার্কের কোপেনহেগেনে অনুষ্ঠিত হয় দ্বিতীয় আন্তর্জাতিক নারী সম্মেলন। এই সম্মেলনে বিশ্ব সমাজতান্ত্রিক আন্দোলনের নেত্রী ক্লারা জেটকিন আন্তর্জাতিক নারী দিবস উদযাপনের ধারণাটি উথাপন করেন। তিনি প্রস্তাব করেন, নারীর অধিকার আদায়ের লক্ষ্যে বছরে একটি দিন নারী দিবস হিসেবে বিশ্বের প্রতিটি দেশ উদযাপন করবে। এই সম্মেলনে ১৭টি দেশের একশরও বেশী নারী প্রতিনিধি উপস্থিত ছিলেন এবং প্রত্যেকেই একমত হয়েছিলেন। এভাবে নারীদের জন্য বছরে একটি বিশেষ দিন আন্তর্জাতিক নারী দিবস পালনের সূচনা ঘটে। ১৯৭৪ সালে জাতিসংঘ ৮ মার্চকে আন্তর্জাতিক নারী দিবস হিসাবে স্বীকৃতি দেয়। বিশ্বের অনেক দেশে আন্তর্জাতিক নারী দিবস আনুষ্ঠানিক ভাবে সরকারি ছুটির দিন হিসাবে পালিত হয় প্রথম থেকেই। অত্যন্ত পরিতাপের বিষয় এই যে, নারী দিবসের ঘোষণার শতবর্ষ পার হয়েছে বহু পূর্বে কিন্তু এখনও পর্যন্ত বিশ্বের সব দেশে আন্তর্জাতিক নারী দিবসকে সরকারি ছুটির দিন হিসেবে ঘোষণা করা হয়নি। বাংলাদেশসহ বিশ্বের সবদেশ ৮মার্চকে সরকারি ছুটির দিন হিসেবে ঘোষণা দিলে বিশ্বের সবদেশে সব নারীরা একযোগে আন্তর্জাতিক নারী দিবস পালন করতে পারতো। এদিন বিশ্বের অনেক দেশের নারীরা ঘরে থাকে না তারা হাতে ফুল নিয়ে ও সুন্দর পোশাক পরে সারাদিন ঘরের বাহিরেই সময় কাটায়। পরস্পরকে ফুল বিনিময় করে – কুশল বিনিময় করে। সেদিন পুরুষ ভাইয়েরা বাসায় থেকে ঘরের সব কাজকর্ম করে থাকে। বাংলাদেশ সরকারও যদি ৮মার্চ আন্তর্জাতিক নারী দিবসকে সরকারি ছুটির দিন হিসাবে ঘোষণা করতো তাহলে বাংলাদেশের নারীরাও এই দিবসটিকে যথাযোগ্য মর্যাদার সাথে পালন করতে পারতো। বাংলাদেশে সর্বপ্রথম আন্তর্জাতিক নারী দিবস পালিত হয় ষাটের দশকের শেষ দিকে গোপনভাবে সীমিত আকারে। নিষিদ্ধ বামপন্থী সংগঠন পূর্ব পাকিস্তানের কমিউনিস্ট পার্টির উদ্যোগে। ১৯৬৯সালে সর্ব প্রথম প্রকাশ্যে আন্তর্জাতিক নারী দিবস পালিত হয় পূর্বপাকিস্তানে মহিলা সংগ্রাম পরিষদের উদ্যোগে। এই মহিলা সংগ্রাম পরিষদ ১৯৭০ সাল ৪ এপ্রিল মহিলা পরিষদ নামে আত্নপ্রকাশ করে। সভাপতি হয়েছিলেন বাংলাদেশের নারী অধিকার ও নারী অগ্রযাত্রার অগ্রদূত কবি সুফিয়া কামাল। ১৯৭১ সালে দেশে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে নারী দিবস পালন করা সম্ভব হয়নি। দেশ স্বাধীন হবার পর ১৯৭২ সাল থেকে অদ্যাবদি মহিলা পরিষদ নিয়মিতভাবে নারীদিবস পালন করে আসছে। উল্লেখ্য, যে দেশ স্বাধীন হবার পর ঐতিহ্যবাহী এ নারী সংগঠনটির নামকরণ করা হয় বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ। বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ বর্তমানে ৫০ বছরে অতিক্রম করেছে। বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ আন্তর্জাতিক নারী দিবস পালনে প্রতি বছরই একটি স্লোগান গ্রহন করে। মহিলা পরিষদের এ বারের স্লোগান -“নারী নেতৃত্বের বিকাশ : সমতাপূর্ণ ভবিষ্যত গড়ার অঙ্গীকার” এই দিবসকে কেন্দ্র করে মহিলা পরিষদ নানা কর্মসূচী গ্রহণ করে থাকে যেমন – আলোচনাসভা, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান সমাবেশ মিছিল ইত্যাদি। এই সকল কর্মসূচিতে সমাজের প্রগতিশীল সকল শ্রেণী পেশার নারী পুরুষকে সম্পৃক্ত করা হয়। স্বাধীন বাংলাদেশে ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ সর্বপ্রথম ৮ মার্চ আন্তর্জাতিক নারী দিবস পালন করে। এই অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন মহিলা পরিষদের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি কবি সুফিয়া কামাল। নারী আন্দোলনের মধ্য দিয়ে নারীর অবস্থার অনেক পরিবর্তন হয়েছে। দীর্ঘ ও অবিরাম সংগ্রামের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের নারীসমাজ ধীরে ধীরে সামনের দিকে এগিয়ে চলেছে। বাংলাদেশের সংসদের দিকে তাকালে আমরা দেখতে পাই প্রধানমন্ত্রী নারী, বিরোধী দলের নেতা নারী ও স্পিকার নারী। প্রায় ৩০ বছর ধরে বাংলাদেশের নারী প্রধানমন্ত্রী দেশ পরিচালনা করছেন। বিশ্বের অন্যকোন দেশে এরকম উদাহরণ নাই। এ কারণেই আমাদের দেশের নারীর অবস্থান কিছুটা উন্নত। নারীরা এখন আর নারী নাই। তারা মানুষ হিসাবে মাথা উঁচু করে পুরুষের পাশাপাশি পরিবার সমাজ ও রাষ্ট্রের সকল গুরুত্বপূর্ণ কাজে অংশগ্রহণ করে সফলতা অর্জন করতে সক্ষম হয়েছে তা ইতিমধ্যে প্রমাণিত। আগে সন্তানের পরিচয় ছিল বাবার নামে। বর্তমানে আইন করে বাবা এবং মা উভয়ের নামের পরিচয়ে সন্তানরা পরিচিত হয়। নারীরা অন্দরমহল ভেদ করে চার দেয়াল থেকে বের হয়ে ইট ভাঙ্গা, মাটিকাটা, কৃষিকাজ, পোশাক শিল্প, নির্মাণ শিল্প, সেনাবাহিনী, পুলিশ, শিক্ষক ডাক্তার, পাইলট, প্রকৌশলী খেলাধুলা সব সেক্টরে কাজ করছে । শিক্ষায় নারীরা এগিয়ে আছে প্রশাসন এবং নীতিনির্ধারণী ক্ষেত্রেও নারীর উপস্থিতি লক্ষ্যণীয়। প্রতিটি উন্নয়নমূলক কাজে নারীর সম্পৃক্ততা আছে। শ্রম বাজারেও নারী উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখতে সক্ষম হচ্ছে। নারীরা তার যোগ্যতা, দক্ষতা, অভিজ্ঞতা, মেধা ও মননশীলতা দিয়ে খ্যাতির আসনটা ক্রমশ দখল করে নিচ্ছে। দেশে কিছু সংখ্যক নারী মা ও বোনের মর্যাদা বাড়লেও এক বিরাট অংশ নারী এখনো মর্যাদাহীন অবস্থায় বিরাজ করছে। তারা এখনো সমস্ত রকমের সুবিধা থেকে বঞ্চিত, লাঞ্ছিত, নির্যাতিত, নিগৃহীত ও শোষিত। এক কথায় বলতে গেলে সব রকমের বৈষম্যের শিকার সেই সাথে নিরাপত্তাহীনতাও আছে। নারীরা আমাদের দেশসহ অনেক দেশেই নারীরা পথে ঘাটে, ঘরে-বাইরে এমনকি কর্মক্ষেত্রেও বিভিন্নভাবে নির্যাতনের শিকার। চলন্ত বাসেও নির্যাতনের হাত থেকে রেহাই পাচ্ছে না নারীরা। চাকরির ইন্টারভিউতে নারী প্রার্থীকে নানারকম মানসিক নির্যাতনের শিকার হতে হয়। ইন্টারভিউ করে যোগ্যতার ভিত্তিতে চাকরিতে যোগদান করার পরও একজন নারীকে নানা রকম হেনস্তার সম্মুখীন হতে হয়। একজন মানুষের কাজের মূল্যায়ন হয় দোষ-গুণের ভিত্তিতে। কিন্তু নারীর ক্ষেত্রে দেখা যায় তার ভালো গুণের বিষয়টি চাপা দিয়ে খুটিয়ে খুটিয়ে দোষের বিষয়টিকে তুলে ধরা হয়। এসব ক্ষেত্রে অনেক নারী মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে। যার ফলে অনেকই চাকরি করতে উৎসাহ হারিয়ে ফেলছে। একজন কৃষাণী ধান রোপণ থেকে শুরু করে বাজারে বিক্রি করা পর্যন্ত ২২ ধরনের কাজের মধ্যে ১৯ ধরনের কাজ করে থাকেন। অথচ শেষ পর্যন্ত টাকার মালিক হয় স্বামী। যে স্বপ্ন ও লক্ষ্য নিয়ে নারী শ্রমিকেরা আন্দোলন শুরু করেছিলেন সেই আন্দোলনের শত বছর পার হয়ে প্রায় আরো এক যুগ হতে চলেছে কিন্তু আজও নারী শ্রমিকেরা মজুরী বৈষম্যের শিকার। নারী শ্রমিককে কেবল শ্রমিক হিসেবে বিবেচনা না করে নারী শ্রমিক হিসেবে গণ্য করা হয় যার ফলে পুরুষ শ্রমিকের তুলনায় নারী শ্রমিককে কম মজুরি দেওয়া হয়। বিশেষ করে নিম্ন আয়ের শ্রমজীবীদের মধ্যে নারী পুরুষের তুলনায় কম মজুরী পেয়ে থাকেন। ১৯৯৭ সালে জাতীয় নারী উন্নয়ননীতি বাস্তবায়নের কথা বলা হলেও আজও তা বাস্তবায়ন না হওয়ার ফলে নারীরা উত্তরাধিকার থেকে বঞ্চিত; ফলে সম্পত্তি থেকেও বঞ্চিত। মুসলিম নারীরা নামমাত্র সম্পত্তির অংশ পেলেও অমুসলিম নারীদের পিতা ও স্বামীর সম্পত্তিতে তাদের কোন অংশীদারত্ব নেই। জাতীয় রাজনীতিসহ সর্বক্ষেত্রে নারীর ৩৩% অংশ গ্রহন এখনও বাস্তবায়ন হয়নি। স্থানীয় সরকার পর্যায়ে নারীর ক্ষমতায়ন ফলপ্রসূ হচ্ছে না। সংরক্ষিত নারী আসন ও সংরক্ষিত নারী কোটা নারীকে আরো পিছনের দিকে নিয়ে যাচ্ছে। সংসদে এক তৃতীয়াংশ আসন নারীর জন্য বরাদ্দের কথা বলা হলেও আজও বাস্তবায়নের কোন লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না। ছয় মাস মাতৃত্বকালীন ছুটি সরকারিভাবে ঘোষণা দেওয়া সত্ত্বেও সব নারী আজও ছয় মাস মাতৃত্বকালীন ছুটি ভোগ করতে পারে না। এ ব্যাপারে নারীকে নানা রকম হয়রানির মুখোমুখি হতে হয়। যৌতুকের কারণে নারীকে নানা রকম নির্যাতনের শিকার হতে হয়। এমনকি অনেককে মৃত্যুবরণও করতে হচ্ছে। দেশে বাল্য বিবাহের হার ক্রমেই বেড়ে চলেছে। রাত নটার পরে নারী ঘরের বাইরে থাকবে কেন? এই কথাটি নারীকে আজও শুনতে হয়।
নারী দিবসের রং নির্ধারিত হয়েছে বেগুনি এবং সাদা, যা নারীর প্রতীক। বেগুনি রং সুবিচার ও মর্যাদা নির্দেশ করে। ১৯৮৩ সালে পুলিৎজার পুরস্কার বিজয়ী মার্কিন কৃষ্ণাঙ্গ লেখক এবং নারীবাদী অ্যালিস ও যাকারের প্রশংসিত উপন্যাস ‘দ্য কালার পারলে’ বইটি এ রং নির্ধারণে অনুপ্রেরণা যোগায়। এ বইতে তিনি নারীদের অধিকারের কথা তুলে ধরেছেন। ধারণা করা হয়, সেখান থেকেই নারীবাদী আন্দোলনের সঙ্গে জুড়ে গেছে বেগুনি-সাদা রং।
আন্তর্জাতিক নারী দিবসের পেছনে রয়েছে নারী শ্রমিকের অধিকার আদায়ের দীর্ঘ সংগ্রামের ইতিহাস। নারীর প্রতি হওয়া বৈষম্য ও নির্যাতনের বিরুদ্ধে অধিকার সচেতন করাই নারী দিবস পালনের মূল লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য। পিতৃতান্ত্রিক দৃষ্টিভঙ্গির কারণে নারীর প্রতি সহিংসতা কমছে না। এ জন্য দায়ী বর্তমান সমাজ ব্যবস্থা। বর্তমান সমাজব্যবস্থায় নারীর ভাগ্যের কোন পরিবর্তন হবে না। দরকার সমাজ পরিবর্তন। দরকার নারী ঐক্য। প্রগতিশীল সকল শ্রেণী পেশার নারী-পুরুষ উভয়ে মিলে ঐক্যবদ্ধ নারী আন্দোলনে সমবেত হয়ে এমন একটি সমাজ প্রতিষ্ঠা করি যে সমাজে নারীরা অবাধে চলাফেরা করতে পারবে, স্বাধীন ভাবে কথা বলতে পারবে। থাকবেনা কোন বৈষম্য ও নির্যাতন। আসুন আমরা নারী-পুরুষ উভয়ে মিলে সমস্বরে বলি এই আকাশ এই মাটি ও এই বিশ্ব ব্রহ্মাণ্ড নারী পুরুষ উভয়ের। আন্তর্জাতিক নারী দিবসের ভাবনা সকলের মধ্যে জাগ্রত করা গেলে ৮ মার্চ আন্তর্জাতিক নারী দিবস সার্থক ও সফল হবে।
লেখক : সভাপতি, বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ, চট্টগ্রাম জেলা

পূর্ববর্তী নিবন্ধনারীর জয়যাত্রা সর্বত্রই
পরবর্তী নিবন্ধসভ্যতার বিকাশ, পরিবার ও রাষ্ট্রের প্রাথমিক বুনিয়াদ