আট বছর আগে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়, নাট্যকলা বিভাগে ভর্তি হওয়ার মাধ্যমে থিয়েটারের সাথে পরিচয় ও যাত্রার আরম্ভ। বিভাগকেন্দ্রিক থিয়েটারের বিভিন্ন কাজের সাথে যুক্ত থাকলেও, চট্টগ্রামের অন্যান্য প্রান্তের থিয়েটারের মানুষদের সাথে একত্রিত হয়ে কাজ করার সুযোগ আমাদের খুব কমই হয়। ফলে থিয়েটারের বিভিন্ন দলের সাথে আমাদের পরিচয় হয় বটে, কিন্তু কাজের সূত্রে আমাদের একাত্ম হওয়ার উদাহরণ খুবই কম। ফলে একাত্ম হতে না পারা বা নিজ নিজ কাজ ও চিন্তার মিথষ্ক্রিয়া করতে না পারার যেই আক্ষেপ, তা বিটা অর্থাৎ বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অফ থিয়েটার আর্টস–এর বিভিন্ন উদ্যোগের মাধ্যমে তা মাঝেমাঝেই আমরা দুরীভূত করতে পারি। তারই ধারবাহিকতায় গত ৭ জানুয়ারি বিটার ৩০তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে দিনব্যাপী চট্টগ্রাম ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন দলের অংশগ্রহণে পটিয়াতে বিটার মূল কার্যালয়ে আয়োজন করা হয় আন্তর্জাতিক থিয়েটার কর্মশালার। ভাষা–শরীর ও অভিনয় এবং মুখোশ নির্মাণের কৌশল সম্পর্কিত এই কর্মশালাটি পরিচালনা করেন দক্ষিণ কোরিয়ার ন্যাশনাল থিয়েটার কোম্পানীর আর্টিস্টিক ডিরেক্টর আন্তর্জাতিক ক্ষ্যাতিসম্পন্ন নাট্যনির্মাতা সং ইন হিউন এবং থিয়েটার আর্টিস্ট চ্যাং ইউন সুক। কর্মশালাটির উদ্বোধন করেন প্রখ্যাত থিয়েটারকর্মী ও অভিনেত্রী আফরোজা বানু। সার্বিক তত্ত্বাবধানে ছিলেন বাপ্পা চৌধুরী। উদ্বোধনী অংশটি পরিচালনা করেন বিটা প্রধান শিশির দত্ত।
কর্মশালায় অংশগ্রহণ করে ভিন্ন মোট ১০টি থিয়েটার দল। দলগুলো হলো– অরিন্দম, তীর্যক, বুনোফুল, ফেইম, ক্ষ্যাপাটে, বিটা, নান্দীমুখ, মেঘাগমপ্রিয়, গণায়ন, ইয়ুথ দল বিটা।
কর্মশালাটিকে মোট ২টি ভাগে ভাগ করা হয়।
প্রথম ভাগে প্রাথমিক পরিচয় পর্ব শেষে নাট্যনির্মাতা সং ইন হিউন বিভিন্ন শারীরিক কসরত করান এবং আমাদের শরীর ও মনকে একাত্ম করে পরবর্তী মূল কাজের জন্য আমাদেরকে প্রস্তুত করে নেন।
পরবর্তীতে তিনি দক্ষিণ কোরিয়ার প্রচলিত বিভিন্ন সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য নৃত্যকৌশল ও কোরিয়ান বিভিন্ন বোলের মাধ্যমে আমাদেরকে দেখান ও আমাদের দিয়ে তা করান। এবং এই নৃত্যকালে যেই বোল প্রয়োগ করেন, সেখানে তিনি এক ধরনের বৈপরীত্যের ব্যবহার করেন, যা দর্শককে আরো বেশী আকৃষ্ট করতে সহযোগিতা করে।
প্রথম ভাগে মূলত তিনি থিয়েটার নিয়ে তার যেই চিন্তা, থিয়েটার সংক্রান্ত তাদের যেই বৈপরীত্য ও তার মধ্যে ভারসাম্য তৈরির দর্শন তা তিনি আমাদেরকে দেখানোর চেষ্টা করেন। পাশাপাশি একজন অভিনেতার প্রস্তুতির সাথে একজন খেলোয়াড়ের প্রস্তুতির যেই পার্থক্য এবং অভিনেতার প্রস্তুতি যে পুরোপুরিই একটি আলাদা মৌলিক প্রস্তুতির ব্যাপার তা তিনি আমাদেরকে বোঝাতে চেষ্টা করেন।
দুপুরের খাবারের বিরতির পর কর্মশালার দ্বিতীয় ভাগে আমাদের প্রশিক্ষণ দেয়া হয় মুখোশ নির্মাণের। এই ধাপে তিনি “কোরিয়াং মঙ্ক” নামের মুখোশ খুব স্বল্প ব্যয় ও সরঞ্জামাদি নিয়ে নির্মাণ করার প্রশিক্ষণ দেন এবং প্রশিক্ষণে অংশগ্রহণকারী সবাই একটি করে মুখোশ নির্মাণ করেন।
এই পর্ব শেষে মূল প্রশিক্ষক সং ইন হিউন দক্ষিণ কোরিয়ার ঐতিহ্যবাহী মুখোশ নৃত্য “বংসান টালকুম” আমাদের সামনে প্রদর্শন করেন। আমরা মুগ্ধ হয়ে সেই প্রদর্শনী উপভোগ করেছি।
এই প্রশিক্ষণ চলাকালীন ভাষা আমাদের সামনে কখনোই বাধা হয়ে দাঁড়ায়নি। থিয়েটারের ভাষা যে সার্বজনীন তা আরেকবার আমরা এই প্রশিক্ষণের মাধ্যমে বুঝতে পারি।
এই কর্মশালা আমাদের জন্য অত্যন্ত নতুন ও কৌতূহল উদ্দীপক। দক্ষিণ কোরিয়ার সংস্কৃতির সাথে পরিচিত হওয়া এবং তাদের থিয়েটার চর্চাকে জানতে পারা আমাদের জন্য খুব আনন্দের। তাদের চর্চাকে সরাসরি দেখতে পারার অভিজ্ঞতা, থিয়েটারের বিভিন্ন কৌশল করার ক্ষেত্রে তার দক্ষতা–দর্শন ও বিভিন্ন কৌশল শিখতে পারা আমাদের থিয়েটার চর্চায় দারুণভাবে সহযোগিতা করবে।
এর পাশাপাশি এই প্রশিক্ষণ করতে গিয়ে চট্টগ্রামের স্থানীয় ১০টি দলের সদস্যদের মিথষ্ক্রিয়ার ফলে চট্টগ্রামের থিয়েটার চর্চার ক্ষেত্রে তা নতুন যোগাযোগের সূত্র তৈরি করেছে।
অংশগ্রহণকারী থিয়েটার কর্মীদের মতে এ ধরনের কর্মশালা আরও বেশি হওয়া উচিত। এতে করে বিভিন্ন দেশের সাংস্কৃতিক যে আচার আচরণ এবং অন্যান্য দেশের যে ঐতিহ্যবাহী সাংস্কৃতিক নিদর্শন সেগুলো আদান–প্রদানের অনেক বেশি সুযোগ তৈরি হয়।
এই পারস্পরিক বিনিময়ের ক্ষেত্রটি অত্যন্ত সফলভাবে করতে পারার জন্য আমরা বিটাকে ধন্যবাদ জানাই। বিটার পটিয়ার মূল কার্যালয়ের মনোরম ও উৎকৃষ্ট পরিবেশে উক্ত কর্মশালাটি আমাদের জন্য একটি শিক্ষণীয় স্মৃতি হিসেবে থেকে যাবে। বিটার ৩০ বছর পূর্তিতে, বিটাকে অভিনন্দন জানাই। আমরা প্রত্যাশা করি আগামীতেও চট্টগ্রাম তথা বাংলাদেশের থিয়েটার চর্চায় বিটা অগ্রগামী ভূমিকা পালন করবে এবং বিভিন্ন প্রান্তের থিয়েটার চর্চা করা মানুষদের জন্য আরো অনেক সুযোগ নিয়ে আসবে।
নাট্যকর্মী, বুনোফুল থিয়েটার