আন্তর্জাতিক খিঁচুনি দিবস : কুসংস্কারের বিরুদ্ধে অবস্থান

ডা: মাহমুদ এ চৌধুরী আরজু | সোমবার , ১৩ ফেব্রুয়ারি, ২০২৩ at ৫:৫১ পূর্বাহ্ণ

আজ ১৩ ফেব্রুয়ারী ২০২৩। আন্তর্জাতিক খিঁচুনি সচেতনতা দিবস। এ বছরের প্রতিপাদ্য বিষয় হচ্ছে– Step Against Stigma বাংলায় -“কুসংস্কারের বিরুদ্ধে অবস্থান নিন”। ১৯১৫ সাল থেকে আন্তর্জাতিক এপিলেপসি ব্যুরো’র উদ্যোগে এই দিবসটি উৎযাপিত হয়। এর উদ্দেশ্য হচ্ছে বিশ্বে যে সমস্ত মানুষ মৃগী রোগে আক্রান্ত তাদের অভিজ্ঞতা বা সুখস্বাচ্ছন্দ্য নিয়ে একটি ফ্ল্যাটফর্ম তৈরী করা। তাদেরকে এ বিশ্বে সমমর্যাদা দেওয়ার কথা সবাইকে জানিয়ে দেওয়া। তাদের প্রতি সহানুভুতি থাকতে হবে এবং সুস্থ্যভাবে থাকার জন্য রাষ্ট্র বা সমাজকে এগিয়ে আসতে হবে।

মৃগীরোগ খিঁচুনির সমন্বয়ে গঠিত। খিঁচুনি মস্তিষ্কের স্নাযুতন্ত্রের জটিলতাজনিত একটি সাধারণ রোগ। বিশ্বে খিঁচুনি রোগীর সংখ্যা প্রায় ৪০ থেকে ৫০ মিলিয়ন, যার অধিকাংশই উন্নয়নশীল দেশের অধিবাসী। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, বিশ্বব্যাপী প্রতিবছর ২ মিলিয়ন মানুষ নতুন করে এ রোগে আক্রান্ত হচ্ছে। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে খিঁচুনি একটি পরিচিত রোগ। প্রতি ২০০ জনের মধ্যে ১ জন এতে আক্রান্ত হয়। প্রতি ২৬ হাজারে ১ জন তার জীবনের কোন না কোন সময়ে খিঁচুনিতে আক্রান্ত হয়ে থাকে। প্রতি হাজারে ৪১০ জন লোকের প্রত্যক্ষ খিঁচুনি দেখা দিতে পারে। বাংলাদেশের মত উন্নয়নশীল দেশে প্রতি ১০ জন খিঁচুনি রোগীর মধ্যে ৮ জন রোগী সঠিক সময়ে সঠিক ভাবে ঔষধ খেতে পারে না। এর প্রধান কারণ হচ্ছে অর্থনৈতিক সমস্যা। যদি একটি শহরের জনসংখ্যা ৫০ হাজার হয় তবে সেখানে প্রতি বছর ২৫ জন নতুন খিঁচুনি রোগী দেখা যায়। জ্বরের সময় খিঁচুনিতে আক্রান্তের সংখ্যা হাজারে ২৫ জন। সারা জীবনে অন্তত একবার খিঁচুনিতে আক্রান্তের সংখ্যা প্রায় ১০০ জন এবং প্রকৃত খিঁচুনির রোগী পাওয়া যায় ২৫০ জন। এই রোগীদের শতকরা ৫০ থেকে ৬০ ভাগের বয়স ১৫ বছরের নিচে, তবে সঠিক সময়ে রোগ ও যথাযথ চিকিৎসার মাধ্যমে খিঁচুনি রোগ নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব।

খিঁচুনি রোগের কারণসমূহের মধ্যেঃ কোন কারণে মানবদেহের কার্য পরিচালনাকারী মস্তিষ্কের স্নায়ুতন্ত্রের উদ্দীপক এবং নিবৃত্তিকারক অংশদ্বয়ের কার্যপ্রণালীর ভারসাম্য নষ্ট হয়ে গেলে খিঁচুনি রোগের লক্ষণ দেখা দিতে পারে। মস্তিষ্কের অতিসংবেদনশীলতা ছাড়াও ব্রেনের টিউমার, স্ট্রোক, মাথায় আঘাত ও রক্তপাত, রক্তশিরায় সমস্যা, ব্রেনের পুরনো ক্ষত, ইনফেকশন, মাত্রাতিরিক্ত জ্বর, মানসিক প্রতিবন্ধকতা, আলজেইমার, নেশাজাতীয় ওষুধ সেবন, শরীরের লবণ, ভিটামিন বা খনিজ পদার্থ হ্রাস পাওয়া এবং ডায়াবেটিস থেকেও খিঁচুনি রোগ দেখা দিতে পারে৷গর্ভকালীন সময়ে শিশু কিংবা মা খিচুনিতে আক্রান্ত হলে, শিশুর জন্মের প্রথম কয়েক দিন খিঁচুনি দেখা দিলে বা মস্তিষ্কে আঘাত লাগলে কিংবা অক্সিজেনের ঘাটতি হলে শিশুর খিঁচুনি রোগ দেখা দিতে পারে। খিঁচুনি রোগীর জন্য খিঁচুনি ডাইরী (Fit Chart) থাকা দরকার।

সাধারণত খিঁচুনি শুরু হওয়ার পর নিজ থেকেই থেমে যায়। খিঁচুনি হলে সেটি থামানোর জন্য শক্তি প্রয়োগ রোগীর জন্য ক্ষতির কারণ হতে পারে। এর ফলে তার মাংসপেশী ছিড়ে যাওয়াসহ নানা রকম সমস্যা দেখা দিতে পারে।

খিঁচুনির সময় নিম্নলিখিত বিষয়গুলোর প্রতি খেয়াল রাখা প্রয়োজন, রোগীকে আগুন, পানি, ধারালো অস্ত্র, যন্ত্রপাতি, গাড়ী বা সাইকেল চালানো ইত্যাদি থেকে দূরে রাখতে হবে। চোয়াল বন্ধ হয়ে গেলে জোরপূর্বক খোলার চেষ্টা করা উচিত নয়। রোগীর মুখে চামড়ার জুতো, গরুর হাড়, লোহার শিক ইত্যাদি চেপে ধরা উচিত নয়। এগুলো কুসংস্কার ছাড়া কিছুই না। এতে রোগীর উপকারের চেয়ে ক্ষতি বেশি হয়। এজন্য বাড়তি কিছু যেমনমাথায় পানি দেয়া, হাতপা চেপে ধরা, ওষুধ খাওয়ানোএসবের কোন প্রয়োজন নেই। রোগীকে এক পাশ করে শুয়ে রাখতে হবে এবং নিজের মতো ছেড়ে দিতে হবে। রোগীর আশপাশে যেন ধারালো যন্ত্রপাতি, অস্ত্র বা আগুন, ইটপাথর না থাকে সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। কারণ এসবের কারণে সে আঘাত প্রাপ্ত হতে পারে।

শিশুকে অবশ্যই চিকিৎসকের শরণাপন্ন করতে হবে যদি খিঁচুনি ৫ মিনিটের বেশি স্থায়ী হয়, শ্বাসপ্রশ্বাসে সমস্যা হয়, শিশু একনাগাড়ে অনেকক্ষণ ধরে বিভ্রান্ত হয়ে থাকে কিংবা অচেতন থাকে, খিঁচুনির সময় শিশু কোনভাবে যদি আহত হয়, শিশু যদি প্রথমবারের মতো খিঁচুনিতে আক্রান্ত হয়।

খিঁচুনি রোগ নিয়ে বিভিন্ন কুসংস্কার ও ভ্রান্ত ধারণার বিরুদ্ধে প্রাচীন গ্রিসের হিপোক্রিটাস প্রতিরোধ গড়ে তুলেছিলেন। সেই সময়ই তারা মানুষকে বোঝানোর চেষ্টা করেছিলেন, খিঁচুনি রোগ হচ্ছে একটি মস্তিষ্কের রোগ, অন্য কিছু নয়। তারপরও এই রোগের কুসংস্কারমূলক বিশ্বাসগুলো শতাব্দী ধরে মানুষের মাঝে রয়ে গেছে। খিঁচুনি যে কোন সাধারণ রোগের মতোই একটি রোগ এবং এই রোগীদের প্রতি আমাদের সহযোগী মনোভাবাপন্ন হওয়া উচিত। শিশুদের খিঁচুনি হলে পিতামাতার দুশ্চিন্তার কারণ নেই। নির্দিষ্ট সময়ে চিকিৎসার মাধ্যমে এ রোগ চিরতরে সুস্থ হওয়ার সম্ভাবনা আছে। বর্তমানে বাজারে খিঁচুনী রোগের জন্য অনেক ঔষধ আছে। তবে এ সমস্ত ঔষধ ২ বৎসর থেকে ৩ বসর একটানা খাওয়ানোর প্রয়োজন। অনেকে খিঁচুনি রোগ ভাল হয়ে গিয়েছে মনে করে কয়েকমাস খাওয়ার পর ঔষধ বন্ধ করে দেয়। তখন আবার খিঁচুনি দেখা দেয়। কাজেই খিঁচুনির ঔষধ একবার শুরু করে ডাক্তারের পরামর্শ ছাড়া বন্ধ করা যাবে না।

কোভিট১৯ কালীন সময়ে খিঁচুনিতে আক্রান্ত রোগীরা নানা সমস্যার সম্মুখীন হয়েছিল এর মধ্যে সঠিক সময়ে খিঁচুনির ঔষধ না পাওয়া বিশেষ করে কোভিট১৯ কালীন সময়ে ঔষধের দোকান বন্ধ থাকার কারণে টাকা থাকা সত্ত্বেও ঔষধ কিনতে পারেনি। তাই দেখা গেছে কোভিট১৯ কালীন সময়ে অনেক রোগী খিঁচুনিতে আক্রান্ত হয়েছে, এমনিতে খিঁচুনির ঔষধের দাম বেশি ও সহজলভ্য নয়। এজন্য সাধারণ মানুষ খিঁচুনির ঔষধ কিনতে অনেক সমস্যায় পড়ে যায়। গর্ভকালীন সময়ে নানা ধরনের ইনফেকশন হয় বিশেষ করে ব্রেনের ইনফেকশন ও আঘাত জনিত কারণে মানুষের খিঁচুনি হয়ে থাকে। সাধারণত গরীব জনগোষ্ঠীর মধ্যে খিঁচুনির প্রাদুর্ভাব বেশি অথচ তারা টাকার অভাবে ঔষধ কিনতে পারে না। ঘন ঘন খিঁচুনির কারণে মস্তিস্কের কার্যকারীতা লোভ পায়, ফলে শিশু শারীরিক ও মানসিক প্রতিবন্ধী হয়ে যেতে পারে।

তাই আন্তর্জাতিক মৃগী রোগ দিবসে সকল খিঁচুনি রোগীর জন্য সুলভমূল্যে অথবা বিনা মূল্যে খিঁচুনির ঔষধ সরবরাহ ও তাদের নানাবিধ সমস্যা থাকলে তা রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে উদ্যোগ ও সমাধান করা হউক এটাই আমার কাম্য।

লেখক : পরিচালক, অটিজম ও শিশু বিকাশ কেন্দ্র, চট্টগ্রাম মা শিশু ও জেনারেল হাসপাতাল।

পূর্ববর্তী নিবন্ধএ আত্মহননের দায় কে নেবে
পরবর্তী নিবন্ধইসলামে ভাষা শহীদদের মর্যাদা ও মাতৃভাষার প্রতি ভালোবাসা