আন্তর্জাতিক অর্থনীতি অলিম্পিয়াড-২০২০ এবং বাংলাদেশের অর্জন

প্রফেসর ড. নারায়ন বৈদ্য | শনিবার , ৭ নভেম্বর, ২০২০ at ৫:২৬ পূর্বাহ্ণ

স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশে উচ্চ শিক্ষার সুযোগ ছিল খুবই সীমিত। সাধারণ শিক্ষায় উচ্চতর ডিগ্রি নেয়ার জন্য সমগ্র বাংলাদেশে বিশ্ববিদ্যালয় ছিল মাত্র তিনটি। এ তিনটি বিশ্ববিদ্যালয় হয়- ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ও রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়। এ তিনটি বিশ্ববিদ্যালয়ের ফলাফল প্রকাশের মধ্যে পদ্ধতিগত মিল থাকলেও রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সাথে ঢাকা ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে কিছুটা ভিন্ন ছিল। তখনকার সময়ে একজন পরীক্ষার্থী অনার্স বিষয়গুলোর ক্ষেত্রে ৩৬ শতাংশ থেকে ৪৪ শতাংশ নম্বর পেলে তাকে তৃতীয় শ্রেণি প্রাপ্ত ছাত্র বা ছাত্রী হিসেবে ঘোষণা করা হয়। কিন্তু ৪৫ শতাংশ থেকে ৫৯ শতাংশ এর মধ্যে প্রাপ্ত নম্বরধারী ছাত্র ছাত্রীদেরকে ঢাকা ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে দ্বিতীয় শ্রেণি প্রাপ্ত ছাত্র বা ছাত্রী হিসেবে ঘোষণা করা হলেও রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে এ নিয়ম প্রচলিত ছিল না। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ৪০ শতাংশ থেকে ৫৯ শতাংশ এর মধ্যে প্রাপ্ত নম্বরধারী ছাত্র-ছাত্রীদেরকে দ্বিতীয় শ্রেণি প্রাপ্ত ছাত্র-ছাত্রী হিসেবে ঘোষণা করা হতো। তখনকার সময়ে একটি কথা ছাত্র-ছাত্রীদের মুখে মুখে প্রচলিত ছিল যে, রাজশাহী অঞ্চলে অনুন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থার কারণে ছাত্র-ছাত্রীরা ঐ অঞ্চলে যেতে চাইত না। তাদেরকে উৎসাহন্বিত করার জন্য রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় এই ব্যবস্থা চালু করে। আর ৬০ শতাংশ থেকে বেশি প্রাপ্ত ছাত্র-ছাত্রীদেরকে প্রথম শ্রেণি প্রাপ্ত ছাত্র-ছাত্রী হিসেবে ঘোষণা করা হতো।
আজকের দিনের মত এত বিষয়ও বিশ্ববিদ্যালয়ে অন্তর্ভুক্ত ছিল না। এখন প্রত্যেক বিশ্ববিদ্যালয়ে নতুন নতুন কত বিষয়ই না পড়ানো হয়। ফ্যাকাল্টি ছিল শুধুমাত্র তিনটি। আর্টস ফ্যাকাল্টি, কমার্স ফ্যাকাল্টি এবং সায়েন্স ফ্যাকাল্টি। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্থনীতি বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত ছিল আর্টস্‌ ফ্যাকাল্টির সাথে। তখন অর্থনীতি বিষয়টিকে আর্টস্‌ ফ্যাকাল্টির মধ্যে রয়েল সাবজেট হিসেবে মনে করা হতো। এর পিছনে অনেকগুলো কারণ আছে। ছাত্র-ছাত্রীরা যখন সর্বোচ্চ ডিগ্রি নিয়ে কর্মক্ষেত্রে ফিরে আসে তখন অর্থনীতিতে ডিগ্রি নেয়া ছাত্র-ছাত্রীদের চাহিদা ছিল বেশি। বিভিন্ন চাকরিতে অর্থনীতির ছাত্র-ছাত্রীদের অগ্রাধিকার ভিত্তিতে নেয়া হতো। সরকারি কর্মকমিশনের বিভিন্ন পদে অর্থনীতিতে পাশ করা ছাত্র-ছাত্রীদের চাহিদা ছিল অধিক। এসব কারণে এ তিনটি বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্থনীতিতে পাঠরত ছাত্র-ছাত্রীদের একটু আলাদা চোখে দেখা হতো। অর্থনীতি বিষয়টিকে রয়েল সাবজেট বলার পিছনে আরো একটি কারণ তখন ছাত্র-ছাত্রীদের মুখে মুখে ছিল বিশেষ করে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে। আমরা তখন হাসি মুখে অন্যান্য সাবজেটে অধ্যয়নরত বন্ধুদেরকে বলতাম, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে তখনকার সময়ে যেসব শিক্ষক অধ্যাপনা করতেন তাদের মধ্যে অর্থনীতি বিষয়ের শিক্ষকদের জীবনযাত্রা ছিল অধিকতর উন্নত। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের আর্টস্‌ ফ্যাকাল্টির কোন অংশে অর্থনীতি বিভাগ তা কাউকে বলতে হতো না। পূর্ব পশ্চিম লম্বা আর্টস্‌ ফ্যাকাল্টির নীচে যেখানে অধিক প্রাইভেটকার দাঁড়িয়ে থাকতো নিশ্চয় সেখানে অর্থনীতি বিভাগ বলে ধরে নেয়া হতো। অর্থাৎ চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিকাংশ শিক্ষকের তখন নিজস্ব গাড়ি ছিল না। এ জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ে কোন গাড়ি পার্কিং এর ব্যবস্থাও ছিল না। স্যারেরা ফ্যাকাল্টির নীচে গাড়ি পার্কিং করে উপরে ক্লাস নেয়ার জন্য যেতেন। যেহেতু অধিকাংশ অর্থনীতি শিক্ষকদের গাড়ি ছিল সেহেতু ছাত্র-ছাত্রীরা মনে করতো অধিক গাড়ি পার্কিং ফ্যাকাল্টির যে অংশে আছে সেই অংশের কোন এক তলায় অবশ্যই অর্থনীতি বিভাগ আছে। অর্থনীতি বিষয়ের এমন দাপট ছিল সব বিশ্ববিদ্যালয়ে।
আরও একটি বিষয় না বললেই নয়। বিশ্বে মানব জাতির কল্যাণে যে সব সাব্‌জেট অধিক গুরুত্বপূর্ণ সে সব বিষয়ের ওপর নোবেল পুরস্কার দেয়া হয়। স্যার আলফ্রেড নোবেল এর উপার্জিত অর্থ দ্বারা মানব জাতির কল্যাণকর বিষয়ে তাঁর নাম অনুসারে নোবেল পুরস্কার প্রদান করা হয়। প্রাথমিক অবস্থায় ব্যাপক বিচার বিশ্লেষণ করে নির্ধারণ করা হয় পাঁচটি ক্ষেত্রে নোবেল পুরস্কার প্রদান করা হবে। এ বিষয়গুলো হলো শান্তি, সাহিত্য, চিকিৎসা, পদার্থবিদ্যা, রসায়ন বিদ্যা। কিন্তু পরবর্তীতে সুইডিশ একাডেমি বিশ্বব্যাপী অর্থনীতির গুরুত্ব অনুধাবন করে নোবেল পুরস্কারের জন্য অর্থনীতিকে অন্তর্ভুক্ত করে। বর্তমানে অর্থনীতিসহ ছয়টি বিষয়ের ওপর নোবেল পুরস্কার প্রদান করা হয়। এটা দ্বারা প্রতীয়মান হয় যে, বর্তমান বিশ্বে অন্য পাঁচটি বিষয়ের ন্যায় অর্থনীতিও একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। এখনো বিশ্বের বিভিন্ন দেশে অর্থনীতি বিষয়টিকে খুবই গুরুত্বের সাথে বিবেচনা করা হয়। অন্যান্য বিষয়ের ন্যায় অর্থনীতির বিভিন্ন ক্ষেত্রে গবেষণা হয় অধিক। অর্থনীতি সব সময় মানুষের মানবীয় আচরণকে বিশ্লেষণ করে এবং তা থেকে মানব কল্যাণধর্মী একটি সিদ্ধান্তে উপনীত হতে সহায়তা করে। সময়, পরিবেশ, মানুষের ধ্যান ধারণা ক্রমপরিবর্তনশীল। ফলে অর্থনীতির তত্ত্বও পরিবর্তনশীল। বিষয়টি সাধারণ জনতাকে বুঝানোর জন্য এভাবে উপস্থাপন করা যায়।
অর্থনীতির মৌলিক বিষয় হচ্ছে উপযোগ। একজন ভোক্তা একটি পণ্য ক্রয় করে যে পরিমাণ তৃপ্তি লাভ করে থাকে তাকে উপযোগ বলা যায়। উপযোগ ব্যক্তি বিশেষের ওপর নির্ভরশীল। একজন ধনী ব্যক্তি এক কেজি চিনি ক্রয় করে যে পরিমাণ উপযোগ লাভ করে, একজন দরিদ্র ব্যক্তি এক কেজি চিনি ক্রয় করে এর চেয়ে অধিক উপযোগ লাভ করে। এসব বিষয়ে অধ্যাপক আলফ্রেড মার্শাল এবং তাঁরই ছাত্র জে.আর. হিক্স ব্যাপক বিশ্লেষণ করেছেন। কিন্তু সময়ের প্রেক্ষিতে আবহাওয়া, জলবায়ু, ভোক্তার মনমানসিকতা, ক্রয় ক্ষমতা ইত্যাদি পরিবর্তনের কারণে অধ্যাপক মার্শাল ও হিক্সের এ তত্ত্ব বাস্তবতার নিরিখে এখন আর প্রয়োগযোগ্য নয়। আমেরিকার অর্থনীতিবিদ ভি. নিউম্যান (V. NEUMANN) এবং ও. মর্গানেষ্টারন (O. MORGENSTERN) সংখ্যাতাত্ত্বিক উপযোগ সূচক তৈরি করে দেখান যে, একজন ভোক্তা অনিশ্চিয়তা এবং ঝুঁকিসহ কিভাবে উপযোগ সর্বোচ্চকরণ করে। এরূপ উপযোগ সর্বোচ্চকরণ সম্ভাবনা ও ঝুঁকির ওপর নির্ভরশীল। বিষয়টিকে এভাবে উপস্থাপন করা যায়। একজন ভোক্তা বাজার থেকে একটি ইলিশ মাছ ক্রয় করতে চায়। তিনি বড় ইলিশটি দেখে তা খুবই স্বাদ হবে ভেবে প্রতি কেজি এক হাজার টাকা দরে ক্রয় করলেন। কিন্তু তিনি যখন মাছটি রান্না করার পর ভোগ করলেন তখন তিনি দেখলেন মাছটি মোটেই স্বাদ নেই। অথচ তিনি পূর্বেই উক্ত মাছের দাম পরিশোধ করেছেন। অর্থাৎ একটি পণ্য ক্রয় করে তা থেকে উপযোগ যথাযথ পাবে কি পাবে না তা নির্ভর করে ঝুঁকি ও অনিশ্চিয়তা তথা সম্ভাবনার ওপর। আবার ভোক্তার প্রকৃতিও দ্বৈত। ভোক্তা সবসময় ঝুঁকি পরিহার করতে চায়। এ জন্য ভোক্তা বিমা করে। আবার একই সময়ে উক্ত ভোক্তা লটারির টিকেটও ক্রয় করে। একজন ভোক্তা লটারির টিকেট ক্রয় করা মানে ঝুঁকি গ্রহণ করা। কারণ লটারির টিকেট থেকে তিনি পুরস্কার পেতেও পারেন, আবার নাও পেতে পারেন। অর্থাৎ একজন ভোক্তার নিকট দ্বৈত অবস্থা দেখা যায়। বর্তমান সময়ে অর্থনীতি এ পর্যায়ে চলে গেছে। বাস্তব অবস্থার প্রেক্ষিতে বিশ্ব অর্থনীতির এরূপ গভীর জ্ঞান অর্জন করার জন্য গণিত অলিম্পিয়াড, রসায়ন অলিম্পিয়াডের ন্যায় বিশ্বব্যাপী ‘আন্তর্জাতিক ইকোনমিকস অলিম্পিয়াড’ এর আয়োজন করা হয় প্রতি বৎসর। এ বছর আন্তর্জাতিক ইকোনমিঙ অলিম্পিয়াড হওয়ার কথা ছিল কাজাখস্তানে। কিন্তু করোনা মহামারির কারণে শেষ পর্যন্ত তা অনুষ্ঠিত হয় অনলাইনে। আর সেখানে দ্বিতীয়বারের ন্যায় অংশ নেয় বাংলাদেশ। বাংলাদেশের দলে ছিল ঢাকা শহরের এস.এফ.এক্স গ্রিন হেরাল্ড ইন্টারন্যাশনাল স্কুলের দর্পণ বড়ুয়া, ইসফার ফারিহা ও সানবিমস স্কুলের ফারাজ চৌধুরী এবং সানিডেল স্কুলের সৈয়দ নাজিফ ইশরাক। তারা সবাই এ লেভেলের শিক্ষার্থী। বাংলাদেশ দল জিতে নেয় ৪টি একক ও ১টি দলগত ব্রোঞ্জ পদক।
২০১৯ সালে রাশিয়ায় আয়োজিত আন্তর্জাতিক ইকোনমিকস অলিম্পিয়াডে প্রথম অংশগ্রহণ করে বাংলাদেশ। স্বল্প সময়ের প্রস্তুতিতে সেবার ২৯টি দলের মধ্যে ১৫তম স্থান অর্জন করে বাংলাদেশ। বাংলাদেশ ইকোনমিকস অলিম্পিয়াড কমিটির চেয়ারম্যান হলেন অর্থনীতিবিদ কাজী খলীকুজ্জামান আহমদ। ২০২০ সালে ৮০০ জন শিক্ষার্থী নিয়ে অনলাইনে অনুষ্ঠিত হয় প্রথম পর্ব। সেখান থেকে ২৬ জনকে বাছাই করে দ্বিতীয় পর্ব শুরু করা হয়। তারপর জাতীয় ক্যাম্পের জন্য ১০ জনকে বাছাই করা হয়। সাতদিনের ক্যাম্প শেষে ৫ সদস্যের বাংলাদেশ দল নির্বাচন করা হয় আন্তর্জাতিক ইকোনমিকস অলিম্পিয়াড-২০২০ এর জন্য। এরাই সাফল্য নিয়ে আসে। পরবর্তীতে আন্তর্জাতিক ইকোনমিকস অলিম্পিয়াডের মূল লক্ষ্য হবে ঢাকার বাইরে দেশের আনাচে-কানাচে থাকা অর্থনীতিপ্রেমী ছেলেমেয়েদের তুলে আনা। তবেই অর্থনীতি অলিম্পিয়াড ব্যাপক জনপ্রিয় হয়ে উঠবে।
লেখক : পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক, বিজিসি ট্রাস্ট ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশ।

পূর্ববর্তী নিবন্ধজেনে নিন আপনার যত অধিকার নামজারী খতিয়ান কেন প্রয়োজন
পরবর্তী নিবন্ধ‘ইতিহাসের আড়ালে ইতিহাস’ পাঠ অনুভূতি