আনিসুরই জামাতুল আনসারের নেতা

তার কাছে যেতেন মেজর জিয়া : র‌্যাব নাথান বমকে ঢাকায় বাসা ভাড়া করে দেন ২ সহযোগীসহ মুন্সিগঞ্জে গ্রেপ্তার

| মঙ্গলবার , ২৫ জুলাই, ২০২৩ at ৭:১৮ পূর্বাহ্ণ

নতুন জঙ্গি দল জামাতুল আনসার ফিল হিন্দাল শারক্বীয়ার সঙ্গে লেখকপ্রকাশক হত্যায় মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত জিয়াউল হকের যোগাযোগ ছিল বলে তথ্য দিয়েছে র‌্যাব। এ বাহিনীর আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন বলছেন, নিষিদ্ধ জঙ্গি দল আনসার আল ইসলামের নেতা, সেনাবাহিনীর বরখাস্ত মেজর জিয়া বেশ কয়েকবার বান্দরবানে গিয়ে জামাতুল আনসারের আমির আনিসুর রহমান ওরফে মাহমুদের সঙ্গে দেখাও করেছেন। রোববার রাত ৩টার দিকে মুন্সীগঞ্জের লৌহজংয়ের একটি বাসা থেকে আনিসুরসহ তিনজনকে গ্রেপ্তার করার পর গতকাল ঢাকায় এক সংবাদ সম্মেলনে এ তথ্য তুলে ধরেন র‌্যাব কর্মকর্তা মঈন। এর আগে ২৩ জুন রাতে ঢাকার ডেমরা থেকে এই জঙ্গি দলের নেতা শামিন মাহফুজ ও তার স্ত্রীকে গ্রেপ্তার করার কথা জানায় পুলিশের কাউন্টার টেরোরিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম ইউনিট (সিটিটিসি)। পুলিশের এই বিশেষায়িত বাহিনীর ভাষ্য, শামিন মাহফুজই জামাতুল আনসার ফিল হিন্দাল শারক্বীয়ার প্রতিষ্ঠাতা। তবে র‌্যাব বলছে, শামিন মাহফুজ এই সংগঠনের উপদেষ্টা। আর মূল ব্যক্তি অর্থাৎ আমির হলেন কুমিল্লার আনিসুর রহমান মাহমুদ। খবর বিডিনিউজের।

আনিসুর যেভাবে জঙ্গি নেতা : সংবাদ সম্মেলনে র‌্যাবের মুখপাত্র বলেন, প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে জেনেছি, আমির আনিসুর রহমান দাওরায় হাদিস শেষ করেন। তিনি যখন মাদ্রাসায় পড়তেন তখন হরকাতুল জিহাদের সঙ্গে যুক্ত হন। পরে তিনি একটা মাজারের সাথে যুক্ত হয়ে সেখানে অনেকদিন থাকেন। ২০১৩ সালের পরে আনসার আল ইসলামের নেতাদের সঙ্গে তার যোগাযোগ হয়। তখন থেকেই তার মধ্যে একটি পরিকল্পনা ছিল যে তিনি এমন একটি উগ্রবাদী সংগঠন তৈরি করতে চান, যেটি হবে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত, অনেক জ্ঞানী এবং যেটি এই উপমহাদেশে একটি রিমার্কেবল উগ্রবাদী সংগঠন হিসেবে নিজেদের দাবি করবে।

র‌্যাবের সংবাদ সম্মেলনে বলা হয়, ২০১৬ সালের পরে বান্দরবানের বিভিন্ন মসজিদ ও মাদ্রাসায় যেতেন আনিসুর। মুসলিম ও অমুসলিমদের তিনি ধর্মীয় অপব্যাখ্যা দিয়ে দলে টানার চেষ্টা করতেন।

মঈন বলেন, ২০১৯ সাল পর্যন্ত তিনি বান্দরবান, নাইক্ষংছড়ির মতো এলাকায় অবস্থান করে তার চিন্তা অনেকের সঙ্গে শেয়ার করেন। এ সময় তার সঙ্গে আনসার ইসলামের সক্রিয় সদস্য রঙি ও ফেলানির পরিচয় হয়। তাদের কাছ থেকে অনেক সাংগঠনিক বিষয় শেখেন আনিসুর রহমান মাহমুদ। বান্দরবান এলাকায় এই সংগঠনের উপদেষ্টা শামীন মাহফুজ ও নাথান বমসহ (পাহাড়ের বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠন কুকি চিন ন্যাশনাল ফ্রন্ট বা কেএনএফের নেতা) অন্যদের সঙ্গে আনিসুরের পরিচয় হয়।

র‌্যাবের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, ৩২ বছর বয়সী আনিসুর রহমান মাহমুদের বাড়ি কুমিল্লা সদর দক্ষিণ উপজেলার হরকল গ্রামে। তার বাবার নাম মোখলেছুর রহমান। স্থানীয় একটি মাদ্রাসা থেকে হাফেজি পড়া শেষ করে সেখানেই একটি সিএনজি রিফুয়েলিং স্টেশনে ম্যানেজার হিসেবে কাজ শুরু করেন তিনি। ২০২১ সালে পৈত্রিক কিছু সম্পদ বিক্রি করে হঠাৎ নিরুদ্দেশ হয়ে যান।

মঈন বলেন, ২০২০ সালের শুরুর দিকে নাথান বমসহ কেএনএফের সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমে আসলাম নামের এক ব্যক্তির সাথে গহীন পাহাড়ে প্রশিক্ষণ নিতে যান আনিসুর। সেখানে আসলামের তত্ত্বাবধানে তিনি প্রশিক্ষণ নেন। প্রশিক্ষণ শেষে তিনি কুমিল্লায় এসে নিজের সম্পত্তি ৫০ লাখ টাকার বেশি দামে বিক্রি করে দেন। এরপর নাইক্ষংছড়িতে তিন বিঘা জায়গা কিনে পরিবারসহ থাকতে শুরু করেন। তিন বিঘা জমির দাম দিয়ে বাকি টাকা তিনি নতুন জঙ্গি সংগঠনকে দেন।

র‌্যাব বলছে, নাইক্ষংছড়িতে একটি খামার করেন আনিসুর। সেখানে এ সংগঠনের আধ্যাত্মিক নেতা মাহমুদুল হাসান গুণভীসহ অনেকেই গেছেন। আনসার আল ইসলামের শীর্ষ নেতা জিয়াও সেখানে যেতেন।

২০২০ সালের পরে আনসার আল ইসলামের সদস্যসহ উপদেষ্টারা প্রশিক্ষণের সম্ভাব্যতা দেখতে সেখানে যান। এ জঙ্গি সংগঠনের সদস্যদের প্রশিক্ষণের জন্য সেখানে তাদের চুক্তিও হয় বলে র‌্যাব মুখপাত্রের ভাষ্য।

তিনি বলেন, জামাতুল আনসার ২০১৭ সাল থেকে তাদের কার্যক্রম শুরু করে। ২০১৯ সালে প্রথম তারা সংগঠনের নামকরণ করে। তাদের প্রথম আমির ছিলেন মাইনুল ইসলাম ওরফে রঙি। ২০২১ সালে রঙি গ্রেপ্তার হন। এরপর সুরা সদস্যরা আনিসুরকে আমির নির্বাচিত করে।

আনিসুর রহমানই যে আমির, র‌্যাব কীভাবে নিশ্চিত হলো জানতে চাইলে মঈন বলেন, আমরা গেপ্তার করেছি ৮২ জনকে। র‌্যাবের বাইরে অন্য আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ধরেছে ৮ থেকে ১০ জনকে। গ্রেপ্তার সুরা সদস্যসহ সবার সাথেই আমরা কথা বলেছি, তাদের সাংগঠনিক কাঠামো সম্পর্কে জেনেছি। তারাই বলেছে, আনিসুর রহমান ওরফে মাহমুদ সংগঠনের আমির।

দুই জঙ্গি দলের সহযোগিতা চুক্তি : র‌্যাবের মুখপাত্র বলেন, গ্রেপ্তার হওয়া আনিসুরের সঙ্গে আনসার আল ইসলামের নেতাদের সুসম্পর্ক ছিল। শীর্ষ জঙ্গি নেতা মেজর জিয়ার সাথে তার বেশ কয়েকবার দেখা হয়েছিল। বিজ্ঞান লেখক অভিজিৎ রায় এবং প্রকাশক ফয়সল আরেফিন দীপন হত্যা মামলায় মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত জিয়ার বিরুদ্ধে জঙ্গি হামলা ও হত্যার আরও কয়েকটি মামলা রয়েছে। তিনি নিষিদ্ধ জঙ্গি সংগঠন আনসার আল ইসলামের সামরিক শাখার প্রধান বলে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী জানিয়ে আসছে।

গতকাল সংবাদ সম্মেলনে বলা হয়, ২০২২ সালে কিশোরগঞ্জে আনসার আল ইসলাসের সঙ্গে একটি বৈঠকে জামাতুল আনসার নেতা আনিসুর রহমান মাহমুদের একটি চুক্তি হয়। সেই চুক্তি অনুযায়ী আনিসুরকে ১৫ লাখ টাকা দেয় আনসার আল ইসলাম। পরে আরও টাকা দেবে বলে প্রতিশ্রুতি দেয়। চুক্তি অনুযায়ী জামাতুল আনসারের সদস্যদের আনসার আল ইসলাম আইটি ও নিরাপত্তা বিষয়ক প্রশিক্ষণ দেবে। বিনিময়ে আনসার আল ইসলামের সদস্যদেরকে পার্বত্য অঞ্চলে অস্ত্র প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা এবং অস্ত্র সরবরাহ করবে জামাতুল আনসার। পরে আনিসুর কেএনএফ প্রধান নাথান বম ও সেকেন্ড ইন কমান্ড বাংচুংয়ের সাথে বৈঠক করে আনসার আল ইসলামের সাথে চুক্তির বিষয়ে অবহিত করেন ও প্রয়োজনীয় সমন্বয় করেন।

যেভাবে গ্রেপ্তার : রোববার রাত ৩টার দিকে লৌহজং উপজেলার বড় নওপাড়া গ্রামের একটি একতলা বাড়ি ঘিরে অভিযান শুরু করে র‌্যাব। পরে সেখান থেকে গ্রেপ্তার করা হয় আনিসুর রহমান মাহমুদ (৩২) এবং তার দুই সহযোগী কাজী সিরাজ উদ্দীন ওরফে সিরাজ (৩৪) এবং মাহফুজুর রহমান বিজয় ওরফে বাবুল ওরফে জাম্বুলিকে (২৮) গ্রেপ্তারের কথা জানানো হয়।

ওই বাড়ি থেকে দেশিবিদেশি আগ্নেয়াস্ত্র, বোমা তৈরির সরঞ্জাম, উগ্রবাদী পুস্তিকা ও নগদ টাকা জব্দ করার কথাও জানান র‌্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার সহকারী পরিচালক আ ন ম ইমরান খান। তিনি বলেন, ওই বাড়িতে জঙ্গিরা অবস্থান করছে এমন খবর আমাদের কাছে ছিল। এর ভিত্তিতে সেখানে অভিযান পরিচালনা করে র‌্যাব।

ওই বাড়ির মালিক আনোয়ারা বেগমের স্বামী বদিউর রহমান মারা গেছেন, ছেলেরা আলাদা থাকায় ওই বাড়ি তিনিই দেখভাল করেন। আনোয়ারা বেগম জানান, তার একতলা ভবনের দুটি কক্ষ তিন দিন আগে ভাড়া নেন হাসান নামের একজন। এক পরিবারের সদস্য পরিচয় দিয়ে তিনজন পুরুষ বাসায় ওঠেন, পরিবারের নারী সদস্যরা পরে আসবেন বলে সে সময় তারা জানান। ভাড়া ঠিক হয়েছিল এক হাজার টাকা বিদ্যুৎ বিলসহ মোট ৫ হাজার টাকা। নতুন ভাড়াটেরা বলেছিল, জাতীয় পরিচয়পত্র দুই দিন পরে দেবে। তিনি বলেন, রাত ৩টার দিকে হঠাৎ তার বাড়ি ঘেরাও করে অভিযান শুরু করে র‌্যাব। পরে নতুন ভাড়াটেদের তিনজনকেই গ্রেপ্তার করে নিয়ে যায়।

নাথান বমকে ঢাকায় বাসা ভাড়া করে দেন আনিসুর : কেএনএফের সঙ্গে জঙ্গি সংগঠন জামাতুল আনসার আল ফিল হিন্দাল শারক্বীয়ার যোগাযোগের নতুন তথ্য সামনে আনল র‌্যাব। জামাতুল আনসারের কথিত আমির মো. আনিসুর রহমান মাহমুদকে গ্রেপ্তারের পর র‌্যাবের সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়, এই আনিসুরের মাধ্যমে ঢাকার বাসাবো এলাকার একটি ভাড়া বাসায় আট মাস ছিলেন কেএনএফ নেতা নাথান বম। ওই সময় নাথান বমের সঙ্গে আনিসুরের নিয়মিত যোগাযোগও ছিল। বর্তমানে নাথান বম দেশে নেই জানিয়ে র‌্যাবের পরিচালক মঈন বলেন, ধারণা করা হচ্ছে সে পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতের মিজোরামে আছে।

পূর্ববর্তী নিবন্ধসভাপতি পদে ১৪ ও সা. সম্পাদক পদে ১৪ প্রার্থীর বায়োডাটা জমা
পরবর্তী নিবন্ধসাত বছর পর ফটিকছড়ি আ. লীগের দুই গ্রুপের কোন্দল নিরসন