আনিসুজ্জামান: তাঁর ব্যক্তি স্বরূপের সন্ধানে

কানাই দাশ | শুক্রবার , ৯ অক্টোবর, ২০২০ at ৯:০১ পূর্বাহ্ণ

১৯৫০ এর দশকের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক ঝাঁক মেধাবী অথচ স্বদেশ ভাবনায় আজীবন নিবেদিত এক প্রজন্মের প্রায় সর্বশেষ প্রতিনিধি জাতীয় অধ্যাপক প্রফেসর আনিসুজ্জামান গত ১৪ মে মৃত্যুবরণ করলেন এদেশের মানবকল্যাণকামী সুস্থ জীবন ভাবনার পরিসরকে আরো সংকুচিত ও আমাদের নির্ভরতার আশ্রয়কে নিঃস্বতর করে।
প্রফেসর আনিসুজ্জামানকে দেখলেই আমার “হ্যামলেট” নাটকের পলোনিয়াসের সেই বিখ্যাত উক্তি মনে পড়ে যেত ‘‘Brevity is the soul of wit”। তাঁর আত্মজীবনীর ট্রিলজি ও গবেষণামূলক কাজগুলো ছাড়া তাঁর বাকী সমস্ত লেখা, বক্তৃতা এমনকি ব্যক্তিগত আলাপ চারিতায় এক অপূর্ব বাক্‌সংযম কারো দৃষ্টি এড়াত না। সব কিছুতেই একটি রুচিসম্মত পরিমিতি বোধ ছিল তাঁর জীবনের প্রধান বৈশিষ্ট্য। অথচ রসবোধ ও কৌতুক প্রায় সবসময় তাঁর কথায় লেগে থাকত। সারাজীবন শিক্ষকতার পেশায় নিয়োজিত থেকেও মানবমুক্তির লক্ষ্যাভিসারী নানামাত্রিক কর্মকাণ্ড, কল্যাণকামী ও বিজ্ঞানমনস্ক বিশ্বদৃষ্টিভঙ্গী ছিল তাঁর ব্যক্তিত্বের বিশিষ্টরূপ। নৈতিক বিবেচনায় মাপকাঠিতেই তিনি সবসময় পথ চলেছেন। মুক্তিযুদ্ধের নেতৃস্থানীয় সংগঠক এবং প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিনের একজন আস্থাভাজন পরামর্শদাতা হয়েও তিনি কদাচ তা সর্বসমক্ষে প্রকাশ করেছেন। ১৯৭৪ সালে স্বয়ং বঙ্গবন্ধু তাঁকে শিক্ষাসচিবের দায়িত্ব গ্রহণের অনুরোধ করলে তিনি তা সবিনয়ে প্রত্যাখ্যান করে বলেন শিক্ষকতার বাইরে তিনি অন্য কোন দায়িত্ব নেয়ার কথা ভাবেন না। অথচ এর পরে অগণতান্ত্রিক সামরিক শাসনামলে সরকারের সচিব বা উপদেষ্টা হিসাবে তাঁর অগ্রজ বেশ কয়েকজন শ্রদ্ধাভাজন শিক্ষক যোগ দিয়ে ফিরে এসেছেন অনেকটা অপমানিত হয়ে। এদিক থেকে তাঁর বিবেচনা ও বাস্তবতাবোধ ছিল অনন্য।
১৯৫২ সালে সবেমাত্র কলেজে ভর্তি হয়েই তিনি সরাসরি ভাষা আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেন। তিনি তখন যুবলীগের সাথে সম্পৃক্ত একজন সক্রিয়কর্মী। যুবলীগ ছিল তখন বেআইনী কমিউনিস্ট পার্টির একটি ছাত্র যুব সংগঠন। বাম আন্দোলনের একজন নিষ্ঠাবান কর্মী আনিসুজ্জামান প্রথম যৌবনে সংগঠনের নির্দেশে মার্কসবাদের পাঠ ও নিয়েছিলেন। তাতে পেয়েছিলেন সংস্কারমুক্ত এক বিশ্বদৃষ্টিভঙ্গী এবং অসাম্প্রদায়িক মানবিক জীবনদৃষ্টি। ১৯৫৬ এবং ১৯৫৭ সালে যথাক্রমে স্নাতক সম্মান ও এম.এ পরীক্ষায় প্রথম শ্রেণীতে প্রথম হয়ে অসাধারণ কৃতিত্বের পরিচয় দেন। ১৯৫৯ সালেই তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা বিভাগে যোগ দেন। শিক্ষকতায় যোগ দিয়ে তিনি সচেতনভাবে সক্রিয় রাজনীতি থেকে দূরে থাকেন, কিন্তু ছাত্রজীবনে যে জীবন দৃষ্টি ও বোধ অর্জন করেছিলেন পরবর্তীতে প্রগতিশীল রাজনীতির একজন সমর্থক হিসাবে আজীবন তা ধারণ করেছেন প্রচণ্ড নিষ্ঠার সাথে। পেশাগত কর্তব্যের পাশাপাশি সর্বজনীন মঙ্গঁলের জন্য নিরন্তর নিজেকে ব্যাপৃত রেখেছেন।
এ ভূখণ্ডের ঝঞ্ঝা বিক্ষুব্ধ সময়ের দুর্নিবার আঘাতে ক্রমাগত অস্থির ও চঞ্চল হয়ে উঠা জনসমুদ্রের উত্তাল আবহে কেটেছে তাঁর পুরো জীবন। কৈশোরে যেমন দেখেছেন ৪৩ এর দুর্ভিক্ষ, সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা ও দেশভাগ এবং নিজ পরিবারের দুঃসহ উদ্বাস্তু জীবন তেমনি ক্রমে মোহভঙ্গ হতে থাকা পূর্ব বাংলার মানুষের নবজাগরনও তিনি ঘনিষ্ঠভাবে প্রত্যক্ষ করেছেন এবং সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেছেন ভাষা আন্দোলন থেকে মুক্তিযুদ্ধ পর্যন্ত বাঙালির প্রত্যেকটি গণসংগ্রামে। মুক্তিযুদ্ধোত্তর দেশের সংবিধান তৈরিতে যেমন যুক্ত ছিলেন তেমনি মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় ঋদ্ধ একটি গণমুখী, সর্বজনীন, বিজ্ঞানমনস্ক শিক্ষানীতি তৈরির কাজে ড. খুদা শিক্ষা কমিশনের একজন গুরুত্বপূর্ণ সদস্য হিসাবে যুক্ত ছিলেন। প্রথম থেকেই আমলাতান্ত্রিক বাধা, ধর্মান্ধ শক্তির নানা কুৎসা এমনকি সবার জন্য একটি অভিন্ন শিক্ষা পদ্ধতি চালুর প্রশ্নে কিছু দেশবরেণ্য সাহিত্যিক ও বুদ্ধিজীবীদের বিরুদ্ধ মত তাঁকে বিস্মিত করেছে। (বিপুলা পৃথিবী পৃ: ২৫)। অনেকে বিস্মৃত হলেও মুক্তিযুদ্ধের বিজয়ের মাত্র ৪ মাসের মাথায় মওলানা ভাসানীর মাদ্রাসা শিক্ষা নিয়ে সরকার ও সেদিনের বিরোধী দল ন্যাপ ও সিপিবি (তখনো জাসদের জন্ম হয়নি) কে ধর্মদ্রোহী বলে যে কুরুচিপূর্ণ ভাষায় আক্রমণ করেছিলেন তা তিনি স্পষ্ট করে উল্লেখ করেছেন (বিপুলা পৃথিবী পৃ:৩৯)। ১৯৭২ থেকে ১৯৭৫ পর্যন্ত মওলানার মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বিরোধী অসংলগ্ন নানা বক্তব্যের উল্লেখ যেমন তিনি করেছেন তেমনি বঙ্গবন্ধুর উপর ক্ষুব্ধ কিছু ছাত্রলীগ কর্মীর জাসদ গঠনের হঠকারী সিদ্ধান্তকেও তিনি মেনে নিতে পারেননি। জিয়ার আমলে খালখনন কর্মসূচি নিয়ে তিনি সিপিবি’র অবস্থানের পরোক্ষ সমালোচনা করেছেন। অন্যদিকে ১৯৭২ সাল থেকেই যে আওয়ামী লীগ ক্রমাগত মুক্তিযুদ্ধের চেতনা থেকে সরে যাচ্ছিল তা তাজউদ্দিনের অপমানজনক অপসারণ, ওআইসিতে যোগদান, ভুট্টোকে ডেকে আনার অপ্রয়োজনীয় ক্ষতিকর সিদ্ধান্ত সহ নানা ঘটনার মাধ্যমে যে ক্রমে প্রকাশ পাচ্ছিল তা তিনি নির্মোহভাবে উল্লেখ করেছেন। এতে মুক্তিযুদ্ধের প্রকৃত চেতনার প্রশ্নে তাঁর সততা, আন্তরিকতা ও রাজনৈতিক পক্ষপাতহীন দৃঢ় অবস্থান প্রকাশ পায়। ১৯৭৫ এর বঙ্গবন্ধুর নির্মম হত্যাকাণ্ডের পরবর্তীতে গড়ে উঠা স্বৈরশাসন বিরোধী আন্দোলন, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা পুনঃ প্রতিষ্ঠার নানা উদ্যোগ, যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবীতে আন্দোলন সহ প্রত্যেকটি আন্দোলনে তাঁর অবস্থান ছিল স্পষ্ট, দ্বিধাহীন ও সক্রিয়।
তাঁর বিপুল সাহিত্য ও গবেষণা কর্ম নিয়ে আলোচনার অবকাশ এখানে নেই- তা একাডেমিশিয়ানদের বিচার্য বিষয় কিন্তু তাঁর আত্মজীবনীমূলক ট্রিলজি “কাল নিরবধি,” “আমার একাত্তর” এবং “বিপুলা পৃথিবী” প্রত্যেক শিক্ষিত ও সচেতন বাঙালির অবশ্য পাঠ্য বলে আমার মনে হয়। “কাল নিরবধিতে” তাঁর পারিবারিক ও ব্যক্তিগত বৃত্তান্ত ছাড়াও পাকিস্তানের জন্ম ও মৃত্যু অর্থাৎ ১৯৪৭ সালের ১৪ই আগস্ট থেকে ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ পর্যন্ত সময়ের নানা কৌতূহলোদ্দীপক সামাজিক রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক আন্দোলন ও ঘটনার বর্ণনা পাওয়া যায়। “আমার একাত্তর” এ মার্চ থেকে ১৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত পুরো মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের অনেক অজানা অথচ দুর্লভ সত্যের সন্ধান পাই। প্রবাসী সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন ছিলেন তাঁর দৃষ্টিতে সে সময়ের সবচেয়ে বিচক্ষণ, প্রাজ্ঞ, মেধাবী ও অসাধারণ দূরদৃষ্টিসম্পন্ন ক্ষণজন্মা একজন রাজনৈতিক নেতা। লেখকের সাথে তাঁর ঘনিষ্ঠ সম্পর্কের কারণে মুক্তিযুদ্ধের দিনগুলোতে আওয়ামী লীগের মধ্যেই তাঁর প্রত্যক্ষ বিরোধিতাকারীদের পরিচয় আমরা জানতে পারি, বুঝতে পারি কেমন করে কাদের দ্বারা বঙ্গবন্ধু ও তাজউদ্দিনের মধ্যে পরবর্তীতে সর্বনাশা দূরত্ব সৃষ্টি হয় এবং ’৭৫ এর রাজনৈতিক বিপর্যয় অনিবার্য হয়ে উঠে। এই দূরত্ব সৃষ্টির রহস্য উন্মোচিত না হলে বঙ্গবন্ধুর হত্যার বিচার অসম্পূর্ণ থাকবে। “বিপুলা পৃথিবী” মূলত মুক্তিযুদ্ধোত্তর রাজনৈতিক দুর্যোগ কবলিত সময় তথা ১৯৭২-২০০০ সাল পর্যন্ত এদেশের ইতিহাস, রাজনীতি ও সামাজিক সংস্কৃতির একটি জীবন্ত ধারাভাষ্য। অনেক সামান্য ঘটনা ও তাঁর বর্ণনায় ও তাৎপর্যের দিক থেকে অসামান্য হয়ে উঠেছে। আমাদের আত্মোপলব্ধির জন্য জাতীয় জীবনে ট্র্যাজিক শুধু দুটি ঘটনার উদাহরণ দিতে চাই। ’৭১ এর নয়মাস ব্যাপী মুক্তিযুদ্ধের মূল পরিচালক তাজউদ্দিন যখন আশাহত হয়ে ১৯৭৪ সালের কোন এক সময় সরকার থেকে পদত্যাগের সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছেন তখন তা কিছুটা জানাজানি হবার পর তাঁকে হঠাৎ একদিন সরকার প্রধানের পক্ষ থেকে “দেশের স্বার্থে” পদত্যাগের নির্দেশ দেয়া হয়। তাতে মর্মাহত আনিসুজ্জামান লিখেছেন “তিনি (তাজউদ্দিন) কেবল স্বেচ্ছায়, মন্ত্রিত্ব ত্যাগের সম্মানটুুকু থেকে বঞ্চিত হলেন। এ অসম্মান তাঁর প্রাপ্য ছিল না।” (বিপুলা পৃথিবী পৃ: ১৩১)। আবার অন্যদিকে দেখি ১৯৭৪ সালে শিক্ষাবৃত্তি নিয়ে লন্ডন যাবার প্রাক্কালে বঙ্গবন্ধুর কাছ থেকে বিদায় নিয়ে চলে আসার মুহূর্তে নিজের জীবন আশংকা আঁচ করে আবেগাপ্লুত বঙ্গবন্ধু তাঁকে দেশে ফিরে দেখা করতে বলার পরপরই অস্ফুট স্বরে স্বগতোক্তি করলেন, “ততদিনে আমাকে প্রধানমন্ত্রী হিসাবে দেখবে কিনা কে জানে!” সেদিন বিস্মিত আনিসুজ্জামানের কাছে তা যেমন মর্মান্তিক ছিল পাঠকের কাছে এতদিন পরেও তা হৃদয়বিদারক বলেই মনে হয়। ১৯৭৪ সালে পরস্পর বিচ্ছিন্ন বঙ্গবন্ধু ও তাজউদ্দিনের এহেন মর্মযাতনা দেখে তাঁর কাছে বুঝতে বাকী ছিল না দেশ তখন কোন দিকে যাচ্ছিল।
একজন শিক্ষক হয়েও সারাজীবনের সততা, আন্তরিকতা, প্রগতিমুখহীন, নির্ভীক কর্মপ্রচেষ্টায় তিনি একটি দেশের ইতিহাসের সাথে কেমন করে নিজের জীবনকে জড়িয়ে ফেলেছিলেন তা ভেবে বিস্মিত হতে হয়। রাজনীতির বাইরে থেকেও রাষ্ট্র ও সমাজের সঠিক প্রয়োজনের সময় অকুতোভয় দৃঢ়তায় ও অকুন্ঠচিত্তে সাড়া দিয়েছেন সব সময়। এমনি করে জাতির বিবেকের আসন লাভ করেছিলেন প্রফেসর আনিসুজ্জামান। নৈতিক কর্তব্য বোধের তাড়নায় অশীতিপর বয়সে আদালতে দাঁড়িয়ে দৃপ্তকন্ঠে যুদ্ধাপরাধীদের নারকীয় হত্যাকাণ্ডের বিচার চেয়ে বলেছেন লক্ষ শহীদের রক্তে ভেজা এ মাটিতে তাদের বিচারের দাবী করাটাও জাতির জন্যে লজ্জার। তাঁর আদর্শ পুরুষ রবীন্দ্রনাথের মতই হয়তো বলতে চেয়েছেন-
“এই বৃহৎ লজ্জারাশি চরণ আঘাতে
চূর্ণ করি দূর করো। মঙ্গল প্রভাতে
মস্তক তুলিতে দাও অনন্ত আকাশে
উদার আলোকে মাঝে, উন্মুক্ত বাতাসে।”

পূর্ববর্তী নিবন্ধমহাফাঁপড়ে পড়লাম
পরবর্তী নিবন্ধহাটহাজারী উপজেলা আওয়ামী লীগের মানববন্ধন