‘আনন্দ শেয়ার করলে বাড়ে, আর দুঃখ শেয়ার করলে কমে’

রাশেদ রউফ | মঙ্গলবার , ২৬ নভেম্বর, ২০২৪ at ১০:২৯ পূর্বাহ্ণ

অত্যন্ত প্রতিভাধর এক বাঙালি। নানা গুণে গুণান্বিত তিনি। চারুশিল্পী, প্রচ্ছদশিল্পী, রম্যসাহিত্যিক, শিশুসাহিত্যিক, সংগঠক, সংগীত সমঝদার। প্রখর দেশপ্রেমী, জাতীয়তাবাদী, মানব দরদি। তিনি সবিহ্‌ উল আলম। বাংলাদেশের চিত্রশিল্প অত্যন্ত সমৃদ্ধ ও বৈচিত্র্যপূর্ণ হলেও এ বিষয়ে লেখালেখি খুব কম, বলা যায় অপ্রতুল। বাংলাদেশের শিল্পীদের সৃজনশীলতার প্রেক্ষাপট, প্রবণতা ও দর্শন নিয়ে তেমন প্রকাশনা চোখে পড়ে না। ফলে চিত্রশিল্পীদের কাজের যথাযথ মূল্যায়ন আমরা প্রত্যক্ষ করি না। তাই সবিহ্‌ উল আলমদের মতো শিল্পীদের কৃতি ও কীর্তি অগোচরে থেকে যায় পাঠকের।

অজস্র ছবি এঁকেছেন সবিহ্‌ উল আলম নানা মাধ্যমে; সাদাকালো, জলরং, তেলরং। সব মাধ্যমেই তাঁর নিজস্বতা সুস্পষ্টভাবে ধরা পড়ে। বইয়ের প্রচ্ছদ অংকনে সবিহ্‌ উল আলম অনন্য। অনেক ক্ষেত্রে পথিকৃৎ। বিশেষত ইসলামিক ক্যালিগ্রাফিতে তিনি রেখেছেন কৃতিত্বের স্বাক্ষর। শিল্পী সবিহ্‌ উল আলমের আঁকায় গভীর অবলোকনের নির্যাস স্পষ্ট। তিনি শিল্পের গভীরে প্রবেশ করতে পারেন বলেই তিনি অতুলনীয় শিল্পী হিসেবে খ্যাতি পেয়েছেন। শিল্প সম্পর্কে ব্যক্তিগত বোধ ও রুচি তাঁর শিল্পকর্মকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন যৌক্তিক ধারায়।

ব্যক্তিগতভাবে আমি লাভ করেছি তাঁর সান্নিধ্য। তাঁর মন আর মনন বিষয়ে যতটা জেনেছি, তিনি ধর্মপরায়ণ, তবে আপাদমস্তক অসাম্প্রদায়িক এক ব্যক্তিত্ব। প্রচারবিমুখ, নীতিবান, সৎ ও নরম প্রকৃতির মানুষ। ঝামেলা এড়িয়ে চলেন। ঠাণ্ডা মাথায় জটিল বিষয়ের সমাধান দেন। মানুষকে ভালোবাসেন নিবিড়ভাবে। তাঁর ব্রত হলো মানুষের সাথে থাকা। তাঁর দর্শন হলো মানব কল্যাণ। তিনি বরাবরই তাঁর পিতা কথাশিল্পী মাহবুবউল আলমের একটা কথার প্রতিধ্বনি করেন। বলেন, ‘আমার জীবনশিল্পী বাবা বলতেন, তিনটা বিষয় মেনে চলার চেষ্টা করো। এক. বছরে একবার হলেও সমুদ্রের কাছে যাবে; সমুদ্রের বিশালতার পাশে নিজের ক্ষুদ্রত্ব ও নগণ্যতাকে উপলব্ধি করে নিজেকে চিনতে পারবে। দুই. সম্ভব হলে বছরে একবারের জন্য সবচেয়ে উঁচু পাহাড়টার চূড়ায় উঠবে; উপর থেকে নিচের ছোটবড় ভেদাভেদগুলো মুছে কিভাবে সবকিছু সমান হয়ে যায় তা শিখবে। তিন. বছরে অন্তত একটা রাত পূর্ণ জ্যোৎস্নায় কাটাবে; সূর্যালোকের প্রখর তীব্রতার বিপরীতে চাঁদনির মোহনীয় স্নিগ্ধতায় মানবিক সৌন্দর্যবোধের পরিচর্যা হবে’।

কথাগুলো ব্যাখ্যার অতীত। উপলব্ধিজাত। অনুভব করলে প্রতিটি কথাই বুকের মধ্যে একটা স্নিগ্ধতা ছড়িয়ে দেয়। শিল্পী সবিহ্‌ উল আলমের আরেকটা দর্শন আমাকে ভাবায়। তিনি বলেন, ‘আনন্দ শেয়ার করলে বাড়ে। আর দুঃখ শেয়ার করলে কমে’। কী সাংঘাতিক কথা। তাঁর কথাগুলো বলছিলাম ২২ নভেম্বর বিটায় আয়োজিত চট্টগ্রাম একাডেমির আনন্দ আয়োজনে। আলম পরিবার চট্টগ্রামের বিখ্যাত পরিবার। এই পরিবারের প্রধান হিসেবে কথাশিল্পী মাহবুবউল আলমের প্রভাব শুধু সেই পরিবারের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়, পুরো সাহিত্যাঙ্গনে প্রবহমান।

বেড়ানোর কথাই বলছিলাম। সমুদ্র বা পাহাড় বা জ্যোৎস্না, সর্বোপরি প্রকৃতির সান্নিধ্যলাভ জরুরি। সবার জন্য এই সুযোগ আসে না। সবাই এই সুযোগ পান না। ভ্রমণের জন্য তিনটি ‘স’ লাগে। একটি ‘সময়’, দ্বিতীয়টি ‘স্বাস্থ্য’ এবং তৃতীয়টি হলো ‘সামর্থ্য’। এই তিন ‘স’ এর সমন্বিত পদক্ষেপে ভ্রমণ। ভ্রমণ বা আনন্দ আয়োজন উপভোগ করা যায় দলবেঁধে কোথাও গেলে। একা সেই আনন্দ উপভোগ করা যায় না। পরিবারের সদস্যদের নিয়ে বা বন্ধুবান্ধবকে নিয়ে এই আনন্দ বেশি উপভোগ্য হয়ে ওঠে। আমরাও সেই আনন্দ উপভোগ করেছিলাম বিটার প্রাকৃতিক পরিবেশে। সেখানে অনেকবার গেলাম, তবু বারবার আমাকে তার শান্ত সুনিবিড় পরিচ্ছন্ন পরিবেশ মোহিত করে। চট্টগ্রাম একাডেমির মহাপরিচালক আমিনুর রশীদ কাদেরীর নেতৃত্বে পরিচালক সৈয়দা রিফাত আকতার নিশু ও পরিচালক রেজাউল করিম স্বপন এবং জীবনসদস্য জসিম উদ্দিন খানের প্রত্যক্ষ সাংগঠনিক ব্যবস্থাপনায় সুসম্পন্ন হয়েছে এই আয়োজন। এতে যুক্ত ছিলেন পরিচালক দীপক বড়ুয়া, শারুদ নিজাম, এস এম মোখলেুসর রহমানসহ অনেকে।

বলছিলাম শিল্পী সবিহ্‌ উল আলমের কথা। বারবার মনে পড়ছিল তাঁর চমৎকার বচন : ‘আনন্দ শেয়ার করলে বাড়ে। আর দুঃখ শেয়ার করলে কমে’। আমরা আনন্দটা শেয়ার করার চেষ্টা করেছি সবার সঙ্গে।

অল্প কয়েকদিন আগে ঢাকায় উদযাপিত হলো শিল্পী সবিহ্‌ উল আলমের ৮৫তম জন্মদিন। তিনি জন্মগ্রহণ করেছিলেন ৮ নভেম্বর ১৯৪০ সালে, চট্টগ্রাম জেলার পটিয়ায়। তবে তাঁর পৈতিৃক নিবাস চট্টগ্রামের হাটহাজারী উপজেলার ফতেয়াবাদ গ্রামে। প্রকাশনা জগতে প্রচ্ছদ এবং অলংকরণশিল্পী হিসেবে সবিহ্‌উল আলম ১৯৬০এর দশক থেকেই এক নামে পরিচিত। মুক্তিযুদ্ধের প্রারম্ভিক পর্যায়ে (মার্চ ১৯৭১) চট্টগ্রামের চিত্রশিল্পীদের পক্ষ থেকে ‘বিক্ষুব্ধ বাংলা’ শিরোনামে ৬টি পোস্টার অংকনে তিনি অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন এবং সেগুলো মুদ্রণের সার্বিক তত্ত্বাবধানও করেন। চট্টগ্রামের শিল্পীকবিসাহিত্যিকদের পক্ষ থেকে ১৯৭১এর ১৬ মার্চ লালদিঘি ময়দানে বিশাল সমাবেশে তিনি ভাষণ দিয়ে আপামর জনগোষ্ঠীকে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে উদ্বুদ্ধ করেন। ১৯৭২ সালে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রসংগঠন ‘অতি সাম্প্রতিক আমরা’র উদ্যোগে ১৩ জন শিল্পীর অংশগ্রহণে ‘আবহমান বাংলা বাঙালি’ শীর্ষক ১০৪ ফুট দীর্ঘ মুর‌্যালএর অন্যতম শিল্পী ছিলেন তিনি। এই মুর‌্যাল কোলকাতার মৈত্রী মেলায় এবং ঢাকায় বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণে প্রদর্শিত হয় এবং সুধীজনদের প্রশংসা কুড়ায়। ১৯৭৩ সালে প্রতিষ্ঠিত নাট্যদল ‘থিয়েটার ৭৩’এর একজন প্রতিষ্ঠাতা সদস্য তিনি। থিয়েটার ৭৩এর প্রথম প্রযোজনা অধ্যাপক মমতাজউদদীন আহমদ রচিত ও নির্দেশিত ‘স্পার্টাকাস বিষয়ক জটিলতা’ নাটকে তিনি ‘স্পার্টাকাসএর ভূমিকায় অভিনয় করেন। তিনি ১৯৭৩ সালে প্রতিষ্ঠিত চট্টগ্রাম চারুকলা কলেজের প্রতিষ্ঠাতা অধ্যক্ষ।

শিল্পী সবিহ্‌ উল আলম উল্লেখযোগ্য সংখ্যক লোগোর নক্সাবিদ, যেগুলোর মধ্যে রয়েছে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ, চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃৃপক্ষ, বায়তুশ শরফ হাসপাতালকক্সবাজার, চিটাগাং স্টক এক্সচেঞ্জসহ আরো বহু সরকারি বেসরকারি প্রতিষ্ঠান।

এছাড়া তিনি চারুকলা বিভাগ (রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়), চারুকলা ইন্সটিটিউট (চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়) এবং চারুকলা বিভাগ (জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়)-এ বেসিক ডিজাইন সম্পর্কিত কর্মশালা পরিচালনা করেন।

শিল্পী সবিহ্‌উল আলম বিভিন্ন স্থাপনা ডিজাইনেও কৃতিত্বের স্বাক্ষর রেখেছেন। ১৯৬০এর দশকে চট্টগ্রাম কলেজের অপয়ঁরৎব কহড়ষিবফমব থিমএর উপর ভিত্তি করে তিনি ডিজাইন করেন কলেজের প্রথম গেইট। পরবর্তীকালে এটি চট্টগ্রামের প্রতিনিধিত্বশীল স্থাপনায় পরিণত হয়। তিনি বেশ ক’টি মসজিদের ডিজাইনও করেছেন। তাঁর কাজের মধ্যে চট্টগ্রামের টিএসপিতে অফিসার্স কলোনি মসজিদ, উসমানিয়া গ্লাসশিট ফ্যাক্টরি মসজিদ, ফেনীর বল্লভপুর গ্রামে নির্মিত ‘জোসনা আরা কাসেম জামে মসজিদ’, নোয়াখালির শরীফপুর গ্রামে নির্মাণাধীন ‘বায়তুশ শরীফ মসজিদ’ এবং ফেনীর পূর্ব দেবপুর গ্রামে ‘বায়তুল আলী জামে মসজিদ’ বিশেষ উল্লেখযোগ্য।

১৯৯০এর দশকে তিনি এবং তাঁর প্রয়াত স্ত্রী সেলিমা সবিহ্‌ ‘হোয়াইটপ্লাস’, ‘স্টারশিপ’, ‘পন্ডস্‌’ ও ‘বাওয়ানীটি’ ইত্যাদির টিভি বিজ্ঞাপনীর মডেলিংএও অংশ নেন। তিনি মানবসেবামূলক প্রতিষ্ঠানসহ বহু সেবামূলক কাজে জড়িত।

কৈশোরকাল থেকে লেখালেখি করলেও তাঁর প্রথমগ্রন্থ ‘পিঁপড়ে নেকলেস ও অন্যান্য গল্প’র আত্মপ্রকাশ ঘটে ১৯৭৩ সালে। ক্রমেই রসাত্মকগল্প রচনায় তাঁর পারদর্শিতা স্পষ্ট হয়ে ওঠে এবং তাঁর রসঘনরচনাসমৃদ্ধ পরবর্তী চারটি গ্রন্থ ‘নিমিত্তমাত্র’, ‘হিজ এক্সেলেন্সী মিঃ ডিসেন্ট্রী’, ‘মাননীয়কচু’ এবং‘ রফিক আনোয়ারের সন্ধানে’ পাঠক সমাজে আদৃত হয়। ইতোমধ্যে সবিহ্‌উল আলম রসাত্মক লেখক হিসেবে কথাসাহিত্যে বিশেষ স্থান করে নেন। এছাড়াও ইসলামিক ফাউন্ডেশনবাংলাদেশ প্রকাশিত তাঁর দু’টি বই ‘লেখা থেকে রেখা’ (ইসলামিক ক্যালিগ্রাফি) এবং ‘কারুকাজে যাদুকর’ (ইসলামিক ডিজাইন) তাঁকে ইসলামিক ক্যালিগ্রাফি এবং নক্সাশিল্পের একজন বিশেষজ্ঞ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করে। এসবের পাশাপাশি তিনি শিশুসাহিত্য রচনায়ও নিয়োজিত হন। তাঁর লেখা শিশুকিশোরদের জন্য বই ‘পিকনিক’, ‘নুযমার গপ্‌পো’ এবং ‘আজব প্রাণীর মজার কথা’ পাঠকদের মাঝে বিপুল সাড়া জাগায়। তাঁর ভাষা যেমন প্রাঞ্জল, তেমনি বাক্যগুলোও সহজসরল। পাঠককে আকৃষ্ট করেন মনোলোভা শব্দের মাধ্যমে। লেখায় ও বলায় তিনি প্রাজ্ঞ ও তুলনাহীন। গল্পের আদলে উপস্থাপন করেন তাঁর সকল বক্তব্য। সবিহউল আলম ১৯৯২ সাল থেকে প্রকাশিত বাংলাদেশের সর্বাধিক জনপ্রিয় শিশুকিশোর পত্রিকা মাসিক টইটম্বুরএর উপদেষ্টা। বিভিন্ন সময়ে টইটম্বুরে তাঁর অনেক লেখাআঁকা ও স্থান পেয়েছে। চট্টগ্রামের আঞ্চলিক ভাষা নিয়ে তাঁর কিছু গবেষণাধর্মী প্রবন্ধও বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় ছাপা হয়েছে। বর্তমানে তিনি জনপ্রিয় শিশুকিশোর মাসিক ‘টইটম্বুর’এর প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে কর্মরত আছেন।

শিল্পী সবিহউলআলম শিক্ষক হিসেবে, অভিভাবক হিসেবে, মানবতাবাদী মানুষ হিসেবে অনন্য। তাঁর দায়িত্ববোধ, কর্মনিষ্ঠা ও অন্যের প্রতি মমত্ববোধ তাঁকে বিশিষ্ট ও অনুকরণীয় ব্যক্তিত্ব করে তুলেছে। শিল্পী সবিহউলআলমকে নিয়ে স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে কারুশিল্পবিদ চন্দ্রশেখর সাহা বলেছেন, ‘আমার চট্টগ্রাম আর্ট কলেজ জীবনের প্রত্যেক শিক্ষকই ছিলেন নিবেদিতপ্রাণ। প্রতিষ্ঠাতা প্রিন্সিপাল সবিহউলআলম চট্টগ্রামের বিখ্যাত শিল্প ও সংস্কৃতিমনস্ক মাহ্বুবউলআলম পরিবারের সদস্য। আজকের চন্দ্রশেখর সাহা হয়ে ওঠার পেছনে তাঁর অবদান অনস্বীকার্য।’

অসাধারণ মেধাবী ও সৃষ্টিধর্মী শিল্পী সবিহ উল আলম। জীবনকে দেখেন ভেতর থেকে আনন্দময় ও কৌতুকময় দৃষ্টিতে। সমাজ ও সমাজের মানুষের প্রতি রয়েছে তাঁর দায়বোধ ও গভীর অনুরাগ। তাঁর উপলব্ধির গভীরতা ও উচ্চতা অত্যন্ত সূক্ষ্ম। তাঁর মূল্যায়ন করা যাবে একমাত্র তাঁর জীবনবোধ দিয়েই।

লেখক : সহযোগী সম্পাদক, দৈনিক আজাদী;

ফেলো (নম্বর:৪২২), বাংলা একাডেমি।

পূর্ববর্তী নিবন্ধএ নগরের যত হাট-বাজার
পরবর্তী নিবন্ধচুয়েটে পাবলিক প্রকিউরমেন্ট শীর্ষক কর্মশালা