বিড়াল ছানাটি এদের এক করে দেয়। অনেক দিন পর এরা একসাথে বসে আলাপ করে। একজন আরেক জনের দিকে তাকিয়ে কথা বলে। আগে এদের মধ্যে তেমন একটা কথা হতো না। যে যার মতো করে সময় কাটাতো। রুমের মধ্যে একা একা বসে থাকতো। প্রায় সময় মোবাইলে ডুবে থাকতো। খাওয়ার টেবিলেও কথা হতো না। মোবাইল কানে লাগিয়ে রাখতো। কেউ কারো দিকে তাকানোর প্রয়োজনও মনে করতো না। খাওয়া দাওয়া সেরে আবার রুমে চলে যেতো। চুপচাপ বসে থাকতো।
ছোট্ট ছানাটি আসার পর ঘরটিতে যেন আনন্দ ফিরে আসে। মিউ মিউ ডাকে এতদিনের নিরবতা ভেঙ্গে যায়। ছোট ছোট পা ফেলে এটি এঘর থেকে ওঘরে ঘুরে বেড়ায়। রুমে রুমে গিয়ে এদের সাথে কথা বলতে চায়। কচি মুখখানি উপরে তুলে মিউ মিউ শব্দ করে। এরা আর না তাকিয়ে পারেনা। মোবাইল ছেড়ে ছানাটির দিকে তাকায়। সে এবার লেজ নাড়ায়। এরা এক ধরণের আনন্দ খুঁজে পায়। হাতের ইশারায় ছানাটিকে কাছে ডাকতে চায়। তখন এটি লেজ নেড়ে নেড়ে মিউ মিউ শব্দ করে ডাকতে থাকে। এরা অবাক নয়নে ছানাটির দিকে তাকিয়ে থাকে।
কয়েক দিনের মধ্যে বিড়াল ছানাটি এদের কাছে খুব প্রিয় হয়ে ওঠে। এরাও সবসময় একে কাছে রাখতে চায়। ছানাটিও এদের আশে পাশে প্রায়ই ঘুরাঘুরি করে। এদেরকে আপনজন মনে করে। খুব তাড়াতাড়ি ছানাটি সবার মনে জায়গা করে নেয়। বড় মেয়েটি এর খাওয়া দাওয়ার দায়িত্ব নেয়। প্রতিদিন সাবান মেখে গোসল করিয়ে দেয়ে। তাওয়েল দিয়ে লোমগুলো ভালো করে মুছিয়ে দেয়। ছানাটি তখন খুব চুপচাপ থাকে। মেয়েটির হাতের যত্নে সে যেন স্নেহের পরশ খুঁজে পায়। এমনিতে নরম লোমগুলো, এদের ছোঁয়া পেয়ে আরো কোমল হয়ে যায়। ছোট্ট ছানাটি নি:শব্দে বসে থাকে।
মেয়েটি বিড়াল ছানার একটি নাম রাখে, ‘ডরিমন’। ঘরের সবাইকে বলে দেয় এ নামে ডাকতে। সে সবসময় ডরিমন ডরিমন বলে ডাকে। কোলে নিয়ে ডরিমন বলে আদর করতে থাকে। কিছু দিনের মধ্যে ছানাটি বুঝে যায় তার নাম ডরিমন। ডরিমন বলে ডাকলে ফিরে তাকায়। বাসার অন্যরাও ডরিমন বলে ডাকে। তবে মেয়েটির মতো এতো নরম স্বরে আর কেউ ডাকে না। সে ডাকলে ছানাটি তার দিকে তাকিয়ে থাকে। অন্যরা ডাকলে একটু থেমে তারপর তাকায়। কোন সাড়া না পেলে আবার হাঁটতে থাকে। লেজ উঁচু নিচু করে হাঁটে, কখনো মিউ মিউ শব্দ করে হাঁটে। ঘরের লবিতে ড্রয়িং রুমে ছোট ছোট পা ফেলে হাঁটে।
মেয়েটি পা গুলোতে রং মেখে রাঙিয়ে দিয়েছে। গলায় নুপুরের মালা পরিয়ে রেখেছে। হাঁটলে নুপুরের শব্দ হয়ে। সামনের পা দুটি খাড়া রেখে পেছনের পায়ের ওপর বসলে দারুন দেখায়। কান দুটি শিকারির মত খাড়া হয়ে থাকে। চোখের দৃষ্টি নড়াচড়া করে না। একদিকে তাকিয়ে থাকে। এরা ছানাটির দিকে তাকিয়ে থাকে। কেউ আবার মোবাইলে ছবি তুলতে চায়। এরকম বসার ভঙ্গিতে ছবি তোলে আরো অনেককে দেখাতে চায়। এসময়ে কেউ এটাকে ডিস্টার্ব করতে চায় না। বসার এ অভিনব ভঙ্গিটা সবার ভালো লাগে। তবে এভাবে বেশিক্ষন বসে থাকে না। কিছুক্ষন পর মিউ মিউ শব্দ করে হাঁটতে শুরু করে। তখন নুপুরের টুং টুং শব্দ ছন্দের মতো বাজতে থাকে।
ডরিমন খেলা করে। হাতের কাছে কিছু পেলে নাড়াচাড়া দিয়ে দেখে। সামনের দু’পা দিয়ে এদিক ওদিক সরায়। বলের মতো কিছু পেলে কথাই নেই। অনেকক্ষন ছুটাছুটি কর্ে। একবার ছেড়ে দেয় আবার লাফ মেরে ধরে ফেলে। দু’পায়ের মাঝখানে খানিক আটকে রাখে। এতে ছোট ছেলেটি ভারি আনন্দ পায়। একটু পরে ডরিমন বলটি ছেড়ে দেয়। ছেলেটি এবার বলটি হাতে নিয়ে উপর থেকে মেঝেতে ফেলে। অমনি বলটি লাফাতে থাকে। তখন ডরিমন দেরি না করে লাফ দিয়ে বলটি ধরে ফেলে। ছেলেটি বাহ বাহ বলে হাততালি দেয়। তখন বাসার অন্যরাও এদের সাথে আনন্দে মেতে উঠে।
ছোট ছেলেটি বিছানায় শুয়ে শুয়ে মোবাইল চালায়। ডরিমন মিউ মিউ করে খাটের চারপাশে ঘুরে বেডায়। কিছুক্ষন পর লাফ দিয়ে বিছানায় উঠে যায়। ছেলেটির কাছে গিয়ে গা ঘেষে দাঁড়ায়। সে আর মোবাইলে থাকতে পারে না। ডরিমনকে টেনে এনে বুকের ওপর বসায়। ডরিমন চুপচাপ বসে থাকে। কিছুক্ষন পর ডরিমন পা চারটি চারপাশে ছড়িয়ে দিয়ে বুকের সাথে লেগে থাকে। তখন ছেলেটির হাত দু’টি ডরিমনের পিঠের উপর পরশ বুলাতে থাকে। এরা দু’জন এভাবে নি:শব্দে অনেকক্ষন শুয়ে থাকে। গভীর মমতায় যেন আবদ্ধ হয়ে পড়ে।
বড় ছেলেটি একটু অন্যরকম। সবমসয় পরিস্কার পরিছন্ন থাকে। নিজের কাপড় চোপড় নিজেই ধুয়ে ফেলে। রুমে অন্য কারো ঢুকা পছন্দ করে না। ভাই বোনের সাথে কথা নেই বললে চলে। বোনের সাথে একদম না। সেও এখন কয়েক ঘন্টা বিড়াল ছানার সাথে কাটায়। রাতে ঘন্টা খানেক ডরিমনকে কোলে নিয়ে বসে থাকে। তার সাথে এটা সেটা বলে। হাত ওয়ালা চেয়ারটাতে সে আগে বসে। তাওয়েল একটা কোলের ওপর বিছায়। তখন বোনটি বিড়াল ছানাটি নিয়ে তার কোলের ওপরে রেখে আসে। মিউ মিউ শব্দ করে ছানাটি ছেলেটির মুখের দিকে তাকায়। সেও মিউ মিউ বলে তার সাথে সুর মিলায়। আবার নিজের হাঁটু দুটি নেড়ে নেড়ে ডরিমনকে দোল খাওয়ায়।
বাবা ঘরে এলে মা বিড়াল ছানাটিকে আয় আয় করে ডাকে। ডরিমন ভেতর থেকে মিউ মিউ শব্দ করে সাড়া দেয়। কাছে এসে বাবার দিকে মুখ উচুঁ করে তাকায়। ‘তুমি কেমন আছো’ বলতেই মিউ মিউ করে বাবার চারপাশে ঘুরে। লেজটা তখন উপরের দিকে অনেকটা খাড়া করে রাখে। বাবা খানিক দাঁড়িয়ে পা বাড়ালে ছানাটিও পা বাড়ায়। সামনের ছোট ছোট পা দুটি বাবার পায়ের ওপর তুলে দেয়। এক ধরনের কোমল স্পর্শে বাবা আবার জানতে চায়। ‘তোমার খাওয়া দাওয়া হয়েছে, গোসল সেরেছো’। মা এবার জবাব দেয়, ‘বেশি খেলে মোটা হয়ে যাবে। গোসল মেয়ের সাথে করবে।’ ছানাটি কিন্তু সহজে বাবাকে ছাড়তে চায় না। পায়ে পায়ে হাটতে থাকে। খাওয়ার টেবিলে বসলেও আশে পাশে ঘুরতে থাকে। একটু পরে ছোট ছেলেটি রুম থেকে বের হয়ে আসে। ডরিমনকে হাতে তুলে ভেতরে নিয়ে যায়।
ডরিমন খুব ফুর্তিবাজ। সবসময় আনন্দে থাকতে চায়। কিছু না কিছু নিয়ে খেলা করতে চায়। পাশ দিয়ে কিছু গেলে শিকারির মতো দৃষ্টি মেলে তাকায়। ছোট ছোট মায়াময় চোখ দুটি তখন আরেক রকম লাগে। এরা বলে বড় হলে ডরিমন শিকারি বিড়াল হয়ে যাবে। তখন এভাবে আর কাছে কাছে থাকবে না। মেয়েটি সব সময় চোখে চোখে রাখতে চায়। ভাইদের কাছে থাকলেও সে নজর রাখে। কার কাছে কতক্ষন থাকবে সে ঠিক করে দেয়। আবার তিনজন একসাথে বসে ছানাটির সাথে সময় কাটায়। খেলা ধুলা করে। একজনের কোল থেকে আরেক জনের কোলে তুলে নেয়। গল্প গুজব করে। হাসাহাসি করে। বিড়াল নিয়ে কত কথাই বলে। কখনো মা এসে যোগ দেয়। এরা বিড়াল নিয়ে আনন্দে মেতে থাকে। কখনো আবার বাবা দরজার কাছে এসে দাঁড়ায়। এসময় বিড়াল ছানাটি মিউ মিউ শব্দ করে ডাকে। মা তখন বলে উঠে, ‘তোমাকে ডরিমন ডাকছে, এখানে এসে বসো’। বাবা ভেতরে গিয়ে বসতেই ডরিমন লাফ দিয়ে বাবার কোলে গিয়ে বসে। ছেলে–মেয়ে সবাই আনন্দে হাততালি দিতে থাকে। আর ডরিমন মিউ মিউ শব্দ করে ডাকে। তখন ঘরটা অন্যরকম আনন্দে ভরে ওঠে।