আনন্দলোকে মঙ্গলালোকে

এমরান চৌধুরী : যিনি ছবি হয়ে গেলেন

রাশেদ রউফ | মঙ্গলবার , ৯ ডিসেম্বর, ২০২৫ at ৭:১০ পূর্বাহ্ণ

শিশুসাহিত্যিক এমরান চৌধুরী হঠাৎ ছবি হয়ে গেলেন। তাঁর মৃত্যু আমাদের প্রত্যেককে নাড়া দিয়েছে। তাঁর মতো নিরহংকার, আত্মমর্যাদাসম্পন্ন ব্যক্তিত্ব এ সমাজে বিরল। অতি সম্প্রতি তাঁর সম্পাদিত ‘আলোর পাতা’র তিনটি বিশেষ সংখ্যা প্রকাশ করে তিনি অনন্য ভূমিকা পালন করেছেন। একটি কিশোরগল্প সংখ্যা, একটি ছড়া সংখ্যা এবং একটি কিশোরকবিতা সংখ্যা। তিনটি সংখ্যাই সমৃদ্ধ সংখ্যা। দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলের লেখকদের লেখা এতে স্থান পেয়েছে। আসলে বাংলাদেশের শিশুসাহিত্যে এমরান চৌধুরী অনিবার্য এক নাম। নানা শাখায় ছিলো তাঁর বিচরণ। ছড়া, কিশোরকবিতা, গল্প, উপন্যাস, নাটক, প্রবন্ধ, জীবনী, গবেষণাপ্রায় সব শাখায় তিনি ছিলেন স্বচ্ছন্দ ও নিবেদিত। একজন পরিপূর্ণ শিশুসাহিত্যিক। প্রচুর লিখেছেন তিনি। লিখেছেন সস্নেহে, সযত্নে, সনিষ্ঠায়। গত ৪০ বছর ধরে শ্রম, সাধনা ও মেধার সম্মিলন ঘটিয়ে শিশুসাহিত্যের নতুন দিগন্তের সন্ধানে যে ভূমিকা নিরবচ্ছিন্নভাবে পালন করেছেন, তাঁর জন্য তিনি পেয়েছেন খ্যাতি ও পরিচিতি। শিশুতোষ ছড়াকবিতা রচনায় যেমন এমরান চৌধুরী অতুলনীয়, তেমনি সমাজমনস্ক ছড়া রচনাতেও তিনি নিপুণকারিগর। তাঁর কিছু কিছু লেখা শিশুরঞ্জনি হিসেবে কাজ করে, আবার কিছু লেখার চারিত্র্যধর্ম একটু অন্যধরনের।

তাঁর লেখার বিশেষত্ব হলো ছোটো বড় সকলেই তাঁর লেখা পড়েন এবং পছন্দ করেন। ছোটোদের মনের নানান সূক্ষ্ম ক্রিয়াপ্রতিক্রিয়াগুলো তিনি গভীরভাবে অনুধাবন করেছেন। তাদের আবেগঅনুভূতি, আশাআকাঙ্ক্ষা, ভাবনাচিন্তা, কল্পনাগুলি অনুভব করেছেন অন্তর দিয়ে। ফলে তাঁর রচনায় আমরা প্রত্যক্ষ করি এর সুন্দর ও সহজ প্রতিফলন। তাঁর মন জুড়ে ছিল শিশুরা।

আশা গঙ্গোপাধ্যায় তাঁর ‘শিশুসাহিত্যের স্বরূপ’ প্রবন্ধে উল্লেখ করেছেন, ‘যথার্থ শিশুসাহিত্য বলিতে তাহাই বুঝিব, যাহা সর্ব্ব বয়সের নরনারীর কাছেই একটি রসাস্বাদ আনিয়া দেয়, বয়সের পার্থক্য অনুসারে আস্বাদনের ব্যাপারে কিছু বিভিন্নতা ঘটিতে পারেকিন্তু সর্বস্তরের মানুষকে আনন্দ দান করিবার মতো শিল্পগুণ তাহাতে থাকিবেই।’ অতএব, আমরা বলতে পারি, এমরান চৌধুরীর রচনা সব বয়সী পাঠকের জন্য। সমালোচকরা তাঁর সাহিত্যকে মহৎ সাহিত্য হিসেবে বিবেচনা করেন। তাঁর অধিকাংশ রচনা যেমন সরস ও সুস্বাদু হবার পাশাপাশি বৃহত্তর জগতের সন্ধান দেয়, তেমনি আনন্দরসের মাধ্যমে প্রতিভাত হয় চারপাশের জগৎ ও জীবন। তাঁর সাহিত্য আক্ষরিক অর্থে চিরায়ত সাহিত্য। সব শ্রেণির পাঠক এর ভোক্তা।

এমরান চৌধুরী ছোটোদের জন্য গড়ে তুলেছেন এক নিটোল নির্মল জগৎ। সে জগৎ হাসিখুশির, আনন্দমজার, স্নেহভালোবাসার। বড়োদের জগতের বাইরে এ জগৎটা ভিন্ন এক জগৎ। এর লক্ষ্য কেবল আনন্দ খোঁজা, এর উদ্দেশ্য শুধু হাসিখুশির সন্ধান পাওয়া। ছোটোদেরই একান্ত জগৎ। মনের কোণে নিভৃত এ জগৎটিকে অসাধারণ উপমায় সাজিয়েছেন তিনি।

তাঁর স্বাতন্ত্র্য ও কৃতিত্ব এখানেই যে, মজা ও আনন্দের উপাদানের মধ্য দিয়ে তিনি তাঁর পাঠককে অসাধারণ কিছু বাণী বা বক্তব্য উপহার দিয়েছেন, যা অবশ্যই শিক্ষণীয়। শিশুমনস্তত্ত্ব গভীরভাবে অনুধাবন করে তাদের পছন্দের জগৎকে ছড়ায় যেমন রূপদান করেছেন, তেমনি তাদের সুষ্ঠু মানসিক বিকাশের লক্ষ্যে কাজ করেছেন অত্যন্ত সূক্ষ্মভাবে। ছোটোদের মানসগঠনে সাহিত্যিকদের ভূমিকা যে অসামান্য, তা তিনি মনে রেখেছেন সব সময়।

এমরান চৌধুরীর আরেক কৃতিত্ব হলো বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রাম, মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস ও বঙ্গবন্ধুর দর্শন সম্পর্কে ছোটোদের অবগত করা। তাঁর বিভিন্ন লেখার মাধ্যমে তিনি ছোটোদের ইতিহাস সচেতন করে তোলার চেষ্টা করেছেন। ‘বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম’ তেমন একটি বই। বইটি সম্পর্কে এমরান চৌধুরী নিজে বলেন, ‘বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস নিয়ে অনেক মূল্যবান গ্রন্থ রচিত হয়েছে, ভবিষ্যতেও হবে এটা নিশ্চিত করে বলা যায়।

কারণ এক সাগর রক্তের বিনিময়ে হাজার বছরের স্বপ্ন পূরণের কথা মাত্র পঞ্চাশ বছরে লিখে শেষ করার কথা নয়। স্বাধীনতার জন্যে ছকিনা বিবির মতো হাজারো মাবোনের বিধ্বস্ত হওয়ার উপাখ্যান যুগ যুগ ধরে রচিত হতে থাকবে। এ রকম হাজারো গ্রন্থের মাঝে আমার এ প্রয়াস সিন্ধুর মাঝে বিন্দুমাত্র। অনেকটা ভালোবাসার তাগিদেই এই প্রচেষ্টা। আমি ইতিহাসের ছাত্র নই, ফলে ইতিহাসের স্বরূপ, প্রকৃতি ও পদ্ধতি সম্পর্কে আমার ধারণা অবশ্যই শূন্যের কোঠায়। তাই আমি পাঠকদের বলবো, এই গ্রন্থটি ইতিহাস নয় বরং ঐতিহাসিক ঘটনার বর্ণনা মাত্র’।

এ বক্তব্যে লেখকের বিনয় ফুটে উঠলেও আমরা বইটিকে গুরুত্বপূর্ণ হিসেবে বিবেচনায় আনতে চাই। এ পর্যন্ত অনেকগুলো বই বের হয়েছে তাঁর। এর মধ্যে রয়েছে: ছড়াকবিতা: থির দুপুরে বিজন পথে, স্বাধীনতা মানে পাখিরাই জানে, আমার আছে তিনটা মামা, খোকার বাড়ি অনেক দূর, সমকালীন ছড়া, ঋতুর খেলা ছড়ার মেলা। গল্প: চিকন খোলার ভূত, মুক্তিযুদ্ধের একদিন, গল্পগুলো মজার, টুকটুকি ও টিকটিকি, একাত্তরের গল্প শোনো, গল্পে গল্পে মহানবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম)। প্রবন্ধ: ফাদার অব দ্য নেশন, বাংলাদেশের স্বাধীনতার সংগ্রাম, ভাষা আন্দোলনের কিশোর ইতিহাস, জাতির সূর্যসন্তান সাত বীরশ্রেষ্ঠ; জীবনী: যুগের প্রতীক মওলানা মনিরুজ্জমান এছলামাবাদী, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। সম্পাদনা: মুক্তির ছড়া, একুশের ছড়া একুশের কবিতা, ছড়া কবিতায় বঙ্গবন্ধু।

এসবের বাইরে এমরান চৌধুরী কলামিস্ট হিসেবে লিখেছেন প্রচুর কলাম। সমকালীন প্রসঙ্গ নিয়ে চমৎকার বিশ্লেষণ তাঁর। লেখালেখির জন্য তিনি পেয়েছেন চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন সাহিত্য পুরস্কার, পেয়েছেন বাংলাদেশ শিশুসাহিত্য একাডেমি পদকসহ অনেকগুলো পুরস্কার ও সম্মাননা। এমরান চৌধুরীর জন্ম ১৮ ফেব্রুয়ারি, ১৯৫৯, চট্টগ্রামের চন্দনাইশের পূর্ব কেশুয়ায়। মৃত্যু ৫ ডিসেম্বর ২০২৫। আমরা তাঁর স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা জানাই।

লেখক : সহযোগী সম্পাদক, দৈনিক আজাদী; ফেলো,

বাংলা একাডেমি।

পূর্ববর্তী নিবন্ধবিনিয়োগ ও ব্যবসার জন্য আস্থার পরিবেশ সৃষ্টি করুন
পরবর্তী নিবন্ধএনইআইআর বাস্তবায়নের দাবি ফোন নির্মাতাদের