বাংলাদেশ তরুণ কলাম লেখক ফোরাম, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় শাখার আমন্ত্রণে গত ২৯ জুন গিয়েছিলাম বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে। তারা আয়োজন করেছিল লেখালেখি বিষয়ক মাসব্যাপী কর্মশালা। সমাজবিজ্ঞান অনুষদের সম্মেলন কক্ষে আয়োজিত এ কর্মশালায় প্রবেশের আগে পরিচিত হই তরুণ লেখক ফোরাম, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সভাপতি মাহফুজুর রহমান, সাংগঠনিক সম্পাদক আজিজুল হক রাহি, অর্থ সম্পাদক সুমন চৌধুরী, দপ্তর সম্পাদক কারিশমা ইরিন এ্যামি, উপ–দপ্তর সম্পাদক ইসমাইল হোসেন ইমন, সাহিত্য ও প্রকাশনা সম্পাদক মুহাম্মাদ রিয়াদ উদ্দিন, প্রশিক্ষণ বিষয়ক সম্পাদক, মোঃ রাসেল হোসেন এবং কার্যনির্বাহী সদস্য ছাদেক হোছাইন ও আজিজ ওয়েসির সঙ্গে। যদিও এর আগেও কয়েকবার আমি গিয়েছিলাম তাদের প্রশিক্ষক হিসেবে। গত বছর যে সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়েছিল, সেখানেও উপস্থিত ছিলাম কথাসাহিত্যিক আনিসুল হকের সঙ্গে। তবু এবার নতুন আনন্দ ও নতুন প্রতিভা অন্বেষণে উদ্দীপ্ত ছিলাম আমি। এবারে আমার সঙ্গে ছিলেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় বাংলা বিভাগের শিক্ষক সুজন আরিফ। সাহিত্য রচনা ও সম্পাদনার কলাকৌশল নিয়ে তিনি আলোচনা করছিলেন।
সুজন আরিফ একজন প্রতিভাবান কবি। তাঁর প্রথম বই ‘খুন ও ক্ষরণের কাল’ প্রকাশিত হয় ২০২৩ সালে। ঠিক দু বছর পর ২০২৫ সালে প্রকাশিত হয় দ্বিতীয় গ্রন্থ ‘বিপরীত চাঁদের মুখ’। এটির প্রচ্ছদ করেছেন আল নোমান, প্রকাশ করেছে আবির প্রকাশন। কাব্যগ্রন্থে স্থান পাওয়া কবিতাগুলো পড়ে আমি অভিভূত হয়েছি। রীতিমতো বিস্মিত হয়েছি কবির উপমা, ভাষাবোধ এবং বাকপ্রতিম সক্ষমতা দেখে। কাব্যপাঠে এই যে পরিতৃপ্তিবোধ– এটাই কবির সাফল্য।
কবিতা কখনো আবেগ কেন্দ্রিক, কখনো অনুভূতিপ্রবণ মনের বহিঃপ্রকাশ, কখনো সমকালের মুখপাত্র, কখনো শাব্দিক ঝংকার, কখনো বেদনাবিধুর হৃদয়ের আর্তি, কখনো শোকাহত হৃদয়ের আর্তনাদ, কখনো সংগ্রামী সশস্ত্র সৈনিক, কখনো বা অধিকার বঞ্চিত শ্রমজীবী মানুষের আত্মকথন। এক বিশেষ মুহূর্তে নির্মিত হয় কবিতা। গদ্য যে–কোনো সময় লেখা যায়, কিন্তু কবিতা লেখা যায় না। কবিতা আবেগের বহিঃপ্রকাশ। জোর করে হয় না। ধস্তাধস্তি চলে না। কবিতার জন্য চাই সুস্থির মন। হৃদয়, মস্তিষ্ক, শব্দ এবং অর্থের যথার্থ মিলনের ফলেই কবিতার জন্ম হয়। আচার্য বামন বলেছিলেন– ‘কাব্যং গ্রাহ্যং অলংকারাং’। অর্থাৎ কাব্য বা কবিতা গ্রাহ্য হয় অলংকারের দ্বারা। অলংকার আবার দুই ধরনের। শব্দালংকার এবং অর্থালংকার। শব্দালংকার কবিতাকে শব্দধ্বনিগত সৌন্দর্য দান করে আর অর্থালংকার কবিতাকে অর্থগত সৌন্দর্য দান করে। কারো কারো মতে, নিরূপিত ছন্দে রচিত না হয়েও কবিতার মধ্যে এক ধরনের ছান্দিক সৌন্দর্য প্রকাশ পায়। কবিতা আমাদের চিন্তা–চেতনাকে জাগ্রত করে, প্রেরণা দেয়। কবিতা আমাদের সৃষ্টিশীল করে। কবিতা আমাদের জীবনকে ভালোবাসতে শেখায়। কবিতা আমাদের আত্মসংস্কৃতিকে ও জাতীয় সংস্কৃতিকে সমৃদ্ধ করে। কবিতা পাঠকের অন্তরঙ্গতা ও আন্তরিকতা দাবি করে। রবীন্দ্রনাথের মতে, ‘রূপের মধ্যে অরূপের সন্ধানই কবিতা।’ বুদ্ধদেব বসু বলেছেন, ‘কবিতা সম্বন্ধে ‘বোঝা’ কথাটাই অপ্রাসঙ্গিক। কবিতা আমরা বুঝি না, কবিতা আমরা অনুভব করি। কবিতা আমাদের ‘বোঝায়’ না; স্পর্শ করে, স্থাপন করে একটা সংযোগ। ভালো কবিতার প্রধান লক্ষণই এই যে তা ‘বোঝা’ যাবে না,‘বোঝানো’ যাবে না।’ কার্লাইল বলেছেন, ‘কবিতা হলো মিউজিক্যাল থট।’ অন্যদিকে, জীবনানন্দ দাশ বলেছেন, ‘উপমাই কবিতা।’ উপমা এমন এক অনুষঙ্গ, তার কাছে প্রায় সব কবিকেই ফিরতে হয়। কবি সুজন আরিফও উপমার কাছে থাকতেই স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন। তাঁর কবিতায় বিচিত্রময় উপমার প্রয়োগ ও প্রাসঙ্গিকতা আমাকে মুগ্ধ করেছে। কিছু কিছু উপমা হৃদয়কে দারুণভাবে স্পর্শ করেছে। তাঁর কবিতার মধ্য দিয়ে আমরা আমাদের পারিপার্শ্বিকতাকে দেখে নিতে পারি।
যেমন :
হারিকিরি রাতগুলো বড্ড বেয়াড়া
ধ্রুপদী শূন্যতায় অবিরাম টোকা দেয় মুরাকামি ঘোর
একদিকে আঙুলের নৃত্যে টালমাটাল পাহাড়ি রাতের স্তন
অন্যদিকে জানালায় খটখট মার্কেজের জাদুকর ফানুস
রাবীন্দ্রিক জোছনায় ছেয়ে যায় সংকীর্ণ ফুলের বাগান
তবুও কবি হওয়ার স্বপ্নে কাতর
সর্বদাই গণিতে ভীতু এক বিভ্রান্ত যুবক।
অন্যদিকে, তিনি লিখলেন : ‘আঁধারে রূপায়িত ধনকুবের চাঁদ/ নিদ্রার শরীরে যেন মাতাল যিশুর ঐশ্বর্য’। আবার লিখলেন: ‘করাতকলে বিছানো ধ্রুপদী রাতের শরীর’, কিংবা, ‘দার্শনিক বোধে ভেঙে দেয় মৃত্যুমুখী পাথরের ঘুম’, কিংবা, ‘ষোড়শী রাতের বিছানায় জেগে ওঠে দ্রোহের সেতার’। এরকম অসংখ্য পংক্তি আমাকে প্রাণিত করেছে।
উপমা, চিত্রকল্প, প্রতীক সৃজন, অনুভব, ছন্দের গতি– সব মিলিয়ে সুজন আরিফ তৈরি করেছেন অপ্রতিম কাব্যভাষা। তাঁর ব্যবহৃত উপমাগুলো আলাদা, অন্যদের থেকে ব্যতিক্রম। এছাড়াও নান্দনিকতাঋদ্ধ এসব উপমা তাঁর কবিতাকে বিশেষভাবে শনাক্ত করতে সাহায্য করবে। তাঁর কবিতা সমৃদ্ধ হয়ে উঠেছে প্রকৃতি ও দেশজ উপাদানে। আবহমান বাংলার ঐতিহ্যময় নিসর্গ ও পুরাণ তাঁর কবিতাকে করে তুলেছে চিত্রকল্পময়। তাঁর কবিতার শিল্পসফল চিত্রকল্প ও উপমার ব্যবহার আমাদের মনকে জাগ্রত করেছে, চিত্তকে করেছে উজ্জীবিত।
সুজন আরিফ তাঁর কবিতায় সমকালকে অংকন করেছেন চমৎকারভাবে। সমসাময়িকতার প্রশ্নে শঙ্খ ঘোষের একটা বক্তব্য এখানে তুলে ধরছি। তিনি বলেছিলেন, ‘সমসাময়িক হবার জন্য কোনো স্বতন্ত্র চেষ্টার বা স্বতন্ত্র রূপের দরকার আছে বলে মনে হয় না। যেকোনো সত্যাশ্রয়ই কবিতাকে সমসাময়িকতা দেয় চিরন্তনের অভিমুখে।’ সমকালীন সমাজের চিত্র তুলে ধরতে যে সব বিষয় ও পংক্তির অবতারণা করেছেন, তা এককথায় বিস্ময়কর। অবলীলায় বলেছেন : ‘প্রাচীরের ওপারে ওৎ পাতা পুরনো শকুন/ একদিন দগ্ধ হবে ভিসুভিয়াসের উত্তপ্ত লাভায়।’ বিভিন্ন বিষয়কে নিজের মতো বর্ণনা করে নিজস্ব ভাষাশৈলী দাঁড় করাতে চেয়েছেন তিনি।
সিকান্দার আবু জাফর বলেছেন, ‘আমি কবিতা লিখি অনায়াসে। যেমন সকলেরই ক্ষেত্রে জীবনের আশে–পাশে অসংখ্য সুলভ দুর্লভ মুহূর্ত নানা রূপে অনাবৃত হয়েছে আমার সামনে। আমি কোনো কোনো সময় সেই সব মুহূর্তের স্বাক্ষর লিপিবদ্ধ করেছি সত্য–বিচ্যুতি না ঘটিয়ে। সেই আমার কবিতা।’ সুজন আরিফও সত্য–বিচ্যুতি না ঘটিয়ে জীবনকে চিত্রায়ন করেছেন তাঁর কবিতায়।
আসলে কবিতা এক সৃষ্টিকর্ম, তা কবির উপলব্ধিজাত বিশেষ শিল্পভাবনা। কবির মনে যা কিছু অনুরণন হচ্ছে, ভাবনার ওঠা–নামা চলছে; তাকে শিল্পে রূপদানই হলো কবিতা। এক কথায় কবির সৌন্দর্যভাবনার বহিঃপ্রকাশ। সমালোচকদের মতে, ‘কবিতা হচ্ছে এমন জিনিশ, যার মধ্যে অন্তত এক ফোঁটা আত্ম–আবিষ্কারের চিহ্ন লেগে থাকে’।
‘বিপরীত চাঁদের মুখ’ গ্রন্থের কবিতাগুলোতে আমরা কবি সুজন আরিফের সৌন্দর্যভাবনাকে আবিষ্কার করতে পেরেছি। তাঁকে অভিনন্দন।
লেখক : সহযোগী সম্পাদক, দৈনিক আজাদী; ফেলো, বাংলা একাডেমি।