‘দাও শৌর্য দাও ধৈর্য হে উদার নাথ’

রাশেদ রউফ | মঙ্গলবার , ৮ এপ্রিল, ২০২৫ at ৭:০১ পূর্বাহ্ণ

আজ এক মানবতাবাদী সমাজদরদি হৃদয়বান মানুষের কথা বলবো। তার আগে আমাদের সম্মানিত পাঠকের সামনে কিছু প্রাসঙ্গিক কথা তুলে ধরতে চাই। বলা যায়, সারাবিশ্ব এখন হানাহনিতে লিপ্ত। অন্যদের কথা বাদ দিলাম, আমাদের এ দেশও এখন হিংসায় আক্রান্ত। এদেশের অনেকেই এখন অন্যের পেছনে লেগে থাকাটাই পছন্দ করে। কাউকে আঘাত করার মধ্যে যেন এদের আনন্দ। এই অশান্ত ও উন্মত্ত পৃথিবীর চারপাশে এতো এতো বিরোধিতা ও উদ্দেশ্যমূলক ভ্রান্ত প্রচারে নিজেকে সামলে রাখা বড়ই কঠিন। উগ্র প্রতিপক্ষের অশ্রাব্য আস্ফালন ও তীব্র বিরূপ সমালোচনা মানুষকে স্থির রাখতে পারে না। আমরা যতই বলি, ধৈর্য ধারণ এক্ষেত্রে উৎকৃষ্ট উপায়। তবু বলি ব্যর্থরাই কেবল বিরূপ পথে অগ্রসর হয়।

আমি ব্যক্তিগতভাবে মনে করি, সামাজিক জীবনের মতো সকল সৃজনশীল কর্মকাণ্ডে সহনশীলতার প্রয়োজন রয়েছে। আমরা যখন একই ক্ষেত্রে কাজ করি, তখন বিনা কারণে পরস্পরের মধ্যে সৃষ্টি হয় বিরোধিতা। এই বিরোধিতা কখনো কখনো সৌজন্যবোধ ও ভদ্রতার দেওয়াল লঙ্ঘন করে। সকলের রুচি ও মনমানসিকতা এক রকম নয় বলে পারস্পরিক বিরোধ ক্রমশ প্রতিহিংসায় রূপ নেয়। এর থেকে পরিত্রাণের একমাত্র উপায় হলো ধৈর্য ধারণ, প্রয়োজন সহিষ্ণুতার। সহিষ্ণুতা এমন এক মহৎ গুণ, যা জীবনে বিশেষ অর্থবহ ভূমিকা পালন করে থাকে। মনোবিজ্ঞানীদের মতে, ‘পরস্পর বিরোধ এড়িয়ে, প্রতিপক্ষকে শত্রু বলে বিবেচনা না করে সহযোগিতার মাধ্যমে কাজকর্ম চালিয়ে গেলে সেখানে সহিষ্ণুতার নিদর্শন মেলে। সকল কাজের শুভ পরিণতি আনয়নে সহিষ্ণুতা সাহায্য করে। যোগ্যতা দিয়ে মানুষ সমাজে টিকে থাকে। সে যোগ্যতা প্রদর্শন ও তার ফল হাতে না আসা পর্যন্ত ধৈর্য ধারণ করে অপেক্ষা করতে হবে।’

আসলে জীবনে সাফল্য পেতে ধৈর্য ধরার বিকল্প নেই। যার ধৈর্য ধরার ক্ষমতা কম, তিনি সফল হতে পারেন না। তিনি অধৈর্য হয়ে অনেক সময় এমন সিদ্ধান্ত নিয়ে নেন, তা পরে তার জন্য ক্ষতিকরও হতে পারে। কথায় বলে : রেগে গেলে তো হেরে গেলে। ফলে অনেক সময় রাগ, হতাশা, ব্যর্থতায় কাবু হয়েও যেন আমরা ধৈর্য হারিয়ে না ফেলি। কঠিন পরিস্থিতিতেই সবচেয়ে বেশি ধৈর্য ধারণ করা প্রয়োজন। ধৈর্য গুণটি নিজের মধ্যে ধারণ করা কি সহজ কাজ? কাজী নজরুল ইসলামের মতো প্রার্থনা করতে হবে :

দাও শৌর্য দাও ধৈর্য হে উদার নাথ

দাও দাও প্রাণ।

দাও অমৃত মৃতজনে

দাও ভীতচিত জনে শক্তি অপরিমাণ

হে সর্বশক্তিমান।

দাও স্বাস্থ্য দাও আয়ু

স্বচ্ছ আলো মুক্ত বায়ু,

দাও চিত্ত অনিরুদ্ধ দাও শুদ্ধ জ্ঞান

হে সর্বশক্তিমান।’

ধৈর্যএর জন্য প্রয়োজন চর্চা। প্রয়োজন অভ্যাসের পরিবর্তন, চিন্তার পরিবর্তন। বহুদিন আগেই আমাদের সর্বশ্রেষ্ঠ কবি সৌন্দর্যের ধৈর্য বিষয়ে লিখেছিলেন, ‘সৌন্দর্যের কি অসামান্য ধৈর্য! এমন কতকাল ধরিয়া প্রভাতের পরে প্রভাত আসিয়াছে, পাখীর পরে পাখী গাহিয়াছে, ফুলের পরে ফুল ফুটিয়াছে, কেহ দেখে নাই, কেহ শোনে নাই। যাহাদের ইন্দ্রিয় ছিল কিন্তু অতীন্দ্রিয় ছিল না, তাহাদের সম্মুখেও জগতের সৌন্দর্য্য উপেক্ষিত হইয়াও প্রতিদিন হাসিমুখে আবির্ভূত হইত। তাহারা গানের শব্দ শুনিত মাত্র, ফুলের ফোটা দেখিত মাত্র। সমস্তই তাহাদের নিকটে ঘটনা মাত্র ছিল। কিন্তু প্রতিদিন অবিশ্রাম দেখিতে দেখিতে, অবিশ্রাম শুনিতে শুনিতে ক্রমে তাহাদের চক্ষুর পশ্চাতে আরেক চক্ষু বিকশিত হইল, তাহাদের কর্ণের পশ্চাতে আরেক কর্ণ উদঘাটিত হইল। ক্রমে তাহারা ফুল দেখিতে পাইল, গান শুনিতে পাইল। ধৈর্য্যই সৌন্দর্যের অস্ত্র।’

কী মারাত্মক কথা, ধৈর্য সৌন্দর্যের অস্ত্র!

মনোবিজ্ঞানীরা বলেন, ‘প্রতিকূল পরিবেশে নিজের চিন্তাভাবনা নিয়ে সচেতন থাকতে হবে। কোনোভাবেই মেজাজ হারালে চলবে না। আনন্দ বা স্বস্তি দেয় এমনকিছুতে ফোকাস করে নিজেকে ধৈর্যশীল করতে হবে। সহানুভূতিশীল হওয়ার চেষ্টা করুন, ক্ষমাশীল হোন। নিজের ব্যর্থতা না খুঁজে সম্ভাবনাময় দিকগুলো নিয়ে কাজ করুন।’

শুরুতেই যেমানুষটির কথা বলবো বলেছিলাম, তিনি একজন ধৈর্যশীল মানুষ। তিনি হলেন কমর উদ্দিন আহমদ। আমাদের পরম সুহৃদ। বরাবর এক বছর আগে তিনি আমাদের ছেড়ে চলে গেছেন ওপারে। গত বছরের ২ এপ্রিল মঙ্গলবার রাত সাড়ে ১০টায় দুরারোগ্য ব্যাধিতে আক্রান্ত হয়ে ইন্তেকাল করেছেন (ইন্নালিল্লাহে. রাজেউন)। মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিল ৬৮ বছর। তিনি স্ত্রী ও একমাত্র ছেলে রাফসানসহ অসংখ্য আত্মীয়স্বজন রেখে যান। তাঁর যখন মৃত্যু হয়, আমি তখন দেশের বাইরে অবস্থান করছিলাম। তাঁর প্রথম নামাজে জানাজা ধনিয়ালাপাড়া বায়তুশ শরফ মাদ্রাসা প্রাঙ্গণে ও দ্বিতীয় নামাজে জানাজা চকরিয়াস্থ তাঁর গ্রামের বাড়িতে অনুষ্ঠিত হয়।

বেশ কয়েক বছর ধরে কমর উদ্দিন আহমদ ভাইকে আমি চিনি। তিনি চট্টগ্রাম একাডেমির পরিচালক সৈয়দা রিফাত আকতার নিশুর জীবনসঙ্গী। এই সুবাদে তাঁর সঙ্গে আমাদের অন্তরঙ্গতা বেশি। প্রায় সময়েই আলাপআলোচনা হতো। একজন বিচক্ষণ মানুষ ছিলেন তিনি। আমার প্রতিটি লেখা তিনি পড়তেন। মৃত্যুর কয়েকদিন আগে আমার স্ত্রী ও একাডেমির কয়েকজন পরিচালক মিলে তাঁকে দেখতে গিয়েছিলাম তাঁর বাসায়। তিনি শুয়ে ছিলেন। নিশু নিয়ে গেলেন আমাদের তাঁর কক্ষে। আমাদের দেখে উঠে বসলেন, কথা বললেন। সেদিনও বললেন আজাদীর কথা। আজাদী তাঁর প্রাণের পত্রিকা। বললেন আমার লেখার কথা, অন্ত্যমিলের কথা। আরো বললেন, আমার মৃত্যুর পর আজাদীতে নিউজ দেবেন, আমাকে নিয়ে একটা লেখা লিখবেন।

আমি খানিকটা অভয় ও সান্ত্বনা দিয়ে বললাম, আপনি সুস্থ হয়ে যাবেন। মৃত্যুর কথা মুখে আনবেন না। কিন্তু নিয়তি এমনইঅল্প কিছুদিন পর তিনি পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করে চলে গেলেন অন্যলোকে।

আমি যখন তাঁর মৃত্যুর খবর পেলাম, তখন বাংলাদেশ সময় রাত সাড়ে ১২ টা। দেশের বাইরে থাকলেও আমি আজাদীর বার্তা বিভাগে নিউজটা পৌঁছাতে পেরেছিলাম। আজাদীতে প্রকাশিত তাঁর মৃত্যুসংবাদ ছাপানো হলেও তাঁকে নিয়ে লেখা হয়নি আমার। খুব কষ্ট পেয়েছিলাম তাঁর মৃত্যুতে।

কমরউদ্দিন আহমদ রাজনীতিবিদ ছিলেন। ছিলেন সমাজব্রতী। একাধিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান ও সেবামূলক স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের গুরুত্বপূর্ণ পদে দায়িত্ব পালন করেছেন। তিনি ছিলেন চট্টগ্রাম প্রেস ক্লাবের আজীবন সদস্য। শুনেছি তিনি চট্টগ্রামস্থ চকরিয়া সমিতির তিনবার সভাপতি নির্বাচিত হয়েছেন। ছিলেন কক্সবাজার জেলা পরিষদের নির্বাচিত সদস্য। তিনি নিজের তহবিল ও জেলা পরিষদের তহবিল থেকে কর্মহীন গরিব দুস্থ মানুষের কাছে সহায়তা প্রদান করেছেন। এলাকার রাস্তাঘাটের উন্নয়ন করেছেন। পাশাপাশি বিভিন্ন ধর্মীয়, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সার্বিক উন্নয়নে তিনি ভূমিকা রেখেছেন। করোনাকালে তিনি ছিলেন এক যোদ্ধা। বিভিন্ন এলাকার মানুষের মাঝে করোনা সুরক্ষাসামগ্রী বিতরণ করেছেন, অর্থ সহায়তা করেছেন। আবার বন্যাদুর্যোগমুহূর্তেও তাঁর ভূমিকা ছিল প্রশংসাযোগ্য।

প্রতিবছর ঈদে তিনি গরিব মানুষের জন্য নতুন কাপড় উপহার দিয়েছেন। তাদের সঙ্গে ঈদ আনন্দ ভাগাভাগি করেছেন। এ বিষয়টি আমরা তাঁর সহধর্মিনী সৈয়দা রিফাত আকতার নিশুর অতি সম্প্রতি শেয়ার করা একটা লেখাতেও পড়েছি। নিশু কমর উদ্দিনের কাজগুলোকে ধরে রাখার চেষ্টা বলে উল্লেখ করেছেন। এবারও গ্রামের মানুষের মাঝে ঈদ উপহার তুলে দেওয়া হলো। তিনি লিখেছেন, ‘প্রতিনিয়ত চেষ্টা করে যাচ্ছি রাফসানের বাবার ঐতিহ্য ধরে রাখতে। ওর ধ্যান জ্ঞান চিন্তা চেতনা জুড়ে সবসময় ছিল এই গ্রাম এবং গ্রামের মানুষ। যে কারণে জীবদ্দশায় ও সময় পেলেই ছুটে আসতো এই গ্রামে। তারই ধারাবাহিকতা ধরে রাখার প্রাণান্তকর চেষ্টা আমার আজকের এই ক্ষুদ্র প্রয়াস। ঈদের আনন্দ ভাগাভাগি করতে চলে এলাম রাফসানের বাবার প্রিয় জায়গায়। যেখানে সে চিরনিদ্রায় শায়িত।’ আসলে নিশুর লেখাটি ছোট্ট হলেও আমাদের হৃদয় স্পর্শ করেছে। তিনি অন্যত্র বলছেন, ‘এক বছর আগে তুমি রাফসানকে এতিম আর আমাকে একা করে এই পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করেছিলে! আমরা মা ছেলে দুইজন ভুক্তভোগী জানি এই বিশাল পৃথিবীতে তুমি ছাড়া আমরা দুইটা মানুষ কত নিঃসঙ্গ, কতটা একাকী।’

সত্যিই, শুধু পরিবারে নয়, সমগ্র সমাজে কমর উদ্দিন আহমদের মতো মানুষদের খুব দরকার। যিনি জ্ঞানী, ধৈর্যশীল, সহনশীল, মানবতাবাদী, পরোপকারী ও হৃদয়বান। তিনি স্বচ্ছ থাকার চেষ্টা করেছেন রাজনীতিতে, পরিচ্ছন্ন থাকার চেষ্টা করেছেন সামাজিক সেবামূলক কর্মকাণ্ডে। তিনি সবাইকে আপন করে চলতে চাইতেন। ভালোবাসা দিয়ে জীবন চালাতে চেয়েছেন। তিনি বহু কাজ করতে চেয়েছেন। বলেছেন, ‘আমার অনেক কাজ বাকি’। আসলে মানুষের কর্মই মানুষকে বাঁচিয়ে রাখবে। জীবনের কল্যাণের জন্য, মানুষের কল্যাণের জন্য সহিষ্ণুতার পথ অনুসরণ করা দরকার, দরকার ধৈর্যশীল মনোভাব।

লেখক : সহযোগী সম্পাদক, দৈনিক আজাদী,

ফেলো (নম্বর৪২২), বাংলা একাডেমি।

পূর্ববর্তী নিবন্ধস্মরণের আবরণে বিপ্লবী চারুবিকাশ দত্ত
পরবর্তী নিবন্ধফেনী সীমান্তে তানজানিয়ার নারী গ্রেপ্তার