মানুষ বই পড়ে কেন। এ প্রশ্নের উত্তর নানাজনের কাছে নানাভাবে পাওয়া যাবে। তবে একটি গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে বই পড়ার ১০টি কারণ। এগুলোর মধ্যে সবচেয়ে প্রথমে যে বিষয়টিকে তারা রেখেছে, সেটি হচ্ছে-‘মানসিক উদ্দীপনা’। এরপর রয়েছে: স্মৃতিশক্তি বাড়ানো, জ্ঞান বৃদ্ধি, বলার দক্ষতা বৃদ্ধি, চিন্তার স্বচ্ছতা, বিশ্লেষণী দক্ষতা, মনঃসংযোগ, লিখবার দক্ষতা, বিনোদনের জন্য, অবসাদ কাটানো ইত্যাদি। বই মানুষকে উজ্জীবিত করে, বই পড়লে মানুষ মানসিকভাবে উদ্দীপ্ত হয়। বইয়ের প্রাণহীন পাতাগুলো মানুষের মনের স্পর্শে যেন প্রাণ পায়, আর সে কারণেই আধুনিক বিজ্ঞানের এই যুগেও বই থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়নি মানুষ। বিজ্ঞান প্রযুক্তির উদ্ভাবন ও নানামাত্রিক চাপে মানুষ ক্রমশ যুদ্ধ করছে বইকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য। এখন পৃথিবীর পরিবর্তন খুব দ্রুত ঘটছে। কথাসাহিত্যিক শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায় এ প্রসঙ্গে বলেছেন, ‘আমাদের ছোটবেলায় এ পরিবর্তন হতো ধীরে ধীরে। হারিকেন থেকে বিজলিবাতির পর্যায়ে পৌঁছাতে অনেক সময় লেগেছে। রেডিও এসেছে সেখান থেকে টেলিভিশনের আবির্ভাবেও সময় লেগেছে অনেক। মানুষ প্রযুক্তির এই পরিবর্তনের সঙ্গে মানিয়ে নিত। এখন এটা খুব দ্রুত ও নানাভাবে ঘটছে। আর মানুষ এই পরিবর্তনকে নানাভাবে দেখছে। সেই পরিবর্তনের ঘূর্ণিপাকে পড়েছে বলেই, আপাতভাবে মনে হচ্ছে, বই মানুষ কম পড়ছে।’ আসলে কি বই পড়ার অভ্যাস কমে আসছে! এ ব্যাপারে লেখকের দায়িত্ব কী। এমন এক প্রশ্নের উত্তরে শীর্ষেন্দু নিজেই বলেন, এই দায়িত্ব শুধু মানুষের নয়, লেখকেরও। লেখককেও সমাজের, বিজ্ঞানের গতির সঙ্গে এগিয়ে চলতে হয়, না হলে পাঠকরা মুখ ফিরিয়ে নেবেই। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির প্রভাব ও অভিগমন মানুষের মধ্যে খুব দ্রুত পড়ে। মানুষও প্রযুক্তির সঙ্গে মানিয়ে নিয়ে এগিয়ে যায়। এই পারস্পরিক প্রভাব খুব গভীর। এই প্রভাবটা ভাষার ওপর এসেও পড়ে। একজন লেখক যত দ্রুত এই পরিবর্তনকে উপলব্ধি করতে পারবে, পরিবর্তনকে বুঝে নিয়ে লিখতে পারবে, ততই সে সক্রিয় থাকবে।’
ঢাকা চট্টগ্রামে একই সাথে শুরু হয়েছে অমর একুশে বইমেলা। মানুষকে বইমুখী করে তোলার জন্য বইমেলার রয়েছে এক অসামান্য ভূমিকা। সকল বয়সের মানুষের জন্য এখানে থাকে উপযুক্ত বইয়ের পর্যাপ্ত কালেকশন। বাঙালি নাকি জাতিগতভাবে আরাম ও প্রমোদপ্রিয়। জ্ঞানান্বেষণের উদ্দেশ্যে লাইব্রেরিতে গিয়ে বইপড়া ও বই সংগ্রহ করার ইচ্ছা ও সুযোগ অনেকেরই হয় না। মেলা উপলক্ষ্যে প্রমোদ ও বইকেনা দু’টোই একসাথে হয়ে যায়। মেলায় যেসব দুর্লভ বই হাতের নাগালে পাওয়া যায় অন্য অনেক সময়েই তা খুঁজে পাওয়া মুশকিল হয়ে পড়ে। যে কোনো মেলায় সমবেত হওয়ার মননগত প্রবণতা আছে বাঙালির। মেলায় মিলিত হওয়ার যে আনন্দ তা অন্যত্র পাওয়া যায় না। অধ্যাপক মাহমুদুল বাসার তাঁর এক প্রবন্ধে বলেন, বইমেলায় বই কেনার গরজেই শুধু মানুষরা আসে না, আসে সাংস্কৃতিক পীঠস্থান, উৎসবে মিলিত হওয়ার আনন্দে। তারপর বইও কেনেন। যাঁরা মেলা থেকে বই কেনেন, তাঁরা কেউ কেউ হয়তো কোনোদিনও বই বিপণিতে গিয়ে বই কিনতেন না। এইটা বইমেলার গুরুত্ব।
বইমেলায় হাতের নাগালে একসাথে পাওয়া যায় সাহিত্যের সকল ভাণ্ডার। ফলে ছাত্রছাত্রীরা ক্লাসের পড়ার বাইরে নানা স্বাদের বই সম্পর্কে চিন্তা করার সুযোগ পায়। তাদের চিন্তায় জ্ঞানের নতুন তৃষ্ণার জন্ম হয়। সব বয়সের পাঠকরা মেতে উঠতে পারেন জ্ঞান–সমুদ্রের সীমাহীন জ্ঞানাহরণে। তাই জাতীয় মেধা ও মনন গঠনে বইমেলার গুরুত্ব অপরিসীম।
অমর একুশে ও ভাষা আন্দোলনকে ঘিরে যে স্বতঃস্ফূর্ত বইমেলা অনুষ্ঠিত হচ্ছে দেশে, তা এককথায় প্রশংসনীয়। কেননা, একে ঘিরে গল্প–কবিতা–উপন্যাস–প্রবন্ধ–শিশুসাহিত্যসহ সৃজনশীল লেখনী শিল্প ও প্রকাশনা শিল্পের সুবিশাল এক কর্মযজ্ঞ চলছে দেশে, যার অর্থনৈতিক ব্যাপ্তি ও পরিধি কম নয়। এর জন্য সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে অবশ্য ধন্যবাদ জানাতে হয়।
২.
চট্টগ্রাম সৃজনশীল প্রকাশক পরিষদের সহযোগিতায় চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন মহান একুশের প্রথম দিনে যে অমর একুশে বইমেলা শুরু করেছে, তা এককথায় অভিনন্দনযোগ্য। এর আগে চট্টগ্রামে অভিন্ন বইমেলার আয়োজন চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের মাধ্যমে হলেও ফেব্রুয়ারির প্রথম দিন থেকে তা শুরু করা যায় নি। এটা চট্টগ্রামের বইপ্রেমীদের জন্য শুভ সংবাদ। বইমেলার আয়োজন করা সিটি করপোরেশনের দায়িত্বের মধ্যে না পড়লেও আগের ধারাবাহিকতা অব্যাহত রাখার কৃতিত্ব সিটি মেয়রের। তিনি আন্তরিক না হলে এ মেলার আয়োজন হতো না। সিটি মেয়র ডা. শাহাদাত হোসেন বলেন, বইমেলা আয়োজন চট্টগ্রামবাসীর দীর্ঘদিনের আকাঙ্ক্ষা। এটি তরুণ প্রজন্মকে সৃজনশীল কর্মকাণ্ডে উদ্বুদ্ধ করবে এবং মাদকসহ ক্ষতিকর আসক্তি থেকে দূরে রাখবে। তিনি বলেন, বই অন্যতম বন্ধু, যা তাদের মুঠোফোন ও মাদকের আসক্তি থেকে বের করে সৃজনশীল মেধাবী প্রজন্ম হিসেবে গড়ে তুলতে পারে। তিনি বলেন, আমরা আশা করি এই মেলায় চট্টগ্রামের সর্বস্তরের লেখক–পাঠক ও সৃজনশীল নাগরিকদের অংশগ্রহণে সংস্কৃতি ও মননের উৎকর্ষের পাশাপাশি ইতিহাস–ঐতিহ্য–সংস্কৃতির সম্মিলন ঘটবে। জাতীয় জীবনে যেসব ব্যক্তি কৃতিত্বপূর্ণ অবদান রেখেছেন তাদের একুশে সম্মাননা স্মারক পদক ও সাহিত্য পুরস্কার প্রদান করা হবে।’
সিটি মেয়রের এ বক্তব্য খুবই তাৎপর্যপূর্ণ। প্রতি বছর একুশে সম্মাননা স্মারক পদক ও সাহিত্য পুরস্কার প্রদান নিয়ে নানা বিতর্কের অবতারণা হয়। যদিও কোনো পুরস্কারই বিতর্কের উর্ধ্বে নয়। তবু এ বিষয়ে আগেভাগে একটু সতর্ক থাকলে বিতর্ক এড়ানোর সুযোগ থাকবে। নগরীর গুণীব্যক্তিদের সমন্বয়ে একটি জুরি বোর্ড গঠন ও নীতিমালা প্রণয়ন করে এ পদক ঘোষণা করা যেতে পারে। বিষয়টি প্রিয় মেয়র ও সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিবর্গের দৃষ্টিতে এলে চট্টগ্রামের সাহিত্য ও সংস্কৃতি অঙ্গন উপকৃত হবে।
৩.
আমরা পাঠের গুরুত্বের কথা বলি, একই সাথে বইয়ের পাঠকের গুরুত্ব নিয়ে কথা বলি। বইয়ের একজন অগ্রসর পাঠক সমাজকে এগিয়ে নেওয়ার ক্ষেত্রে প্রতিনিধিত্ব করে। তিনি জ্ঞান অন্বেষণের পাশাপাশি জ্ঞান বিতরণও করেন। এমন একজন গুণীর কথা এ কলামে উল্লেখ করতে চাই সশ্রদ্ধায়। তাঁর নাম মোহাম্মদ আমান উল্লাহ খান। তিনি নিষ্ঠাবান পাঠক, নিভৃতচারী গবেষক ও প্রচারবিমুখ লেখক। বিরাশি–উর্ধ্ব বয়সেও তিনি তাঁর পাঠ অব্যাহত রাখেন। আজাদীর নিয়মিত পাঠক তিনি। একসময় নিয়মিত লিখতেন। কোথাও কোনো ভুল তথ্য প্রকাশিত হলে আমাকে ফোন করবেন। আর আমার লেখা প্রকাশের পরও তাঁর মতামত প্রকাশ করা রুটিনে পরিণত হয়ে গেছে। রাদিয়া প্রকাশন থেকে তাঁর কয়েকটি বই প্রকাশিত হয়েছে। সেই প্রকাশনের স্বত্ত্বাধিকারী অধ্যাপক গোফরান উদ্দীন টিটু ও সৈয়দা সেলিমা আক্তারের কাছ থেকে আমি সংগ্রহ করেছি তাঁর দুতিনটি বই। বইয়ের ফ্ল্যাপে লেখা রয়েছে তাঁর সংক্ষিপ্ত পরিচিতি। ওখান থেকে খানিকটা জেনে নিই। মোহাম্মদ আমান উল্লাহ খানের জন্ম চকরিয়া উপজেলার বরইতলি ইউনিয়নের পহরচাঁদা গ্রামের এক সম্ভ্রান্ত পরিবারে। পারিবারিক জীবনে দুই কন্যা ও এক পুত্রের জনক। প্রাথমিক শিক্ষা নিজ গ্রামে। ১৯৫৯ সালে সরকারি মুসলিম হাই স্কুল থেকে মেট্রিক পরীক্ষা পাশ করেন। অতঃপর চট্টগ্রাম সরকারি কলেজে আইএসসিতে ভর্তি। চট্টগ্রাম সিটি কলেজ থেকে বিএ পাশ করার পর ১৯৭১ সালে নিজ পীর মোর্শেদের সাথে হজব্রত পালন করেন। একই উপজেলার লক্ষ্যরচর ইউনিয়নের প্রাক্তন চেয়ারম্যান জমিদার আলহাজ খোরশেদ আহমদ চৌধুরীর কন্যা বেগম ফোরকান আরা‘র সাথে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন। নানা প্রতিষ্ঠানে চাকরির পর শারীরিক কারণে অবসর গ্রহণ করেন। লেখালেখির হাতেখড়ি স্কুলজীবনেই। নবম ও দশম শ্রেণিতে বার্ষিক ম্যাগাজিনে গল্প ও কবিতা প্রকাশিত হয়। কলেজ জীবনে ‘সংহতি‘ নামক একটি সাময়িকীর সম্পাদক হিসাবে দায়িত্ব পালন করেন। তিনি প্রণয়ন করেন ‘মহিমাময় জীবন‘ নামক অসাধারণ গ্রন্থটি। রচনা করেন হযরত গাউসুল আজম শেখ আবদুল কাদের জিলানি (রাহঃ) জীবনের উপর ছোট্ট বই। ১৯৮০ সাল থেকে নিয়মিত প্রকাশিত মাসিক ‘দ্বীন–দুনিয়া’ পত্রিকার অন্যতম উপদেষ্টা হিসাবে সম্পৃক্ত আছেন। দরবারের বিশিষ্ট ব্যক্তিত্বদের জীবনকাহিনী নিয়ে ‘যাদের ত্যাগে আলোকিত বায়তুশ শরফ’ নামক একটি বইও প্রণয়ন করেন। লেখেন ‘ইসলামের অনন্ত সৌন্দর্য’ শীর্ষক গ্রন্থ। জ্ঞানে–পাণ্ডিত্যে তিনি অনন্য। এমন পাঠক ও লেখক আমাদের জন্য জরুরি। আমরা তাঁর সুস্থতা ও দীর্ঘজীবন প্রত্যাশা করি।
৪.
চট্টগ্রামের বইমেলা নিয়ে আমাদের অনেক প্রত্যাশা। চট্টগ্রামের প্রকাশক ও লেখকদের স্বার্থকে কিভাবে অগ্রাধিকার দেয়া যায় তা নিয়ে আমরা ভাবি। যেমন বাংলা একাডেমির বইমেলায় শুধু বাংলাদেশের বই পাওয়া যায়। কলকাতা বা অন্য বিদেশি প্রকাশনার বইয়ের স্থান বাংলা একাডেমিতে নেই। কারণ বাংলাদেশের প্রকাশনা শিল্পকে প্রতিষ্ঠিত করতে, সম্বৃদ্ধ করতে সরকারের এই উদ্যোগ। সে হিসেবে পশ্চিমবঙ্গের কোনো একজন লেখকের বই মেলায় স্থান পেতে হলে বাংলাদেশি কোনো প্রকাশনা শিল্পের মাধ্যমে বাজারজাত করতে হয়। কলকাতার অনেক লেখকের বই বাংলাদেশের প্রকাশনা থেকে প্রকাশিত হয়। এর কারণ বাংলাদেশের প্রকাশনা শিল্পকে সমৃদ্ধ করা। ঠিক সেরকম চট্টগ্রামের প্রকাশনা শিল্পকে সমৃদ্ধ করতে এ মেলার ভূমিকা থাকতে হবে।
জাতীয় পর্যায়ের লেখকদের বই চট্টগ্রামের প্রকাশনা সংস্থা থেকে বের হলে এ অঞ্চলের প্রকাশনাকে সমৃদ্ধ করা হয়। এখান থেকে ভালো মানের বই প্রকাশ করার ঐতিহ্য আছে, এখন প্রয়োজন সেটা পুনরুদ্ধার করা।
লেখক : সহযোগী সম্পাদক, দৈনিক আজাদী;
ফেলো (নম্বর–৪২২), বাংলা একাডেমি।