চলচ্চিত্র নির্মাণে সরকারি অনুদান ও ‘শিল্পশোভন চলচ্চিত্রের’ জন্য প্রত্যাশা

রাশেদ রউফ | মঙ্গলবার , ৪ জুলাই, ২০২৩ at ৬:৪০ পূর্বাহ্ণ

বুদ্ধদেব বসু তাঁর ‘কালের পুতুল’ গ্রন্থটি উৎসর্গ করেছিলেন শিল্পী যামিনী রায়কে। উৎসর্গ পত্রে তিনি লিখেছিলেন :

চিত্রকলার আলোচনায় আমার অধিকার নেই; তাই আপনার প্রতি আমার প্রীতি ও শ্রদ্ধা নিবেদন করলাম এবই উৎসর্গ করে।’ কথাটি একারণে বলা, আনোয়ার হোসেন পিন্টুর চলচ্চিত্র বিষয়ে বলা কিংবা আলোচনা করার তেমন সামর্থ্য আমার নেই। অধিকারও নেই। তবু তাঁর প্রতি আমার ভালোবাসা ও শ্রদ্ধা নিবেদন করতে পারি এলেখার মাধ্যমে।

আমরা যারা চট্টগ্রামে বসে সৃজনশীল নানা মাধ্যমে কাজ করি, নানা সৃজনপ্রক্রিয়ায় যুক্ত আছি, আমরা জানিকতো কঠিন ঢাকার সঙ্গে তাল মিলিয়ে এগিয়ে যাওয়া। ঢাকা শুধু বাংলাদেশের রাজধানী নয়, শিল্পসাহিত্যসংস্কৃতিসবকিছুর প্রাণকেন্দ্রও। অস্বীকার করার উপায় নেই যে ঢাকা সবকিছুর নিয়ন্ত্রক। রাজধানী মানে হলো পাহাড়ের চুড়োর মতো। ওখানে একফোঁটা জল পড়লেও চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে। আর রাজধানীর বাইরের অঞ্চল মানে পাহাড়ের পাদদেশ। সেখান থেকে পাহাড়ের চুড়োয় পৌঁছা কষ্টসাধ্য ব্যাপার। জল পৌঁছানো দূরের কথা, ঢিল ছুঁড়েও চুড়ো পর্যন্ত নিয়ে যাওয়া সহজ নয়।

আনোয়ার হোসেন পিন্টু বাস করেন চট্টগ্রামে। কাজের ক্ষেত্রও চট্টগ্রাম। এখানে বসে তিনি আন্তর্জাতিক মানের কাজ করলেও তার খবর অনেকে রাখেন না। আনন্দের সংবাদ, তিনি এবার পেয়েছেন চলচ্চিত্র নির্মাণে সরকারি অনুদান। এখানে উল্লেখ্য, ২০২২২৩ অর্থবছরে সরকারি অনুদান পেয়েছে ২২টি পূর্ণদৈর্ঘ্য ও ৬টি স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র। মোট ১৩ কোটি ৯০ লাখ টাকার অনুদান ঘোষণা করা হয়েছে। আনোয়ার হোসেন পিন্টু তাঁর পূর্ণ দৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র ‘ঠিকানা’র জন্য পাচ্ছেন ৫৫ লাখ টাকা। আনোয়ার হোসেন পিন্টুর এ অর্জনের জন্য আমরা তাঁকে অভিনন্দন জানাই। চট্টগ্রামের সংস্কৃতিকর্মীরা এ আনন্দকে উপভোগ করছেন তাঁদের ভালোবাসা প্রদর্শনের মাধ্যমে।

চলচ্চিত্র শিল্পে মেধা ও সৃজনশীলতায় উৎসাহিত করার লক্ষ্যে ১৯৭৬ সাল থেকে চলচ্চিত্র নির্মাণের জন্য প্রতিবছর সরকারি অনুদান দেওয়া হয়ে থাকে। মাঝে বেশ কয়েক বছর বন্ধ থাকলেও ২০০৭২০০৮ অর্থবছর থেকে আবারও তা নিয়মিত হয়েছে। কিন্তু এই অনুদান দেওয়া নিয়ে আছে নানা প্রশ্ন আর বিতর্ক। আছে অনুদান নিয়ে নয়ছয়ের অভিযোগ। অভিযোগে প্রকাশ, সরকারি অনুদানের ছবির কাজ শুরু হয় কিন্তু শেষ হয় না। আবার পরিচালনায় পূর্ব অভিজ্ঞতা নেই এমন পরিচালকও পাচ্ছেন অনুদান। কাদের, কী কারণে এবং কোন পদ্ধতিতে অনুদানের জন্য মনোনীত করা হয়, সেই প্রশ্নও আছে। অনুদানপ্রাপ্ত বেশির ভাগ ছবির ক্ষেত্রেই এই ‘অনিয়ম’ দীর্ঘদিন ধরে ‘নিয়মেই’ পরিণত হয়েছে। যদিও একটি ভালো সিনেমা নির্মাণ করে দর্শক পর্যন্ত পৌঁছাতে মেধাবী পরিচালকের সঙ্গে পেশাদার একজন প্রযোজকও অপরিহার্য। এ ক্ষেত্রে সরকারি কোনো কঠোর মনিটরিং ব্যবস্থা আছে বলে আমার জানা নেই। এ অবস্থায় আনোয়ার হোসেন পিন্টুর অনুদানপ্রাপ্তি নিঃসন্দেহে প্রশংসার দাবিদার। চলচ্চিত্র নির্মাণে সরকারি অনুদান কার্যক্রম যাঁরা পরিচালনা করেন, তাঁদের ধন্যবাদ জানাতে হয়, তাঁরা একজন যোগ্য মানুষকে এক্ষেত্রে নির্বাচন করেছেন।

আনোয়ার হোসেন পিন্টু জন্মগ্রহণ করেছেন ১৯৫৯ সালের ৩ জানুয়ারি। ছোটোবেলা থেকেই তিনি সিনেমা অন্তঃপ্রাণ। লেখালেখি করেন। কখনো ছড়া, কখনো প্রবন্ধ। তবে সিনেমাই তাঁর ধ্যানজ্ঞান। গবেষণা তাই সিনেমা নিয়ে। নাটকের মাধ্যমে এ অঙ্গনের সূচনা, চট্টগ্রাম কলেজে পড়াকালীন ১৯৭৭ সালে। কয়েকজন মিলে গঠন করেন ‘উদয়ন নাট্যগোষ্ঠী’। সেসময়ে বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘অশনি সংকেত’ উপন্যাসের নাট্যরূপ দেন। এরপর আনোয়ার হোসেন পিন্টু যুক্ত হন থিয়েটার ’৭৩র সঙ্গে। কিছুদিন কাজ করার পর সদস্য হন ঢাকাস্থ রেইনবো ফিল্ম সোসাইটির চট্টগ্রাম শাখার। তখন থেকে চলচ্চিত্র বিষয়ে ধীরে ধীরে সমৃদ্ধ হয়ে ওঠেন। শুরু করেন চলচ্চিত্র বিষয়ে লেখালেখি। সম্পাদনা করেন চলচ্চিত্র বিষয়ক লিটল ম্যাগাজিন ‘ইন্টার কাট’, ‘লুক থ্রু’, ‘চলচ্চিত্র চিন্তা’। যুক্ত ছিলেন চট্টগ্রাম চলচ্চিত্র সংসদের সঙ্গে। পরে নেমে পড়েন সত্যজিৎ চর্চায়। ১৯৯৩ সালে গঠন করেন ‘চট্টগ্রাম সত্যজিৎ চর্চা কেন্দ্র’। একেন্দ্র থেকে তাঁর সম্পাদনায় প্রকাশিত হয় ‘সত্যজিতের রবীন্দ্রনাথ’ শীর্ষক ৫০০ পৃষ্ঠার একটি অনন্য গ্রন্থ। এটি প্রকাশের পর উভয় বাংলায় তোলপাড় সৃষ্টি হয়। সমাদৃত হয় ব্যাপকভাবে। সত্যজিৎ গবেষক হিসেবে কেবল দেশে নয়, ওপার বাংলাতেও তিনি খ্যাতি অর্জন করেন। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে চারুকলায় মাস্টার ডিগ্রি অর্জনকারী আনোয়ার হোসেন পিন্টু নির্মাণ করেন স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র ‘তৃতীয় বিশ্বের ম্যাজিক’। এটি ২০১৯ সালে রাজস্থান আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে শ্রেষ্ঠ চলচ্চিত্র হিসেবে পুরস্কার লাভ করে। এবার তিনি সরকারি অনুদানে নির্মাণ করবেন কথাসাহিত্যিক শওকত আলীর ‘পাকা দেখা’ উপন্যাস অবলম্বনে পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র ’ঠিকানা। তাঁর অনুদানপ্রাপ্তিকে অভিনন্দিত করেছেন আমাদের বেশ কয়েকজন প্রাজ্ঞ ব্যক্তিত্ব। তাঁদের মধ্যে আছেন কবি স্বপন দত্ত, আলম খোরশেদ ও জ্যোতির্ময় নন্দী। স্বপন দত্ত লিখলেন, “স্বপ্নপূরণের সিঁড়ির আরেকটি ধাপে পা রাখতে চলেছে আনোয়ার হোসেন পিন্টু। শীঘ্রই শুরু হতে চলেছে তার পূর্ণ দৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র ‘ঠিকানা’ নির্মাণের প্রস্তুতিপর্ব। পিন্টু আজীবন তার গুরু সত্যজিৎ রায়ের পথ অনুসরণ করে বহুকালব্যাপী স্বপ্নবিচরণে দিন যাপন করে চলেছে। সত্যজিতের চলচ্চিত্রের ভুবনমণ্ডলে তার নিরন্তর পরিভ্রমণ। সেই চেতনা থেকেই কিছুকাল আগে আনোয়ার হোসেন পিন্টু তৈরি করেছিলো ‘তৃতীয় বিশ্বের ম্যাজিক’ নামে পঁচিশ মিনিটের একটি শর্ট ফিল্ম। এ ছবি রাজস্থানে ফিল্ম উৎসবে শ্রেষ্ঠ ছবির মর্যাদায় অভিষিক্ত হয়। এ ছাড়াও এ ছবির রাজনৈতিক বক্তব্য বিদগ্ধজনের বিশেষ দৃষ্টি আকর্ষণ করে। আমরা আশা করতেই পারি, আনোয়ার হোসেন পিন্টুর বর্তমান পরিকল্পনার চলচ্চিত্র ‘ঠিকানা’ এদেশের নবতরঙ্গের ছায়াছবির জগতে একটি জ্যোতিষ্ক হয়ে সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করতে সক্ষম হবে।” আলম খোরশেদ লিখলেন, “আমরা আশা করব ভালোয় ভালোয় কাজটি দ্রুত শেষ করে পিন্টু তার স্বপ্নের ‘ঠিকানা’র পথে আরও এক ধাপ এগিয়ে যাবে। সেইসঙ্গে আমাদেরই মতো বাংলাদেশের আরও অসংখ্য অপেক্ষমাণ সিনেমাপ্রেমীকে উপহার দেবে একটি সুন্দর, সুনির্মিত, শিল্পশোভন চলচ্চিত্র।” জ্যোতির্ময় নন্দী লিখলেন, “যোগ্যতমের উদ্বর্তনের তত্ত্বটা দিয়ে গেছেন চার্লস ডারউইন সাহেব সেই কবে। তবে বাস্তব ক্ষেত্রে কথাটা যে সবসময় খাটে, তা বোধহয় বলা যায় না। বিশেষ করে বাংলাদেশের মতো দেশে, যেখানে ঘাটে ঘাটে অযোগ্যেরই জয়জয়কার। আর যোগ্যরা উদ্বর্তিত হওয়ার কোনো মওকা না পেয়ে পড়ে থাকে তলানিতে। কথাটা বললাম এজন্যে যে, বাংলাদেশে চলচ্চিত্র নির্মাণের সত্যিকারের যোগ্যতা যাঁরা রাখেন, আনোয়ার হোসেন পিন্টুর নাম তাঁদের মধ্যে যে অগ্রসারিতে রাখা যাবে, যাঁরা পিন্টুকে বা তাঁর চলচ্চিত্র বিষয়ক কর্মকাণ্ডকে জানেন, তাঁরা নিশ্চয় এ ব্যাপারে দ্বিমত করবেন না। কিন্তু যাঁকে আমরা সত্যজিতের একনিষ্ঠ একলব্য শিষ্য হিসেবে জানি, তাঁর শিল্পরুচিসম্মত একটা পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র বানানোর টাকা যোগাড় করতেই তাঁর জীবনের সিংহভাগ চলে গেলো। এটা হয়েছে কিছুটা পিন্টুর নিজের আলস্য, দীর্ঘসূত্রতা, যথাযথ স্থানে তৈলসিঞ্চনে অক্ষমতা প্রভৃতির কারণে, এবং দা লাস্ট বাট নট দা লিস্ট, তাঁর চারপাশের সাহায্যক্ষম মানুষগুলোর মায়োপিয়ার কারণে। পিন্টুর সৃজন প্রতিভা তাঁরা লক্ষ করেননি। কিংবা করলেও উপেক্ষা করেছেন। কিন্তু শেষপর্যন্ত ভাগ্যে শিকে ছিঁড়লো। যোগ্যের কিছুটা উদ্বর্তন হলো।”

কোনো রকম তদবির ও দলীয় রাজনীতিবৃত্তের বাইরে থেকে রাষ্ট্রীয় অনুদান পাওয়াটা কতটা কঠিন তা কমবেশি সবাই অবগত। এক্ষেত্রে আনোয়ার হোসেন পিন্টুর সৌভাগ্য বলা যায়। আমরা চাই এই সৃজনযজ্ঞে তিনি নিজেকে উজাড় করে দেবেন এবং সর্বোচ্চ মেধা ব্যয় করে আমাদের সবার মুখ উজ্জ্বল করবেন।

লেখক : সহযোগী সম্পাদক, দৈনিক আজাদী।

পূর্ববর্তী নিবন্ধরঙ্গমঞ্চে পরাশক্তির আনাগোনা
পরবর্তী নিবন্ধরাঙ্গুনিয়ায় গীতা শিক্ষা নিকেতনের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী