বাঙালি শিশুর জন্য শিশুপাঠ কেমন হওয়া উচিত–সেই পথ প্রথম দেখালেন ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের সহপাঠী বন্ধু মদনমোহন তর্কালঙ্কার। ১৮৪৯ সালে ‘শিশু শিক্ষা’ গ্রন্থমালা লিখে পথিকৃতের ভূমিকা পালন করেছেন তিনি। ‘পাখি সব করে রব রাতি পোহাইল’ এই লাইনটি ‘শিশু শিক্ষা’ প্রথম ভাগের ‘প্রভাতবর্ণন নামে চিরকালের শিশু কবিতার অংশ। ‘লেখাপড়া করে যে/ গাড়িঘোড়া চড়ে সে’–একসময়ে ছোটোদের কাছে এই আপ্তবাক্যটি আওড়ানো হতো। সময়ের পরিবর্তনে আজ এই বাক্যটি ভুলে যেতে বসলেও অস্বীকার করার উপায় নেই যে, এটি ছিলো বিদ্যা গ্রহণ বিষয়ে উজ্জীবনের মূলমন্ত্র। এই বইয়ে প্রচুর নীতিশিক্ষা রয়েছে। তবে কোনো বিশেষ ধর্মীয় নীতিবোধের চেয়ে সর্বজনীন মূল্যবোধের ওপর গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। শিশুসাহিত্য সে হিসেবে আনন্দ আর শিক্ষার অপূর্ব সমন্বয়। প্রমথ চৌধুরীর ভাষায়, ‘শিশু শিক্ষার পুস্তকে যে বস্তু বাদ পড়ে যায়– অর্থাৎ আনন্দ–সেই বস্তু যুগিয়ে দেবার উদ্দেশ্যেই এ সাহিত্যের সৃষ্টি’। বিষয়টাকে আরো খোলাসা করেছেন নারায়ন গঙ্গোপাধ্যায়। তিনি বলেছেন, ‘শিশুসাহিত্য আনন্দের আশ্রয়ে চরিত্রগঠন ও শুভবুদ্ধির সঞ্চার মাতৃস্নেহ, পিতৃনিয়ন্ত্রণ এবং খেলার সাথীর সাহচর্য–এই তিনটির উপরেই নির্ভর করে’। শিশুসাহিত্য গবেষকদের নানা মতকে আমরা যদি বিশ্লেষণ করি, তাহলে এই ধারণায় উপনীত হওয়া যায় যে শিশুসাহিত্য হলো ছোটোদের এক রঙিন জগৎ। তাদের মনে বিশুদ্ধ আনন্দরস সঞ্চারের জন্য যে সাহিত্য রচনা করা হয়। যে রচনা পড়ে ছোটোরা মজা পায়, আনন্দ পায়, পরিতৃপ্ত হয়। তাকে তারা সহজেই অন্তর দিয়ে গ্রহণ করে নেয়। ছো্টোদের চঞ্চল, কল্পনাপ্রবণ ও জিজ্ঞাসু মনকে অনুষঙ্গ করে সাহিত্য রচনা করেন লেখকরা। হাসি, কৌতুক, মজা বা আনন্দ গ্রহণের অন্তরালে ছোটোরা অনায়াসে পেয়ে যায় জাগতিক জ্ঞান, বুদ্ধি–যুক্তি ও চিন্তার চমৎকার উপাদান। এই জ্ঞান বা শিক্ষা জটিল নয়, কঠিন নয়, জগৎ ও পরিবেশ বিষয়ে সাধারণ জ্ঞান। শিশুসাহিত্যিকদের এসব রচনা থেকে জীবনকে দেখবে এবং অনিসন্ধিৎসু মন দিয়ে খুঁজে পাবে জীবনের বিচিত্র রূপ।
শিশুসাহিত্যের পাঠক কেবল কি ছোটোরাই? বুদ্ধদেব বসু অনেক আগেই বলেছেন, ‘এমন মত পোষণ করা সম্ভব যে শিশুসাহিত্য স্বতন্ত্র কোনো পদার্থ নয়, কেননা তা সত্যিকার সাহিত্য হলে বড়রাও তাতে আনন্দ পান’। ‘বাংলা শিশুসাহিত্য’ শীর্ষক প্রবন্ধে তিনি শিশু সাহিত্যের ভোক্তা–বিষয়ে বিস্তারিত বলেছেন।
আশা গঙ্গোপাধ্যায়ও ‘শিশুসাহিত্যের স্বরূপ’ প্রবন্ধে উল্লেখ করেছেন, ‘যথার্থ শিশু সাহিত্য বলিতে তাহাই বুঝিব, যাহা সর্ব্ব বয়সের নরনারীর কাছেই একটি রসাস্বাদ আনিয়া দেয়, বয়সের পার্থক্য অনুসারে আস্বাদনের ব্যাপারে কিছু বিভিন্নতা ঘটিতে পারে–কিন্তু সর্ব্বস্তরের মানুষকে আনন্দ দান করিবার মত শিল্পগুণ তাহাতে থাকিবেই।’ অতএব, আমরা বলতে পারি, যে কোনো মহৎ সাহিত্য যেমন সরস ও সুস্বাদু হবার পাশাপাশি বৃহত্তর জগতের সন্ধান দেয়, তেমনি যথার্থ শিশুসাহিত্যে আনন্দরসের মাধ্যমে প্রতিভাত হয় চারপাশের জগৎ ও জীবন। এটি চিরায়ত সাহিত্য। সব শ্রেণির পাঠক এর ভোক্তা।
তাই এমন রচনা আমরা চাই, যা শিশু–কিশোরের মানস গঠনে ভূমিকা রাখতে পারে। ছোটোদের রুচি গঠন ও মানবিক মূল্যবোধ তৈরিতে সহায়ক এমন রচনাই আমাদের কাম্য। আমরা জানি, মানুষের সৌন্দর্যবোধ ও আনন্দানুভূতির মূলে রয়েছে তার রুচি। এই রুচিকেই সবার আগে প্রাধান্য দেওয়া দরকার। কামিনী রায় বলেছেন, ‘কুসাহিত্য, কু–দৃশ্য মানুষের রুচিকে বিকৃত করে। সাহিত্য যখন ভবিষ্যৎ সমাজের জীবনকে গঠন করে তখন এরূপ কুসাহিত্যিকে উৎসাহ না দেওয়াই উচিত। যাহা সুন্দর, যাহা আনন্দদায়ক, যাহা জনকে উর্ধ্বমুখ করে, তাহাই আর্ট।’ আমাদের দরকার তেমন মানসম্মত বই, যা ছোটোদের জীবনকে সুন্দরভাবে গড়ে তোলার ক্ষেত্রে সহায়ক হবে।
শিশুসাহিত্যিক আলী ইমাম আক্ষেপ করে বলেছিলেন, ‘ভুল বাক্য ও শব্দ চয়নে দুর্বলতার কারণে অধিকাংশ শিশুসাহিত্য মান হারিয়েছে। আর মানহীন শিশুসাহিত্য বা রচনাগুলো শিশুদের বিভ্রান্ত করছে। রহস্য রোমাঞ্চ বা গল্প যাই লিখছি না কেন আমরা, একটা পরিকল্পিত প্যাটার্ন নেই বলে শিশুসাহিত্য এখনো সু–সাহিত্য হয়ে উঠতে পারছে না।’ অন্যদিকে, কবি আসাদ চৌধুরী বলেছিলেন, ‘বাজারে হাজার হাজার বই আসুক তাতে কোনো সমস্যা নেই। কালি–কাগজের ব্যবসা ভালো হবে। লেখা ভালো না হলে পাঠক তা পড়বে না। কিন্তু শিশুদের বইয়ের প্রতি নজর দিতে হবে। তাদের হাতে যেন মানসম্পন্ন বই যায় সে ব্যাপারে কড়া নজরদারি প্রয়োজন।’ ‘নতুন আলোয় জেগে উঠুক শিশুসাহিত্য’ শীর্ষক প্রবন্ধে শিশুসাহিত্যিক আনজীর লিটন লিখেছিলেন, ‘শিশু–মনোবিজ্ঞানের তত্ত্ব বিশ্লেষণ করার সক্ষমতা একজন শিশুসাহিত্যিকের অপরিহার্য শক্তি। এই শক্তির গুণে শিশুসাহিত্যিকরা হলেন শিশু মনোজগতের ভাষ্যকার।’
আসলে ‘ছোটোদের বই এমন হতে হবে যা তাদের ভালো লাগবে আর যা পড়ে তাদের মনের ভালো বৃত্তিগুলোতে খানিকটা সাড়া জাগাবে।’ ছোটোদের মন ও মনন গঠনে শিশুসাহিত্যের ভূমিকা অপরিসীম। ভবিষ্যৎ পৃথিবীর আদর্শ মানুষ গড়ে তোলার প্রস্তুতিপর্বে ছোটোদের চিন্তা–চেতনায় রুচিবোধ ও জীবনবোধ প্রতিষ্ঠায় প্রয়োজনীয় উপকরণ সমৃদ্ধ সাহিত্য রচনা একান্ত আবশ্যক।
২.
বাংলাদেশের শিশুসাহিত্যের বহমান ধারাকে আরো গতিময় করতে এবং এ খাতে চর্চা বৃদ্ধি করতে বাংলাদেশ শিশুসাহিত্য একাডেমি কয়েক বছর যাবৎ চট্টগ্রামে শিশুসাহিত্য উৎসবের আয়োজন করে আসছে। সেই ধারাবাহিকতায় আগামী ২৪ ও ২৫ অক্টোবর চট্টগ্রাম শিল্পকলা একাডেমিতে এবারের উৎসব অনুষ্ঠিত হবে। এ উপলক্ষ্যে বিস্তারিত কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়েছে। ইতোমধ্যে শিশুসাহিত্য সম্মাননার জন্য তিনজন শিশুসাহিত্যিকের নাম ঘোষণা করা হয়েছে। তাঁরা হলেন : শিশুসাহিত্যিক তাহমিনা কোরাইশী, জাহাঙ্গীর আলম জাহান ও আনোয়ারুল হক নূরী। এছাড়া অন্যান্য কর্মসূচির মধ্যে রয়েছে উদ্বোধনী আলোচনা, সেমিনার, লেখা পাঠ, আবৃত্তি, সাংস্কৃতিক প্রতিযোগিতা প্রভৃতি। এবার যুক্ত হচ্ছে শিশুসাহিত্যের বইয়ের পৃষ্ঠপোষকদের সম্মাননা প্রদান পর্ব। যাঁরা নীরবে নিভৃতে বইয়ের প্রচার প্রসারে দীর্ঘদিন ধরে ভূমিকা পালন করছেন, পৃষ্ঠপোষকতা দিয়ে আসছেন নানা আয়োজনে, তাঁদের দুইজনকে এবার দেওয়া হবে ‘বইবন্ধু সম্মাননা’। তাঁরা হলেন শিক্ষা–সংগঠক মো. মাজহারুল হক ও সমাজব্রতী ঢালী মোহাম্মদ শোয়েব। এছাড়া শিশুসাহিত্য বিষয়ক লিটল ম্যাগাজিন ‘শিশুসাহিত্য’ প্রকাশিত হবে উৎসব উপলক্ষ্যে। সব মিলিয়ে দেশের শিশুসাহিত্যিক বন্ধুদের জন্য এই দুদিন হবে পরম আকাঙ্ক্ষার দিন। এ উৎসবে আমরা সুধী পাঠকের সহযোগিতা প্রত্যাশা করছি।
লেখক : সহযোগী সম্পাদক, দৈনিক আজাদী; ফেলো, বাংলা একাডেমি।