আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ (চমেক) হাসপাতালের প্রধান ছাত্রাবাসে ছাত্রলীগের দুই গ্রুপের মধ্যে সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে। গতকাল মঙ্গলবার বিকেল ৩টার দিকে এ ঘটনা ঘটে। এ সময় অন্তত ১২টি কক্ষ ভাঙচুর করা হয়েছে।
প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, পুলিশের উপস্থিতিতে প্রায় আধ ঘণ্টা ধরে ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া এবং কক্ষ ভাঙচুর করা হয়েছে। পরে দুই পক্ষের নেতাকর্মীদের দুই দিকে সরিয়ে দেয় পুলিশ সদস্যরা। তবে এ সময় দুই পক্ষের নেতাকর্মীদের হাতে দেশীয় অস্ত্র দেখা গেছে। এছাড়া উভয় পক্ষই পাল্টাপাল্টি শ্লোগান দেয় এবং একে অপরকে দোষারোপ করে বলে জানায় প্রত্যক্ষদর্শীরা। ঘটনাস্থলে যাওয়া সিএমপির অতিরিক্ত উপ-কমিশনার (এডিসি-দক্ষিণ) পলাশ কান্তি নাথ আজাদীকে বলেন, এখানে ছাত্রলীগের দুইটা গ্রুপ আছে। হোস্টেলে অবস্থান নিয়ে আগেও তারা কয়েকবার মারামারি করেছে। তখন আমরা কলেজ প্রশাসনের সঙ্গে মিলে তাদের হোস্টেলের দুই দিকে ভাগ করে থাকার ব্যবস্থা করে দিয়েছি। এখানে বাম পাশে (এ-ব্লক) থাকে একপক্ষ। আর ডান পাশে (বি-ব্লক) থাকে অন্য পক্ষ।
তিনি বলেন, যতটুকু জানতে পেরেছি, এ ব্লকের কিছু ছেলে যাদের আগামীকাল (আজ) পরীক্ষা আছে, তারা সম্ভবত বি-ব্লকের কয়েকটি কক্ষে উঠেছিল। তাদের তাড়িয়ে দেওয়া নিয়ে সমস্যা হয়। আমরা ঘটনাস্থলে এসে উভয় পক্ষকে মুখোমুখি দেখতে পাই। এ ঘটনায় কেউ আহত হয়নি। কাউকে আটকও করা হয়নি বলে জানিয়েছেন এডিসি পলাশ। সংঘর্ষের বিষয়টি স্বীকার করে চকবাজার থানার ওসি (তদন্ত) রিয়াজ উদ্দিন চৌধুরী আজাদীকে বলেন, পুলিশ গিয়ে পরিস্থিতি শান্ত করেছে। ঘটনাস্থলে পর্যাপ্ত পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছে বলে জানান তিনি। অপরদিকে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আসার প্রায় একঘণ্টা পর বিকেল সাড়ে ৪টার দিকে ছাত্রাবাসে যান চমেক অধ্যক্ষ শাহেনা আকতার। তিনি ছাত্রাবাসের একটি কক্ষে পুলিশসহ সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে বৈঠক করেন।
ঘটনাস্থলে থাকা শিক্ষা উপমন্ত্রী মুহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেলের অনুসারী চমেকের তৃতীয় বর্ষের ছাত্র অভিজিৎ দাশ বলেন, তাদের (নগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও সাবেক সিটি মেয়র আ জ ম নাছির উদ্দীনের অনুসারী) কক্ষে ২-১ জন করে থাকে। আর আমাদের কক্ষে ৫-৬ জন গাদাগাদি করে থাকি। আমাদের বের করে দিতে তারা হামলা করেছে। তারা আমাদের কক্ষে ঢুকে বিছানা-বালিশ, টেবিল-চেয়ার তছনছ করেছে। কক্ষ ভাঙচুর করেছে। এমনকি আমাদের বই-খাতা পর্যন্ত ছিঁড়ে ফেলেছে। আমাদের পরীক্ষা চলছে। আমরা ভাইভা পরীক্ষার প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম।
নওফেলের অনুসারী তৃতীয় বর্ষের আরেক ছাত্র শামীম আহমেদ। তিনি বলেন, প্রথমে নাছির গ্রুপের অনুসারীরা এসে আমাদের কয়েকজন ছেলেকে রুম থেকে বের করে দেয়। এরপর আমরা প্রতিবাদ করলে তারা হামলা চালায়। ছাত্রাবাসের দ্বিতীয় ও তৃতীয় তলা মিলে তারা ১২-১৩টি কক্ষ ভাঙচুর করেছে।
অপরদিকে আ জ ম নাছিরের অনুসারী চমেক ছাত্রলীগের দপ্তর সম্পাদক অনির্বাণ দে বলেন, হোস্টেলের প্রায় সব কক্ষেই আমরা ছিলাম। তারা ছিল না। হঠাৎ করে তারা হোস্টেলে উঠে কক্ষ দখল শুরু করে। নিজেদের শিক্ষা উপমন্ত্রীর অনুসারী পরিচয় দিয়ে তারা ক্যাম্পাসে অস্থিতিশীল পরিস্থিতি তৈরির চেষ্টা করছে। আমার কক্ষে ঢুকে ভাঙচুর করেছে তারা।
তিনি বলেন, আমাদের ছাত্রলীগের পক্ষ থেকে ক্যাম্পাসে একটা আনন্দ মিছিলের কর্মসূচি ছিল। আমরা সেখানে ব্যস্ত ছিলাম। এই ফাঁকে তারা আমাদের রুমে ভাঙচুর শুরু করে। খবর পেয়ে আমরা আসি। পুলিশের সামনে তারা এ কাজ করেছে। পুলিশ কিন্তু বাধা দেয়নি।
আ জ ম নাছিরের অনুসারী চতুর্থ বর্ষের শিক্ষার্থী আসেফ বিন ত্বাকী রিফাত বলেন, চমেক ছাত্রলীগের রাজনীতি দীর্ঘদিন ধরে আ জ ম নাছির উদ্দীনের নিয়ন্ত্রণে আছে। এখন হুট করে যারা কোনোদিন ছাত্রলীগ করেনি, ছাত্রলীগের সভাপতির নাম বলতে পারবে না, ছাত্রশিবির করে আসা লোকজন নিজেদের ছাত্রলীগের নেতাকর্মী পরিচয় দিয়ে ক্যাম্পাসে কার্যক্রম চালাচ্ছে। আবার নওফেল বলছেন, ক্যাম্পাসে উনার কোনো গ্রুপ নেই। তাহলে আমাদের প্রশ্ন ক্যাম্পাসে যারা উনার নামে বিভিন্ন কর্মকাণ্ড করছেন তারা কারা?
সংঘর্ষ চলাকালীন সময়ে ঘটনাস্থলে গিয়ে দেখা গেছে, ছাত্রাবাসের সামনে আঙিনায় হকিস্টিক, ভাঙা ২টি চেয়ার, বালিশ-বিছানাপত্র, ছেঁড়া বইপত্র-ক্রেস্ট এবং অনির্বাণ দে’র ভিজিটিং কার্ড পড়ে আছে। দ্বিতীয় তলায় সাধারণ পাঠ কক্ষের জানালার কাঁচ, চেয়ার-বইয়ের তাক ভাঙা অবস্থায় দেখা গেছে। পাঠ কক্ষের ভেতরটা ইটের টুকরো ও লাঠি মজুদ করা অবস্থায় পাওয়া গেছে। এছাড়া বিভিন্ন কক্ষে খাট, বইয়ের তাক, টেবিল-চেয়ারসহ আসবাব এবং বিছানাপত্র এলোমেলো অবস্থায় দেখা গেছে। কয়েকটি কক্ষের দরজা-জানালাও ভাঙচুর হয়েছে।
উল্লেখ্য, চমেকে দীর্ঘদিন ধরে আ জ ম নাছির উদ্দীনের অনুসারী পরিচয় দেওয়া ছাত্রলীগের একক আধিপত্য ছিল। কিন্তু গত তিনবছর ধরে তাদের একক আধিপত্যের বিপরীতে শিক্ষা উপমন্ত্রী মুহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেলের অনুসারী পরিচয়ে ছাত্রলীগের আরেকটি অংশ ক্যাম্পাসে সক্রিয় হয়ে উঠে। এর আগেও উভয় পক্ষ কয়েক দফা সংঘর্ষে লিপ্ত হয়েছিল।
ছাত্রাবাসে উঠাকে কেন্দ্র করে গত বছরের ১৩ আগস্ট দুই পক্ষের মধ্যে সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছিল। ১২ জুলাই চমেক ক্যাম্পাসে ছাত্রলীগের দুই গ্রুপে মারামারিতে কমপক্ষে ১৩ জন আহত হন। এরপর নওফেলের অনুসারী চমেক ছাত্রলীগের নেতা খোরশেদুল আলম বাদী হয়ে ১১ চিকিৎসকসহ ৩৬ জনের বিরুদ্ধে একটি মামলা দায়ের করেন। নাছিরের অনুসারীরাও নওফেল অনুসারীদের বিরুদ্ধে আদালতে মামলা করেছিলেন।