ধর্ম সত্য। সত্যকে চাপিয়ে রাখা যায়, কিন্তু ধ্বংস করা যায় না। ধর্ম স্বয়ংসম্পূর্ণ, অপরদিকে বিজ্ঞান ধর্মব্যতীত অপরিপূর্ণ। ধর্ম, বিজ্ঞানের মুখাপেক্ষী নয়; বরং বিজ্ঞান ধর্মের মুখাপেক্ষী। ধর্মের মূল অংশ আধ্যাত্মিকতা। আধ্যাত্মিকতার অন্তর্নিহিত রহস্য/কারণ হলো বিজ্ঞান। বিজ্ঞানের সাথে ধর্মের বিরোধ কখনো ছিল না, বর্তমানেও নেই, ভবিষ্যতেও থাকবে না। বিজ্ঞান কখনো বলে না– এটা–ওটার ভিত্তি নেই। বিজ্ঞান এটাও বলে না যে– জীবনে ধর্মের প্রয়োজনীয়তা নেই। বিজ্ঞানের কাজ সত্যকে প্রমাণ করা। অর্থাৎ আধ্যাত্মিকজ্ঞানে লুকায়িত জ্ঞানকে গবেষণা করে সত্যটা মানুষের কাছে তুলে ধরা বিজ্ঞানের কাজ। বিজ্ঞান কখনো কোনো জ্ঞানকে ভিত্তিহীন বলে না। যেদিন গবেষণা করে এর সত্যতা বুঝতে পারে, তখন বলে হ্যাঁ এটি সত্য। অপরদিকে যখন গবেষণা করে পূর্ণসমাধানে আসতে পারে না, তখন বলে– ‘আমাদের গবেষণা এই পর্যন্ত যায়নি, এই পর্যন্ত পৌঁছতে পারেনি; তবে এটার ভিত্তি থাকতে পারে। গবেষণা যেদিন ঐ পর্যন্ত পৌঁছবে, সেদিন এই বিষয়ে কথা বলব। পরিপূর্ণ গবেষণা না করে কোনো জ্ঞানকে, বিজ্ঞান কখনো ভিত্তিহীন বা কুসংস্কার; এই জাতীয় কিছু বলে না।
যেহেতু আমরা ভৌতবিশ্বে বাস করি, ভৌতিকদেহ ধারণ করি এবং ভৌতবিষয় নিয়ে চলি– তাই ভৌতিক জ্ঞানকে কখনো উপেক্ষা করতে পারি না। ভৌতবিষয় গবেষণা করে ধারণা দেওয়ার নাম বিজ্ঞান। অপরদিকে ভৌত বিষয়ের উৎস কী, কোথা থেকে নিয়ন্ত্রিত হচ্ছে, কোন শক্তি নিয়ন্ত্রণ করছে, কে নিয়ন্ত্রণ করছে, এ সম্পর্কে পূর্ণজ্ঞান দেয় আধ্যাত্মিকতা। আর আধ্যাত্মিকতা আসে অনুভূতি থেকে, অনুভূতি আসে ধর্ম (নৈতিকতা) থেকে। ধর্মচর্চার নাম আধ্যাত্মবাদ। অতএব ধর্মের সাথে বিজ্ঞানের বিরোধ দূরের কথা; রয়েছে পারস্পরিক সম্পর্ক।
ধর্ম সত্য, তাই ধর্মের সাথে বিজ্ঞানের তুলনা হয় না। অনেকে মনে করেন কোনো বস্তুকে প্রমাণ করার জন্য গবেষণাগারে পরীক্ষা–নিরীক্ষা গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু বিজ্ঞান বলে– কোনো বস্তু কিংবা জ্ঞানকে প্রমাণ করার জন্য এর চেয়েও অধিকগুরুত্বপূর্ণ উপলব্ধি (রিয়েলাইজেশন)। উপলব্ধির পূর্বে প্রয়োজন অনুভূতি। এমনকী স্রষ্টার অস্তিত্ব আছে কি নেই, এ নিয়েও বিজ্ঞান কথা বলে না। গ্রষ্টার অস্তিত্ব নিয়ে অনেকেই প্রশ্ন তুলতে পারে, যেকোনো বিষয়ে আলোচনা হতেই পারে, হওয়াটাই স্বাভাবিক। এটি সবার অধিকার। কিন্তু গ্রষ্টার অস্তিত্ব নিয়ে প্রশ্ন তোলার পূর্বে অনুভূতি আছে কি–না দেখা উচিত। যাঁর অনুভূতি আছে, তাঁর জন্য গ্রষ্টা আছে, যার অনুভূতি নেই, তার বিশ্বাসে স্রষ্টা নেই। সে স্রষ্টাকে বুঝবেও না, চিনবেও না। স্রষ্টার অস্তিত্বে বিশ্বাসের জন্য প্রয়োজন দ্রষ্টার দৃষ্টি। দ্রষ্টার দৃষ্টির জন্য প্রয়োজন অনুভূতি ও চেতনা। অনুভূতি ও চেতনাকে জাগ্রত করার নাম আধ্যাত্মিকতা।
অতএব জ্ঞানের ওপরে বিজ্ঞান, বিজ্ঞানের ওপরে আধ্যাত্মিকতা। আধ্যাত্মিকতা ইন্দ্রিয়বাহ্যজ্ঞান বলে সহজে যে কেউ বুঝে উঠতে পারে না– তাই স্বীকার ও বিশ্বাস করতে চায় না। পশ্চিমাবিজ্ঞানীদের অনেকে প্রাথমিক দিকে মনে করেন গ্রষ্টা বলতে কিছু নেই; সবকিছু মধ্যাকর্ষণ শক্তি দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হচ্ছে। কিন্তু জ্ঞান–বিজ্ঞানের স্তর অতিক্রম করে অনুভূতির জগতে প্রবেশ করেন; তখন ধর্ম মানতে শুরু করেন। পদার্থবিজ্ঞনী আইনস্টাইন প্রথম দিকে বলেছেন– গ্রষ্টা বলতে কিছু নেই, সব মাধ্যাকর্ষণ শক্তি দ্বারা পরিচালিত হচ্ছে। কিন্তু শেষজীবনে বিজ্ঞানের স্তর অতিক্রম করে যখন অনুভূতির জগতে প্রবেশ করেন, তখন ধর্মের প্রতি বিশ্বাসী হয়ে ওঠেন। এবং স্বীকার করলেন– মহান শক্তিধর একজন আছেন, সবকিছু পরিচালিত করছেন। একইভাবে বিজ্ঞানী স্টিফেন হকিংও বিশ্বাস করতেন সব কিছু মধ্যাকর্ষণ শক্তির কারণেই হচ্ছে। শেষজীবনে তিনিও ভুল বুঝতে পেরে বলেছেন– সবকিছু এক শক্তি থেকে নিয়ন্ত্রিত হচ্ছে। আর তিনিই গ্রষ্টা। জ্ঞানের ঐ পর্যায়ে বিজ্ঞানীরা যখন পৌঁছেন– তখন আধ্যাত্মিক হয়ে ধর্ম মানতে শুরু করেন। এজন্য জ্ঞান–বিজ্ঞানের ওপরে ধর্মজ্ঞান। এটি হলো আধাত্মিক জ্ঞান, নৈতিকতার জ্ঞান, দৈবিক জ্ঞান, চেতনার জ্ঞান। জ্ঞান ও বিজ্ঞান, দুই স্তরের জ্ঞান দিয়ে কখনো প্রকৃত জ্ঞানী হওয়া যায় না। জ্ঞান–বিজ্ঞান ও আধ্যাত্মিকতার সমন্বয়ে পরিপূর্ণ জ্ঞানী হয়; যাঁদের আউলিয়া বলে। এজন্য আধ্যাত্মিক জ্ঞানীদের তুলনায় বিজ্ঞানীরা প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ছাত্র মাত্র।
ধর্ম ধারণে আমিত্ব, অহংকার চূর্ণবিচূর্ণ হয়। ধর্ম মানবকে বিনয়ী, উদার ও মানবিক করে। বিজ্ঞান যখন ধর্মহীন হয়, তখন এর দ্বারা মানবের অকল্যাণ হয়। ধর্মহীন বিজ্ঞানীরা বহুকিছু আবিষ্কার করলেও এতে কিছু উপকার হয় বটে কিন্তু সামষ্টিক বিশ্বমানবের কল্যাণে তেমন ভূমিকা রাখতে পারে না। কারণ তিনি মানবিক হয়ে ওঠেননি। এজন্য দেখা যায় –তাদের আবিষ্কার দ্বারা মানব কল্যাণের চেয়ে অকল্যাণই বেশি হয়। মানবিক হতে প্রয়োজন ধর্মচর্চা।
বিজ্ঞান থেকে ধর্ম বিচ্ছিন্ন হলে, সেই বিজ্ঞান দ্বারা মানবতার অকল্যাণ হয়। বিজ্ঞানের সাথে ধর্মযুক্ত হলে মানুষ মানবিক হয়। তখন তার আবিষ্কার দ্বারা মানবতার কল্যাণসহ বিশ্বশান্তিতে ভূমিকা রাখে। অপরদিকে ধর্ম থেকে বিজ্ঞানকে বিচ্ছিন্ন করলে, সেই ধর্ম দ্বারা জ্ঞান বিজ্ঞানে অবদান রাখা সহ বিশ্বমানবতার শান্তি ও কল্যাণে ভূমিকা রাখতে পারে না। এজন্য দুটোই খারাপ। মুসলিম উম্মাহ পিছিয়ে পড়ার অন্যতম কারণ– ধর্ম থেকে বিজ্ঞানকে বিচ্ছিন্ন করা, অপরদিকে ওয়েস্টার্ন বিজ্ঞানীদের অনেকেই অমানবিক হয়ে ওঠার অন্যতম কারণ বিজ্ঞান থেকে ধর্ম (আধ্যাত্মিকতা)কে বিচ্ছিন্ন করা।
তাই আধ্যাত্মিকজ্ঞানসম্পন্ন আধুনিক মানুষ গড়ার জন্য প্রয়োজন ধর্মের সাথে বিজ্ঞানের সমন্বয়। ফলে আমরা হব আধ্যাত্মিক জ্ঞানসম্পন্ন আধুনিক মানুষ। এজন্য আধ্যাত্মিক জ্ঞানকে ভিত্তিহীন বলে সাময়িকভাবে ধামাচাপা দেওয়া যায়, কিন্তু কখনো চিরতরে নষ্ট করা যায় না। অনুভূতিলব্ধ অতীন্দ্রিয়জ্ঞানকে ল্যাবরেটরিতে এনে পরীক্ষা ও পর্যবেক্ষণ করা যায় না। তবে উপলব্ধি করা যায়। যাঁরা ধর্মচর্চা দ্বারা আল্লাহর নৈকট্য অর্জন করে মহাজ্ঞানী হয়েছেন, তাঁদের আউলিয়া (আল্লাহর বন্ধু) বলা হয়। তাঁদের কথাবার্তা ও প্রতিটি রহস্যাবৃত কর্মকাণ্ডে প্রাকৃতিকতা খুঁজে পাওয়া যায়। যেখানে প্রাকৃতিকতা, সেখানেই আধ্যাত্মিকতা। তাঁদের রহস্যাবৃত ঘটনা, কর্মকাণ্ডের মধ্যে বিজ্ঞান নিহিত।
উদাহরণস্বরূপ– জনৈক প্রাচীনঋষির, শিষ্যের নিকটাত্মীয় পরলোকগত হলে শিষ্য মানসিক অবসাদ রোগে ভুগতে থাকেন। এমতাবস্থায় সতীর্থরা তাকে গুরুর সান্নিধ্যে আনলে তাকে অশোক বৃক্ষের নিচে কয়েকঘণ্টা বসিয়ে রাখার পরামর্শ দিলে সতীর্থরা একেবারে অশোক বৃক্ষের বাগানে বসিয়ে দেন। কয়েকঘণ্টা পর মানসিক রোগ থেকে আরোগ্য লাভ করেন। প্রাচীন ঋষি দিব্যজ্ঞানে জ্ঞানী হয়ে বুঝেছেন অশোক বৃক্ষে মানসিক অবসাদ রোগের ওষুধ আছে। এখানে ঋষির আশীর্বাদ এবং বৃক্ষের ঔষধি গুণাগুণের সংমিশ্রণে রোগী সম্পূর্ণ সুস্থ হয়। ঋষি দিব্যজ্ঞান দিয়ে যা বুঝেছেন, এর নাম আধ্যাত্মিক জ্ঞান। পরবর্তীতে আধুনিক বিজ্ঞান গবেষণা করে জানতে পেরেছেন; অশোক বৃক্ষে স্পয়নেল (ঝচঙওঘঊখ) নামক প্রাকৃতিক উপাদান আছে, যা মানসিক অবসাদ রোগের ওষুধ। বর্তমানে স্পয়নেল থেকে মানসিক অবসাদের প্রাথমিক ওষুধ তৈরি হয়।
আর একটি ঘটনা– ফটিকছড়ি মতিভাণ্ডার দরবার শরিফের সুফি হযরত মতিয়র রহমান শাহ্ (ক.) ফরহাদাবাদীর ১৯৬০ খ্রিষ্টাব্দ সময়কালের ঘটনা– ঐ সময় বসন্তরোগে দেশে অসংখ্য লোক মারা গিয়েছে। বাবাজানের গ্রামেও রোগের প্রভাব শুরু হলে (জনৈক) ভক্ত পরিত্রাণের জন্য তাঁর কাছে ফরিয়াদ করলেন। তখন মতিয়র রহমান শাহ্ (ক.) ঢোল–বাদ্য বাজানোর নির্দেশ দেন। ঢোল–বাদ্য বাজানোর এক পর্যায়ে তিনি (ফরিয়াদ করা) ভক্তের মাথায় হাত রাখলে তাঁর দিব্যদৃষ্টি খুলে যায়। তিনি দেখলেন বিভিন্ন আকৃতি ধারণকারী জীবাণুসমূহ বিক্ষিপ্ত হয়ে এদিক– ওদিক ছোটাছুটি করছে। সেই গ্রামে বসন্তরোগ আক্রমণ করতে পারেনি এবং সবাই অক্ষত ছিল। পরবর্তীতে বিজ্ঞান জানতে পারে –ছন্দযুক্ত ধ্বনিতে জীবাণু জমাটবদ্ধ হয়ে থাকতে পারে না। বিক্ষিপ্তভাবে ছোটাছুটি করে দুর্বল হয়। ছন্দযুক্ত ধ্বনিতে যে জীবাণু বিক্ষিপ্ত হয় হযরত মতিয়র রহমান শাহ দিব্যজ্ঞান দিয়ে দেখতে পেয়েছেন। অথচ তিনি কোনো ল্যাবরেটরীতে গবেষণা করে একথা বলেননি। তিনি এই জ্ঞান পেয়েছেন আধ্যাত্মিক রিয়েলাইজেশন থেকে। এটি অতীন্দ্রিয় জ্ঞান। আর গবেষণা দ্বারা আধ্যাত্মিকজ্ঞানের অন্তর্নিহিত কারণ বের করে, এর মাধ্যমে মানবতার কল্যাণ করার নাম বিজ্ঞান। অতএব রসুলে পাক (দ.)’র বিভিন্ন সুন্নত, আজমির শরিফ, মাইজভাণ্ডার শরিফ, মতিভাণ্ডার শরিফসহ ভারতবর্ষের অসংখ্য মুনিঋষি, আউলিয়াদের অলৌকিক কর্মকাণ্ডে নিহিত রহস্যকে উদঘাটন করে বিশ্ব মানবতার কল্যাণ সম্ভব হলে, তখন আমরাই হব জ্ঞানের জগতে বিশ্বগুরু। ধর্ম ও বিজ্ঞানের সমন্বয় করা গেলে, মানুষ একদিকে নৈতিক (ধার্মিক) হবে, অন্যদিকে বিজ্ঞানমনস্কতা অর্জন। এবং বহুমুখী আবিষ্কার দ্বারা মানবকল্যাণ করবে। ফলে বিশ্বে সকলেই হয়ে উঠবে আধ্যাত্মিকজ্ঞান সম্পন্ন আধুনিক মানুষ।
লেখক– প্রাবন্ধিক ও গবেষক।