
বাঙালি নারী জাগরণের ইতিহাসে বেগম রোকেয়ার নাম উচ্চারিত হয় শ্রদ্ধা ও গৌরবে। তিনি শুধু একজন সাহিত্যিক নন, ছিলেন সমাজসংস্কারক, শিক্ষাবিদ ও নারী–অধিকার আন্দোলনের অগ্রদূত। তাঁর রচনাগুলো আজও সমকালীন সমাজে সমান প্রাসঙ্গিক, কারণ তিনি এমন এক সমাজদর্শন নির্মাণ করেছিলেন, যেখানে নারী ও পুরুষের সমান অধিকার ও মানবিক মূল্যবোধের কথা প্রতিধ্বনিত হয়।
বেগম রোকেয়ার সাহিত্যচর্চার মূল লক্ষ্য ছিল সমাজে নারীর অবস্থান ও অধিকার বিষয়ে সচেতনতা সৃষ্টি করা। তাঁর গল্প, প্রবন্ধ, উপন্যাস ও রম্যরচনাগুলিতে সমাজের কুসংস্কার, অশিক্ষা ও পুরুষতান্ত্রিক মানসিকতার তীব্র সমালোচনা পাওয়া যায়।
বিশেষত তাঁর ‘সুলতানার স্বপ্ন’ রচনাটি এক অনন্য বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনি, যেখানে তিনি এমন এক সমাজের স্বপ্ন দেখিয়েছেন, যেখানে নারীরাই জ্ঞান, বিজ্ঞান ও রাষ্ট্রচিন্তার কেন্দ্রে। তাঁর ‘অবরোধবাসিনী’ প্রবন্ধে তিনি নারীকে গৃহবন্দি রাখার অমানবিক প্রথার বিরুদ্ধে যুক্তি ও ব্যঙ্গের মাধ্যমে প্রতিবাদ জানিয়েছেন। অন্যদিকে ‘পদ্মরাগ’ উপন্যাসে তিনি নারীদের শিক্ষা ও আত্মনির্ভরতার মাধ্যমে সামাজিক মুক্তির বার্তা দিয়েছেন। তাঁর সাহিত্যপাঠে সমাজে বিশেষ প্রভাব বিস্তার করে।
রোকেয়ার সাহিত্য শুধু নারীদের নয়, গোটা সমাজের চিন্তাধারায় আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল। তাঁর লেখায় মানবতা, ন্যায়বোধ ও স্বাধীনতার এক গভীর আবেদন আছে।
আজকের সমাজে যেখানে নারী নির্যাতন, অসম বেতন, যৌন হয়রানি, শিক্ষা ও কর্মক্ষেত্রে বৈষম্য এখনো বিদ্যমান –সেখানে রোকেয়ার চিন্তা ও সাহিত্য আমাদের ভাবায়, কতোটা পথ এখনও বাকি। তাাঁর লেখাগুলো আমাদের শেখায়—প্রকৃত উন্নয়ন তখনই সম্ভব, যখন নারী ও পুরুষ উভয়েই সমানভাবে শিক্ষা ও মর্যাদার অধিকার পাবে।
রোকেয়ার সাহিত্যপাঠ প্রয়োগে আজও আমাদের সমাজ সংস্কারে কার্যকর পথনির্দেশ দিতে পারে।
১. নারীশিক্ষা বিস্তারে প্রেরণা : তাঁর ভাবনা অনুযায়ী শিক্ষা কেবল ডিগ্রির জন্য নয়, মুক্ত চিন্তার জন্য প্রয়োজন। আজকের মেয়েরা তাঁর সাহিত্য থেকে আত্মবিশ্বাস ও সাহস অর্জন করতে পারে।
২. নারী–পুরুষ সমতার চেতনা : রোকেয়ার লেখাগুলো সামাজিক বৈষম্যের বিরুদ্ধে আমাদের সচেতন করে। তাঁর রচনা পাঠ করে শিক্ষার্থীরা ছোটবেলা থেকেই সমতার চেতনা অর্জন করবে।
৩. নারী ক্ষমতায়ন ও নেতৃত্ব : রোকেয়ার ‘সুলতানার স্বপ্ন’–এর মতো কল্পনার জগৎ আজ বাস্তবের দিগন্তে রূপ নিচ্ছে— বিজ্ঞান, প্রযুক্তি, প্রশাসন ও রাজনীতিতে নারীরা নেতৃত্ব দিচ্ছেন।
৪. মানবিক সমাজ গঠনে দিশা : রোকেয়ার সাহিত্য মানুষকে কুসংস্কার, ধর্মান্ধতা ও অন্ধ অনুকরণ থেকে মুক্তি দেয়; শেখায় যুক্তিবাদ, সহমর্মিতা ও ন্যায়ের পথ।
বেগম রোকেয়ার সাহিত্য শুধু অতীতের দলিল নয়, এটি আজও সমাজ পরিবর্তনের জীবন্ত উপকরণ। তাঁর লেখনী আমাদের মনে করিয়ে দেয় –শিক্ষা, যুক্তি ও মানবতার আলোতেই প্রকৃত সভ্যতা গড়ে ওঠে।
আজকের বাংলাদেশে বিভিন্ন ক্ষেত্রে নারী নেতৃত্ব, কর্মক্ষেত্রে নারীর অংশগ্রহণ, মেয়েশিশুর শিক্ষায় অগ্রগতি –এসবই রোকেয়ার স্বপ্নের ধারাবাহিক বাস্তবায়ন।
তবুও যতদিন নারীর প্রতি, বৈষম্য থাকবে, ততদিন বেগম রোকেয়ার সাহিত্য আমাদের চিন্তার দিশারি হয়ে থাকবে। তাঁর সাহিত্য যেন এক আলোকশিখা, যা যুগের অন্ধকার ভেদ করে মানুষের অন্তরে প্রশ্ন তোলে -‘আমরা কি সত্যিই সমতার পথে এগোতে পেরেছি?’ তাঁর প্রতিটি রচনা আমাদের সামনে ধরে একটি আয়না, যেখানে আমরা দেখতে পাই সমাজের সৌন্দর্য যেমন, তেমনি তার ত্রুটির গভীর ছায়াও। রোকেয়ার কলমে যে যুক্তির দীপ জ্বলে উঠেছিল, তা আজও নির্দেশ করে –শিক্ষাই মুক্তির পথ, সমতাই সভ্যতার মানদণ্ড, আর মানবিকতাই সামাজিক উন্নতির মূল ভিত্তি।
বর্তমান সমাজে নারীর অগ্রগতি দৃশ্যমান হলেও –ঘরের ভেতরের নীরব কান্না, কর্মস্থলে অসমতা, রাস্তায় নিরাপত্তাহীনতা, শিক্ষায় বৈষম্য –এসব এখনো রয়ে গেছে বাস্তবতার কঠিন প্রাচীর হয়ে। ঠিক এখানেই রোকেয়ার সাহিত্য আমাদের নতুন করে শেখায়, উন্নয়ন মানে কেবল অর্থনৈতিক অগ্রগতি নয়, উন্নয়ন মানে এমন একটি সমাজ গড়ে তোলা, যেখানে প্রতিটি মানুষ নিজের মতো করে বাঁচার স্বাধীনতা পায়।
তাই রোকেয়ার সাহিত্যপাঠ শুধু বিদ্যাচর্চা নয় –এটি দায়িত্ব, অঙ্গীকার এবং একটি ন্যায্য সমাজ গঠনের প্রতিদিনের প্রতিজ্ঞা। তাঁর লেখা আমাদের মনে করিয়ে দেয় যে সমাজ পরিবর্তন শুরু হয় চিন্তার পরিবর্তন থেকে, আর সেই চিন্তার ভিত রচনার ক্ষমতা রোকেয়ার সাহিত্য আজও বহন করে। অতএব, যতদিন সমাজে বৈষম্যের ছায়া থাকবে, ততদিন বেগম রোকেয়ার সাহিত্য হবে আমাদের আলোকদিশা –সমতার দিকে হাঁটার সাহস, মানবতার দিকে ফেরার পথ এবং ভবিষ্যতের কাছে আমাদের সবচেয়ে বড়ো অঙ্গীকার।
লেখক : কবি ও প্রাবন্ধিক











