আধুনিক প্রযুক্তির অপব্যবহার রোধে সচেতনতা প্রয়োজন

সালাহউদ্দিন শাহরিয়ার চৌধুরী | মঙ্গলবার , ১৪ জানুয়ারি, ২০২৫ at ৮:৫০ পূর্বাহ্ণ

বিশ্বে প্রতিনিয়ত প্রযুক্তির উন্নতি সাধন হচ্ছে এবং সে সকল প্রযু্‌ক্তির কিছু অংশ আমরা সর্বসাধারণ ব্যবহার করছি কখনো ইতিবাচকভাবে কখনো নেতিবাচকভাবে। সাম্প্রতিক সময়ে এআই প্রযুক্তি অর্থাৎ কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার আবির্ভাব ঘটছে, যা নিজ থেকে অনেক ধরনের সমস্যার সমাধান দিয়ে দিতে পারে, এক্ষেত্রে প্রশ্ন জাগবে এআই বা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা কীভাবে কাজ করে? বিভিন্ন নির্ভরযোগ্য সূত্র থেকে জানা যায়, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার মূল বিষয়টি হলো ডেটা সায়েন্স (তথ্য বিজ্ঞান), এই পদ্ধতিটি হলো একটি কম্পিউটিং ব্যবস্থা, যা মূলত তথ্য প্রক্রিয়াকরণের মাধ্যমে সবকিছু করে থাকে, যাতে প্রত্যেকটি তথ্য আমাদের মস্তিষ্কের মতো প্রক্রিয়া করে, ফলে নতুন এই প্রযুক্তি তথ্য সংরক্ষণ ও ভুলত্রুটি শনাক্ত ও সংশোধন করতে পারে।

কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই) স্বল্প সময়েই আমাদের আধুনিক বিশ্বের একটি জনপ্রিয় মাধ্যম হয়ে উঠেছে। কিন্তু কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ভালোর সম্ভাবনা সীমাহীন হলেও, তার অপব্যবহারের ফলে এটির অন্ধকার দিক নিয়ে অনেক উদ্বেগ রয়েছে। এই প্রযুক্তির অপব্যবহারের কারণে বৃদ্ধি পাচ্ছে গুজব এবং সেই গুজবগুলো এআই প্রযুক্তির মাধ্যমে এমনভাবে তৈরী করা হয় যা মানুষ অনেকটাই বিশ্বাস করতে বাধ্য হয় যার ফলশ্রুতিতে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এখন এর বিরূপ প্রভাব পড়তে শুরু করেছে। কিছু ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠান এআই প্রযুক্তির মাধ্যমে তৈরী বিভিন্ন ধরনের রাজনৈতিক, সামাজিক, ধর্মীয় কনটেন্ট প্রচার করছে যা আমাদের সকলকে বিভিন্ন কারণে বিভ্রান্ত করছে। এই প্রচারকারীদের মধ্যে রয়েছে কয়েকটি অংশ, তাদের একটি অংশ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তাদের ভিউ বাড়ানোর জন্য এই কাজটি করছে, কারণ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে অনেকগুলো প্রতিষ্ঠান একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ ভিউ তৈরী হলেই ঐ ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানকে বেশ ভালো অংকের অর্থ প্রদান করছে ফলে অর্থ প্রাপ্তির কৌশল হিসেবে অনেকেই এই প্রযুক্তির অপব্যবহার করছে, আরেকটি অংশ রয়েছে যারা উদ্দেশ্য প্রণোদিত হয়ে এই প্রযুক্তির মাধ্যমে কোন ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠান, ধর্ম এবং রাষ্ট্রকে হেয় করার জন্য অথবা রাজনৈতিক উদ্দেশ্য হাসিল এর জন্য স্ব উদ্যোগে এমন সব মিথ্যা কনটেন্ট তৈরী করছে এবং এই প্রযুক্তির অপব্যবহারের মাধ্যমে সেই সংবাদকে বিশ্বাসযোগ্য করার জন্য বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমের লোগোও ব্যবহার করছে। এখন নেতিবাচক বা গুজবের সত্যতা নিশ্চিত করার জন্য ফ্যাক্ট চেকার এর রিউমার স্ক্যানার এর কাজ করলেও সেই প্রযুক্তি ব্যক্তি বিশেষের পক্ষে ব্যবহার করা সম্ভব হয় না যার ফলে অনেক সময় মিথ্যা তথ্য ও গুজব সত্য বলে ধরে নেওয়া হয় এবং তাতে ঐ ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের সুনাম ক্ষুণ্ন হয় এবং বিকৃত সে সংবাদগুলো অনেকেই বিশ্বাস করে।

এখানে আমরা যারা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহার করছি তাদের প্রথমেই নিশ্চিত হতে হবে প্রকাশিত সংবাদের সত্যতা নিয়ে। বিকৃতরুচির কিছু ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের এই এআই প্রযুক্তি অপব্যবহার করে মানুষ সমাজ এবং রাষ্ট্রের জন্য ক্ষতিকর ভূমিকা পালন করছে, ফলশ্রুতিতে প্রযুক্তি সন্দেহাতীতভাবে অনেক সময় তার বিশ্বাসযোগ্যতা হারাচ্ছে। সম্ভাব্য ক্ষেত্রে আমাদের নানা কারণে প্রযুক্তির অপব্যবহার বৃদ্ধি পাচ্ছে যা আমাদের সমাজ এবং রাষ্ট্রের জন্য ক্ষতিকারক তাই এর অপব্যবহার রোধে সতর্ক থাকাটা অত্যন্ত জরুরি।

আমরা যে পদ্ধতিতে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা অনুসরণ করেছি সেটি অনেকটা যেন চেরাগের ভেতরে থাকা দৈত্যের মতো, যে শুধু আপনার হুকুম তামিল করতে পারে, ভালোমন্দ নির্ধারণ করার চিন্তাশক্তি তার নেই অর্থাৎ আপনি চেরাগে ঘষা দিবেন, আর দৈত্য বেরিয়ে এসে আপনি যা বলবেন তাই পালন করবে ভালোমন্দের কোনো ভেদাভেদ নেই। প্রকৃত অর্থে আমরা প্রযুক্তির অপব্যবহারের কারণে নিজেদের লক্ষ্য ভালোভাবে স্থির করতে পারছি না। সুতরাং যদি একটি যন্ত্র এমন একটি হীন উদ্দেশ্যে কাজ করতে শুরু করে, তখন সেটি মানব সভ্যতার জন্য শত্রু হয়ে উঠতে পারে, যেই শত্রু আমাদের চেয়ে অনেক শক্তিশালী হবে। তাই স্টিফেন হকিং থেকে শুরু করে ইলন মাস্ক সহ বিশ্বের শীর্ষ কয়েকজন বিজ্ঞানী কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন যেএটি একসময় হয়তো মানব জাতির জন্য একটি হুমকি হয়ে উঠতে পারে।

এআই এর বিপুল পরিমাণ ডেটা সংগ্রহ ও বিশ্লেষণ করার ক্ষমতা, নজরদারি উদ্বেগ সৃষ্টি করেছে বৈশ্বিকভাবে এবং এই কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার নেতিবাচক ব্যবহার, ডিজিটাল যুগে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাকে প্রশ্নবিদ্ধ করছে। প্রযুক্তিগত অগ্রগতি এবং ব্যক্তিগত গোপনীয়তার মধ্যে ভারসাম্য বজায় রাখা একটি চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার এই স্বর্ণযুগে। অনেক সময় অনেক ভালোর বিপরীতে দুষ্কৃতীকারীদের অপকৌশলের কারণে প্রযুক্তি সকলের জন্য ক্ষতির কারণ হবে। যেমনটি সাইবার নিরাপত্তার ক্ষেত্রে এআই হল একটি দ্বিধারী তলোয়ার এটি সাইবার হুমকির বিরুদ্ধে যেমন ব্যবহার করা হচ্ছে তেমনি কেউ কেউ এটি খারাপ উদ্দেশ্যেও অস্ত্র হিসেবেও ব্যবহার হচ্ছে। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তায় নৈতিক দ্বিধা রয়েছে; এই নৈতিক চ্যালেঞ্জগুলো প্রতিহত করার জন্য সতর্ক বিবেচনা এবং এই প্রযুক্তির নিয়ন্ত্রণ প্রয়োজন।

কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার শক্তি কেবল এর ক্ষমতার মধ্যেই নয় বরং আমরা কীভাবে এটি পরিচালনা করি তার উপর নির্ভর করে। যেহেতু কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা আমাদের বিশ্বকে গঠন করতে চলেছে, আগামীতে আমরা যে পছন্দগুলো করব তা নির্ধারণ করবে এই প্রযুক্তি, তাই আমাদের ভবিষ্যতে এর ভূমিকা সম্পর্কে অবগত থাকা এবং আলোচনায় জড়িত থাকাটা গুরুত্বপূর্ণ। আমাদের প্রয়োজন সতর্ক চিন্তাভাবনা এবং দায়িত্বশীল পদক্ষেপের মাধ্যমে আমরা বৃহত্তর ভালোর জন্য এআই এর সম্ভাবনাকে কীভাবে কাজে লাগাতে পারি এবং তার অন্ধকার প্রভাব থেকে দূরে সরিয়ে আনতে পারি। তখন ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি দিয়ে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ক্ষমতাকে আপনি যা করতে বলবেন, ঠিক সেটাই করবে এবং আপনি প্রযুক্তির যে সুবিধাগুলো চাইছিলেন, তাই পাবেন।

সুতরাং প্রযুক্তির ব্যবহার আমাদের যেমন অনেক দূর এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে তেমনি প্রযুক্তির অপব্যবহার আমাদের নৈতিকতাকে ধ্বংস করছে।

তাই বলবো, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার জন্য একটি ভারসাম্য আইন প্রয়োগ হলে এটি তার দায়িত্বশীল কর্মের মাধ্যমে এবং নিয়ন্ত্রণের প্রয়োজনীয়তার উপর জোর দেবে এবং ব্যক্তি সংস্থাগুলো সক্রিয়ভাবে নৈতিক মান স্থাপনের জন্য কাজ করবে এবং নিশ্চিত করবে যে, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা সামগ্রিকভাবে সমাজকে উপকৃত করছে এবং এটিই তার উদ্দেশ্য।

লেখক: ডেপুটি রেজিস্ট্রার, বিজিসি ট্রাস্ট ইউনিভার্সিটি, বাংলাদেশ।

পূর্ববর্তী নিবন্ধদক্ষিণ এশিয়ার উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় জনপদগুলোকে ঘিরে…
পরবর্তী নিবন্ধরাউজান চিকদাইর উত্তরায়ণ মহোৎসবের ৫০ বছর পূর্তি