আজ ১৭৬তম বিশ্ব এনেসথেসিয়া দিবস। এনেসথেসিয়া সার্জারীর একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। বর্তমান সময়ে এনেসথেসিয়া ছাড়া ছোট বড় কোনো অপারেশন চিন্তাও করা যায় না। মানুষ এ ব্যাপারে এখন অনেক সচেতন। দিনে দিনে এ বিষয়ের গুরুত্ব বাড়ছে এবং জনসাধারণও এটি উপলব্দি করছে।
সরকার এ বিষয়ের প্রয়োজনীয়তা উপলব্দি করে প্রতিটি উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে বিশেষজ্ঞ এনেসথেটিস্টদের পদায়ন করছে। ইতিহাস পর্যালাচনা করলে দেখা যায়, স্যার ডব্লিও. টি.জি মর্টন নামে এক স্বাস্থ্য বিজ্ঞানী ১৮৮৬ খ্রিষ্টাব্দে প্রথম এনেসথেসিয়া প্রদানের মাধ্যমে এ দিনটির শুভ সূচনা করেন। বিজ্ঞানের অবদানে সময়ের প্রয়োজনে এনেসথেসিয়া এখন অনেক আধুনিক।
দীর্ঘ পথ পরিক্রমায় এনেসথেসিয়া এখন অনেক আরামদায়ক এবং ভীতিহীনও বটে। বিশ্বের উন্নত দেশগুলোর সাথে পাল্লা দিতে সক্ষম এ মুহূর্তে বাংলাদেশের এনেস্থেটিস্টগণ। এ দেশের অনেক এনেসথেটিস্ট বিশ্বের বিভিন্ন দেশের উন্নত হাসপাতালগুলাতে সুনামের সাথে কাজ করে চলেছেন।
আমরা জানি, এনেসথেসিয়া প্রদানের মাধ্যমে বিভিন্ন ধরনের অপারেশন সম্পন্ন হয়। প্রকারভেদে জেনারেল এনেসথেসিয়া, রিজিওনাল এনেসথেসিয়া (স্পাইনাল এবং ইপিডুরাল এনেসথেসিয়া ওব্রেকিয়াল প্লেঙাস ব্লক) এর মাধ্যমে আজকাল নিরাপদ এনেসথেসিয়া প্রদান করা যায়। রিজিওনালএনেসথেসিয়ায় রোগীর জ্ঞান বজায় থাকে। নাভির নীচের অংশ অবশেষ জন্য স্পাইনাল এবংইপিডুরাল এনেসথেসিয়া দেওয়া হয়। ইপিডুরাল এনেসথেসিয়ার মাধ্যমে ব্যথাহীন সন্তান প্রসব করানো, ব্যথাহীন সিজারিয়ান অপারেশন এবং অপারেশন পরবর্তী ব্যথা নিরাময় করা যায়। তাছাড়া অন্যান্য অপারেশন তো আছেই। আর জেনারেল এনেসথেসিয়ার (অজ্ঞান করিয়ে অপারেশন) মাধ্যমে সববয়সের সকল অপারেশন করা সম্ভব। ব্রেকিয়াল প্লেক্সাস ব্লকের মাধ্যমে রোগীর জ্ঞান বজায় রেখে বাহু এবং হাতের যে কোনো অপারেশন সম্ভব।
যুগের প্রয়োজনে আধুনিক এনেস্থেসিয়া মেশিনের সাথে সাথে উন্নত মনিটরিং সিস্টেম সংযুক্তির ফলে নিরাপদ এনেসথেসিয়া এখন হাতের নাগালে। এ মুহূর্তে এনেস্থেসিয়া জনিত মৃত্যুর ঝুঁকি নেই বললেই চলে। তবে রোগীর নিবিড় পর্যবেক্ষণ নিরাপদ এনেসথেসিয়ার মূল ভিত্তি।
জনসংখ্যার ভিত্তিতে এনেস্থেটিস্টটের হার পূর্বের তুলনায় বেড়েছে বহুগুণ। এনেস্থেটিস্টটের পোস্ট যেমন বেড়েছে, সংখ্যাও তেমন বেড়েছে। তবে আমাদের দেশে এখনো পর্যাপ্ত এনেস্থেটিস্টটের অভাব রয়েছে। এ স্বল্পতা পূরণে সরকার বিভিন্ন পদক্ষেপ নিচ্ছেন।
বছব তিন চারেক আগে একবার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় কর্তৃক একটি প্রজ্ঞাপন জারী হয়েছিলো, অর্থাৎ বেসিক বিষয় অথবা নন ক্লিনিক্যাল বিষয়গুলো ছাড়াও এনেসথেসিওলজী, রেডিওলজী, ব্লাড ট্রান্সফিউশান বিষয়গুলোতে পর্যাপ্ত জনবল সৃষ্টির লক্ষ্যে এবং এসব বিষয়ে ডাক্তারদের আসতে উৎসাহী করার জন্যে ইনসেনটিভ প্রদান করার প্রস্তাব করা হয়েছিলো। পরবর্তীতে কোনো এক অদৃশ্য কারণে এ পদক্ষেপ আর আলোর মুখ দেখেনি।
এটি সরকারের একটি সময় উপযোগী সিদ্ধান্ত ছিলো বলে মনে করি। এনেসথেসিয়ার মতো একটি টেকনিক্যাল বিষয়ে ডাক্তারদের আসার আগ্রহ কম। তার অন্যতম কারণ হচ্ছে পেশাগত শ্রেণী বিন্যাস। দেখা যায়, একজন সিনিয়র এনেস্থেটিস্ট একটি অপারেশনে একজন সিনিয়র সার্জনের তুলনায় এক পঞ্চমাংশ থেকে এক দশমাংশ পর্যন্ত ফি কম পেয়ে থাকেন। এ ধরনের বৈষম্যও এনেস্থেসিয়ার মতো রিষয়ে ডাক্তারদের অনাগ্রহী হওয়া তথা এ বিষয়ে উচ্চ শিক্ষায় আগ্রহী না হওয়ার মূল কারণ এবং আমাদের দেশে এনেসথেসিয়ার পেশাগত প্রেকটিসটা অনেকটা সার্জনদের উপর নির্ভরশীল হওয়াটাও অন্যতম কারণ হতে পারে। যেহেতু রোগীরা সরাসরি এনেসথেটিস্টদের কাছে আসে না, সার্জনদের সাথে রোগীদের সরাসরি যোগাযোগ হয়। প্রি এনেসথেটিক চেক আপ এনেসথেসিয়ার একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ।
পেশাগত কারণে এনেস্থেটিস্টদের সাথে অপারেশনের পূর্বে রোগীদের সাক্ষাতের তেমন সুযোগ হয় না, তাই এনেস্থেটিস্টগন থাকেন পর্দার আড়ালে। প্রি এনেস্থেটিক চেক আপ বাধ্যতামূলক করা হলে রোগীরাও এনেস্থেটিস্টদের সাথে অপারেশনের আগে থেকেই সম্পৃক্ত হবে এবং রোগীর সাথে সহজাত আলাপের মাধ্যমে রোগীর শারীরিক অবস্থা সম্পর্কে এনেসথেটিস্টগণ ভালো ভাবে অবহিত হতে পারবে, তাছাড়া রোগীর সাথে আলাপের মাধ্যমে রোগীর অপারেশনের পূর্বে রোগীকে অপারেশন এবং এনেস্থেসিয়া সম্পর্কিত ধারণা দেয়া যাবে। এতে রোগীদেরকে আশ্বস্ত করার মাধ্যমে রোগীর অপারেশন এবং এনেস্থেসিয়াভীতি বহুলাংশে কমে যাবে এবং রোগীর অপারেশনকালীন জটিলতাও কমে যাবে।
বর্তমানে সার্জারীর বিষয় যেমন বেড়েছে সে হিসাবে এনেস্থেটিস্ট তেমন বাড়েনি। এনেস্থেটিস্টের স্বল্পতাই অপারেশনের সংখ্যা রাশের মূল কারণ। তাছাড়াও সিনিয়র এনেস্থেটিস্টরা অবসরে চলে যাওয়াতে দক্ষ এনেস্থেটিস্টের শূন্যতা বাড়ছে দিনে দিনে।
গত বছর করোনাকালীন সরকার এ ব্যাপারে একটি উদ্যোগ নিয়েছিলেন যেমন সরকারি ও বেসরকারি পর্যায় থেকে পোস্ট গ্র্যাজুয়েট ডিগ্রি অর্জনকারী বেশ কিছু ডাক্তারকে কনসালটেন্ট পদে নিয়োগ দিয়েছেন। অবশ্য সরকার বিগত কয়েক বছরে এ ব্যাপারে আরো পদক্ষেপ নিয়েছেন যেমন চাকরি থেকে অবসরের পর চুক্তিভিত্তিক নিয়োগের মাধ্যমে সিনিয়র এনেসথেটিষ্টদের পদায়ন করছেন। এটি সরকারের একটি ইতিবাচক পদক্ষেপ বলে মনে করি।
২০১৭ খ্রিষ্টাব্দের ‘এনেস্থেসিয়া ডে’র থিম ছিলো, ‘Qualified anaesthesiologist, Quality anaesthesia’ এটি সময়ের কথা, সময়ের শ্লোগান। একজন সুপ্রশিক্ষিত এনেস্থেটিস্টই শুধু মানসন্মত এনেস্থেসিয়া প্রদানে সক্ষম। নিরাপদ এনেস্থেসিয়া আমাদের সবার কাম্য।
রোগীরা অপারেশন শেষে সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরে যাক, এটি সবাই আশা করে। ডাক্তারদের উচিত রোগীদেরকে আপনজন ভেবে তার দায়িত্ব পালন করা। রোগীর প্রতি মমতা, নিবিড় পর্যবেক্ষণই রোগীকে সুস্থ করার ব্যাপারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে, এটি চিকিৎসকদের মনে রাখা উচিত। রোগীরা অত্যন্ত অসহায় হয়েই একজন চিকিৎসকের শরণাপন্ন হন। রোগীদের প্রতি দায়বদ্ধতা, রোগীদের বিশ্বাস অর্জন করার মাধ্যমে ডাক্তারের প্রতি রোগীর শ্রদ্ধাবোধ তৈরি হবে।
একজন চিকিৎসক কখনোই কামনা করেন না, একজন রোগীর খারাপ কিছু হোক। চিকিৎসকের প্রতিও মানুষের বিশ্বাস রাখতে হবে। এভাবেই ডাক্তার এবং রোগীর মধ্যে সুন্দর সম্পর্ক বজায় থাকবে। ডাক্তার হিসাবে একজন এনেসথেটিস্ট একজন রোগীর অপারেশনকালীন সময় গুরুদায়িত্ব পালন করে থাকেন বিধায় এনেসথেটিস্টদের যথাযথ: মূল্যায়ন হওয়া প্রয়োজন। সেবা চিকিৎসকদের মহান পেশা। পেশার প্রতি সবার শ্রদ্ধাবোধ থাকা উচিত। সেবামূলক মনোবৃত্তি নিয়ে চিকিৎকদের কাজ করে যেতে হবে তাহলে মানুষের তথা দেশের মঙ্গল হবে।
লেখক : অধ্যাপক, বিভাগীয় প্রধান,
সাউদার্ন মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল চট্টগ্রাম।