ভালুক যা করে বাদুড়ও তা করে, এমনকি ইউরোপীয়ান হেজহগেরাও তাই করে – এরা সবাই ভয়াবহ শীতের কঠিন সময়ে গভীর শীতনিদ্রায় আচ্ছন্ন থাকে। এখন দেখা যাচ্ছে যে আদিম মানুষেরাও প্রচণ্ড ঠাণ্ডাকে উপেক্ষা করার জন্য এ পথটিই বেছে নিত-অন্তত কিছু জীবাশ্ম বিশেষজ্ঞ তাই মনে করছেন।
পৃথিবীর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ জীবাশ্ম এলাকা থেকে যেসব মানব হাড় উদ্ধার করা হয়েছে সেসব পরীক্ষা নিরীক্ষার পর মনে হচ্ছে আমাদের হোমিনিড পূর্বপুরুষেরা ভয়ানক শীত থেকে বাঁচার জন্য লক্ষ লক্ষ বছর আগে পুরো শীতকাল জুড়ে শীতনিদ্রার কৌশলটি বেছে নিত।
বিজ্ঞানীরা যুক্তি দেখালেন যে আদি মানবের জীবাশ্মযুক্ত হাড়ে যে ক্ষত ও অন্যান্য ক্ষতির চিহ্ন পাওয়া গেছে তার সাথে যেসকল প্রাণী শীতনিদ্রা যেত তাদের হাড়ের সাদৃশ্য রয়েছে। এর ফলে এটার ব্যাপারে নিশ্চিত হওয়া যায় যে আমাদের পূর্বপুরুষেরা ভয়াবহ শীতের সাথে নিজেদের মানিয়ে নেওয়ার কৌশল হিসেবে এটিকেই বেছে নিয়েছিল যা তাদের বিপাকক্রিয়াকে ধীরগতি করেছিল ও তারা মাসের পর মাস ঘুমিয়ে কাটাত।
উত্তর স্পেনের বুরগসের কাছে আটাপুয়েরেকা নামক গুহা যা সিমা দি লস ওয়েসস বা পিট অফ বোনস নামে খ্যাত, এর উপরে যেসব খননকাজ চালানো হয়েছে তার উপর ভিত্তি করে এই উপসংহার টানা হয়েছে।
গত তিনদশকে আটাপুয়েরেকার ৫০ ফুট উঁচু আকৃতির কাঠামোর একেবারে তলের মধ্যাংশ থেকে খননকাজের ফলে হাজার হাজার মানব দেহাবশেষ পাওয়া গেছে। গবেষকেরা ঐ গুহায় কয়েক হাজার দাঁত ও হাড়ের টুকরা খুঁজে পেয়েছেন যা দেখে মনে হয় মৃতদেহগুলো ইচ্ছাকৃতভাবে ওখানে স্তূপ করা হয়েছে যা আসলেই একটি গণকবর। এই জীবাশ্মগুলো ৪ লক্ষেরও বেশি বছরের পুরোনো ; হয়ত এগুলো আদি নিয়ানডারথলস বা তাদের পূর্বপুরুষদের।
এই জায়গাটি হচ্ছে এই গ্রহের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ পুরাতাত্ত্বিক গুপ্ত ধন-সম্পদের খনি। খননে প্রাপ্ত জীবাশ্মগুলোর গবেষণা থেকে ইউরোপের মানব বিবর্তনের গভীর অন্তর্দৃষ্টি সম্পর্কে ধারণা লাভ করা যায়। কিন্তু এখন আবার কিছু গবেষক প্রচলিত এই ধারণা সম্পর্কে একটি ভিন্নধর্মী অবস্থান গ্রহণ করেছেন।
এই স্থানটির প্রথম খননকাজে জড়িত দলের নেতৃত্বদানকারী হুয়ান-লুইস আরসুয়াগা এবং গ্রীসের ডেমোক্রিটাস ইউনিভার্সিটি অফ থ্রেইস এর এনটোনিস বার্টসিওকাস – এই দুইজন লা এনথ্রোপলজি জার্নালে প্রকাশিত একটি গবেষণা পত্রে বলেছেন, ওখানে প্রাপ্ত জীবাশ্মগুলোতে মৌসুমিক রূপান্তর পাওয়া গেছে যা দেখে বুঝতে পারা যায় যে হাড় বৃদ্ধির হার প্রতিবছরের কয়েকমাস ব্যাহত হয়েছিল।
তাঁরা বলেছেন যে, আদি মানবেরা নিজেদেরকে এমন একটা বিপাকীয় অবস্থায় উপনীত হতে দেখেছে যা তাদেরকে লম্বা সময় ধরে হিমশীতল অবস্থায় সীমিত খাদ্য সরবরাহ ও শরীরের চর্বির পর্যাপ্ত সংরক্ষণের কারণে টিকে থাকতে সাহায্য করছে। তারা গভীর শীতনিদ্রায় আচ্ছন্ন থাকত যা হাড় বৃদ্ধির ব্যাঘাতের কারণ হিসেবে নির্ণিত হয়েছে।
গবেষকেরা এই ধারণাটা স্বীকার করে নিয়েছেন ‘এটা বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনীর মত মনে হতে পারে’ কিন্তু তাঁরা এটাও বলেছেন যে অনেক স্তন্যপায়ী প্রাণী যেমন প্রাইমেট দলভুক্ত বুশবেরি ও লিমার এই শীতনিদ্রায় অভ্যস্ত। “এটাই মনে হচ্ছে যে, এই ধরনের নিম্নমুখী বিপাকক্রিয়ার জীনগত ভিত্তি ও শারীরবৃত্তীয় কারন মানুষসহ অনেক স্তন্যপায়ীভুক্ত প্রজাতির মধ্যে সংরক্ষিত রয়েছে।”
আরসুয়াগা ও বার্টসিওকাস ধারণা করেন যে, সিমা গুহায় প্রাপ্ত মানব হাড়ের যে ক্ষতের ধরন দেখা গেছে তা গুহা ভালুকসহ শীতনিদ্রায় আচ্ছন্ন স্তন্যপায়ীদের হাড়ে প্রাপ্ত ক্ষতের সাথে মিল রয়েছে। তাঁরা বলেন, শীতনিদ্রার কৌশলটি হিমশীতল অবস্থায় গুহার মধ্যে মাসের পর মাস টিকে থাকার ক্ষেত্রে একমাত্র সমাধান হিসেবে প্রতীয়মান হচ্ছে। তাঁরা এটাও বলেছেন যে, সিমা কূপে শীতনিদ্রা যাওয়া গুহা ভালুকদের (আরসুস ডেনিনগেরি) যে দেহাবশেষ পাওয়া গেছে তাতে আদি মানবেরাও যে হিমশীতল অবস্থায় খাদ্যাভাব থেকে বাঁচার জন্য একই পন্থা অবলম্বন করত তা প্রমাণ করে।
এই গবেষকেরা অন্যান্য ভিন্নমত নিয়েও পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেছেন। আধুনিক ইনিউয়েট এবং সামি আদিবাসীরাও একইরকম ভয়াবহ হীমশীতল অবস্থায় বসবাস করছে কিন্তু তারা শীতনিদ্রায় যায় না। কিন্তু সিমা গুহার লোকজন কেন এই পন্থা অবলম্বন করত? আরসুয়াগা ও বার্টসিওকাস এই প্রশ্নের উত্তর দিয়েছেন এভাবে – ইনিউয়েট ও সামি সমপ্রদায়ের মানুষেরা চর্বিযুক্ত মাছ ও বলগা হরিণের চর্বি থেকে শীতের সময় প্রয়োজনীয় খাবার পেয়ে থাকে। এর ফলে তাদের আর শীতনিদ্রার প্রয়োজন হয় না। অন্যদিকে ৫ লক্ষ বছর আগে সিমা স্থানটির আশেপাশের এলাকায় পর্যাপ্ত পরিমাণ খাবারের অভাব ছিল। তাঁরা আরও বলেন: “ক্রম শুষ্কময় আইবেরিয়া সেই সময় ভয়াবহ শীত ঋতুতে সিমা অঞ্চলের অধিবাসীদের যথেষ্ট সমৃদ্ধ চর্বিযুক্ত খাবার সরবরাহ করতে পারত না। তাই তাদেরকে একরকম বাধ্য হয়েই ভয়াবহ শীত ঋতুতে গুহার মধ্যে শীতনিদ্রায় আচ্ছন্ন থাকতে হত।”
নিউক্যাসেলের নর্থাম্ব্রিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ফরেনসিক নৃবিজ্ঞানী প্যাট্রিক রানডলফ- কুইনি বলেছেন, এটা খুবই একটি চমৎকার যুক্তি এবং এটা নতুন বিতর্ক উস্কে দিতে পারে। সে যাহোক সিমা স্থানটিতে প্রাপ্ত মানব হাড়ের ভিন্নতা নিয়ে অন্য ব্যাখ্যাও দেওয়া যেতে পারে। কোন বাস্তবসম্মত উপসংহারে পৌঁছানোর আগে আমাদেরকে সবকিছু নিয়ে পুরোপুরি ভাবতে হবে। আমার ধারণা এটি এখনও করা হয়নি।
লন্ডনের ন্যাচারাল হিস্ট্রি মিউজিয়ামের ক্রিস স্ট্রিংগার ভিন্নমত প্রকাশ করে বলেছেন, আসলে ভালুকের মত বড় আকারের স্তন্যপায়ী প্রাণীরা শীতনিদ্রায় যেতে পারে না কারণ তাদের বড় শরীর শরীরের ভেতরের তাপমাত্রা যথেষ্ট পরিমাণে কমাতে পারে না। এর পরিবর্তে তারা অগভীর ঘুমে আচ্ছন্ন হয়ে থাকতে পারে যাকে নিষ্ক্রিয়তা আখ্যা দেওয়া হয়। এই অবস্থায় সিমা অঞ্চলের অধিবাসীদের মানব আকৃতির মস্তিষ্কে যে শক্তির প্রয়োজন ছিল তা ছিল সঙ্গতভাবে অত্যন্ত বেশি। তাই নিষ্ক্রিয়তার সময়কালে টিকে থাকার লড়াইয়ে আদিম মানুষেরা আরও অনেক সমস্যার মুখোমুখি হত। উনি আরও বলেন যে, সে যাহোক এটি একটি চমৎকার ধারণা।সিমা অঞ্চলের লোকজন, নিয়ানডারথলস ও ডেনিসভানসদের জিনম পরীক্ষা করে নিষ্ক্রিয়তার শারীরবৃত্তীয় কার্যকলাপের সাথে সম্পর্কিত জিনগত পরিবর্তনের চিহ্নগুলি যাচাই বাছাই করে দেখতে হবে। [দা গার্ডিয়ান থেকে অনূদিত]
ইসমত আরা জুলী : কবি, প্রাবন্ধিক ও অনুবাদক