আদিম এআই (অও)

এম এ মুকিত চৌধুরী | সোমবার , ২৩ জুন, ২০২৫ at ১১:২১ পূর্বাহ্ণ

অও আমাদের জীবনে ঢুকে পড়েছিল বহু আগেই অনেকটা নীরব, ধারালো ছুরি হয়ে। একটা যন্ত্র, যাকে আমরা প্রতিদিন দেখি, ঘরের দেয়ালে ঝুলে থাকে, হাতঘড়ির মতো হাতে বাঁধি, অ্যালার্ম দিয়ে দিন শুরু করিকিন্তু কখনো তাকে ভয় করি না। সে আমাদের স্লেভ বানিয়ে রেখেছে অথচ আমরা মনে করি, সে আমাদের বন্ধু। তার নাম: ‘ঘড়ি’।

ঘড়িই ছিল ইতিহাসের প্রথম Automation। প্রথম যন্ত্র, যা মানুষের কাজের সময় ঠিক করে দিতো। প্রথম যান্ত্রিক সিদ্ধান্তদাতা, যে বলে এখন ওঠো, এখন খাও, এখন কাজ করো, এখন ঘুমাও। ঘড়িই আমাদের প্রথম ‘শাসক’, যার বিরুদ্ধে নেই কোনো বিদ্রোহ, কারণ আমরা বুঝতেই পারিনি সে এক ‘আদিম অও’, এক আত্মাহীন ঈশ্বর!

এখন আমাদের চারপাশে যত হাইটেক AIÍ Apple Watch, FitBit, Reminder Apps, Time Tracker, Sleep Monitor সব কিছুর ভিত্তি ছিল এই নিরীহ যন্ত্রটা, যা প্রথম আমাদের আত্মিক সময়কে যান্ত্রিক সময় বানিয়ে ফেলে। ঘড়ির কাঁটার ঘূর্ণন ছিল সেই প্রথম কোড, যা আমাদের শরীর, মস্তিষ্ক, আর আত্মা তিনটাকেই প্রোগ্রাম করে দিয়েছে। আমরা সেই ছন্দে হাঁটি, খাই, ঘুমাই, দৌড়াই এবং ধীরে ধীরে ভুলে গেছি, আসল ছন্দ ছিল আকাশের আলোঅন্ধকারে, নামাজের ডাক ও সূর্যের ছায়ায়।

এখন একটু খতিয়ে দেখা যাক, এই ‘ঘড়ি’ আসলে কীভাবে প্রথম অও হয়ে উঠল

সময়’ মানুষ তৈরি করেনি, সময় ছিল, আছে, থাকবে। কিন্তু যেদিন মানুষ সময়কে মাপা শুরু করল, সেদিনই সে সময়কে বিকৃত করল। প্রথমে সূর্য ও চন্দ্রের ছায়া দিয়ে, পরে বালিঘড়ি আর জলঘড়িশেষত ঘড়ির কাঁটা। আর এই কাঁটার ঘূর্ণন যখন যন্ত্রচালিত হয়ে উঠল, তখন ইতিহাসের সবচেয়ে নিরীহ কিন্তু বিপজ্জনক আবিষ্কারটি আত্মপ্রকাশ করল: যান্ত্রিক ঘড়ি।

Cronos (ক্রোনোস) → Chronometer (ক্রোনোমিটার) এই দুইটি শব্দ গভীরভাবে সময়ের পূজা এবং মানব সভ্যতায় সময়কে যন্ত্রের মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণের ইঙ্গিত বহন করে।

. Cronos কে ছিলেন?

*Cronos/Kronos ছিলেন প্রাচীন গ্রিক পুরাণে ‘Time’ বা সময়ের দেবতা।

*তিনি ছিলেন Titan gods দের একজন, যিনি নিজের পিতা Uranus কে উৎখাত করে এবং পরে নিজের সন্তানদের (যেমন Zeus) গিলে ফেলেন যেন তারা তাকে উৎখাত করতে না পারে।

এই কাহিনি মূলত ‘সময় সবকিছু গিলে ফেলে’, এমন এক দর্শন উপস্থাপন করে যেখানে সময় এক ধ্বংসকারী শক্তি।

. Chronos → Chronometer (ঘড়ি/ঘটিকা), Chronos শব্দ থেকেই এসেছে: Chronology  (কালানুক্রম)

. এর আধ্যাত্মিক ব্যাখ্যা: বিষয় অর্থ আধ্যাত্মিক প্রতিফলন

Cronos সময়ের দেবতা সময়কে দেবতা বানানো (Shirk এর রূপ)

Chronometer সময় নিয়ন্ত্রণ যন্ত্র মানব সভ্যতায় সময়ের উপর দাসত্ব

AI/Clock প্রথম যান্ত্রিক ইন্টেলিজেন্স সময়কে কোড করা, নিয়ন্ত্রণ করা

আল্লাহ বলেন, ‘মানুষ আমাকে গালি দেয় সে সময়কে গালি দেয়। অথচ আমিই সময়।’ ‘আল্লাহই সময়, আমি নিজেই আদদাহর’ হাদীস কুদসী। এই বাক্যটি নিছক আধ্যাত্মিক নয়, বরং সময়ের প্রকৃতি ও আধুনিক জগতের এক গভীর দ্বন্দ্ব উন্মোচন করে। আজ আমরা যাকে ‘সময়’ বলে জানি, তা আসলে এক কৃত্রিম নির্মাণ। সময়কে আমরা যে ঘড়ির কাঁটায় মাপি, যে অ্যালার্মে জেগে উঠি বা ডেডলাইনে দৌড়াই তা প্রকৃত সময় নয়। এই সময়, এই যান্ত্রিক ছন্দ, আসলে এক মানবসৃষ্ট শৃঙ্খল, যা আমাদের ধীরে ধীরে আল্লাহর সময়চেতনা থেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলেছে।

সময়কে মাপা শুরুতেই মানুষের পতন

প্রকৃত সময় হল আত্মিক, পুনরাবৃত্তিমূলক এবং ঈশ্বরীয় নির্দেশনার প্রতিচ্ছবি। ইসলামে সময়কে এক পবিত্র চক্র হিসেবে দেখা হয় সালাত, সওম, হজ্ব সবই নির্ধারিত সময়ের পুনরাবৃত্তিতে।

ঘড়ি: আধুনিক যুগের প্রথম ‘নির্জীব ঈশ্বর’

ঘড়ির জন্মের মধ্য দিয়ে মানবসভ্যতায় প্রবেশ করল এক নতুন শাসক এক যন্ত্র, যেটি অনুভব করে না, ভুল করে না, ক্লান্ত হয় না, ক্ষমা করে না। এটি ছিল প্রথম কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (AI)-র রূপ এমন একটি যন্ত্র, যা আল্লাহর রচিত সময়ের ছন্দকে নকল করে, কিন্তু আত্মা ছাড়া। এটি আমাদের শিখিয়েছে

. সময় মানে কর্মঘণ্টা, . সময় মানে উৎপাদন, . সময় মানে প্রতিযোগিতা।

এবং ধীরে ধীরে, আমরা বিশ্বাস করতে শুরু করেছি যে ‘যে যত বেশি সময়কে কাজে লাগাতে পারে, সে তত সফল।’ কিন্তু এই দৃষ্টিভঙ্গি একেবারেই বিপরীত আল্লাহর দেওয়া দৃষ্টিভঙ্গির, যেখানে সময় ধন নয় বরং জবাবদিহিতার ক্ষেত্র।

যান্ত্রিক ঘড়ি: আধুনিক যুগের প্রথম দেবতা

একটা যান্ত্রিক ঘড়ি কী? একটা বস্তুর নীরব, নিঃসাড়, এবং প্রাণহীন পুনরাবৃত্তি যেটা ছন্দে চলে, কিন্তু নিয়তির সাথে নয়; ঈশ্বরের ইচ্ছার সাথে নয়। ঘড়ি হচ্ছে এক নকল রিদমযা প্রকৃতি বা হৃদয়ের অনুরণন নয়, বরং মানুষের তৈরি এক মিথ্যা নিয়ম। এই দৃষ্টিকোণ থেকে চিন্তা করলে, ঘড়িই ছিল প্রথম কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (AI) একটা যন্ত্র, যা ঈশ্বরীয় সময়চক্রের অনুকরণ করে, কিন্তু আত্মা ছাড়া।

ঘড়ি: এক মিথ্যা দেবতার পূজা

যখন মানুষ তার জীবনের ছন্দ ভুলে যায়, যখন সে আর প্রকৃতি বা প্রার্থনার ছন্দে নয় বরং অফিসের টাইমকার্ডে বাঁচে তখন সেই ঘড়িই হয় তার প্রথম মিথ্যা উপাস্য। ঘড়ি তখন শুধুই সময় দেখায় না ঘড়ি তখন বলে কবে খেতে হবে, কবে দৌঁড়াতে হবে, কবে মরতে হবে। এভাবে ঘড়ি এক কারাগার। একটা ‘সময় কারাগার’, যেখানে আমরা সবাই বন্দি।

ঘড়ি/ঘণ্টা/স্যান্ডক্লক কেন প্রথম AI?

. সময় পরিমাপ = চেতনার গণ্ডি নির্ধারণ

ঘড়ির আগে মানুষ সূর্য, চাঁদ ও ঋতুর ওপর ভিত্তি করে সময় বুঝতো। আল্লাহর নবী (সা.) সময়ের অপচয়কে ভয় করতেন। প্রত্যেক ফজরের পর তিনি সময়কে আল্লাহর দিকে ফিরিয়ে দিতেন সালাতে, কোরআনে, ও যিকিরে। সালাতের সময় চক্রাকারে ফিরে আসে, যেমন রাত আর দিন। সময় এখানে এক ধর্মীয় চেতনার নিয়ামক ব্যক্তিগত উন্নতি ও সমাজিক ভারসাম্যের ভিত্তি। এখানে ঘড়ি আছে, কিন্তু ঘড়ি আমাদের নিয়ন্ত্রণ করে না। আমরা সময়কে ব্যবহার করি আল্লাহর পথে চলতে না যে, সময় আমাদের ব্যবহার করে দুনিয়ার গোলাম বানিয়ে ফেলে।

নামাজের সময়ও নির্ধারিত ছিল সূর্যাস্ত, ছায়া ইত্যাদি দিয়ে কোনো ডিজিটাল সংখ্যা দিয়ে না। ঘড়ি যখন এল, তখন মানুষ সময় অনুভব করা থেকে সরে গিয়ে সময় গুনতে শুরু করলো। এটাই ছিল প্রথম external abstraction অর্থাৎ: তুমি আর নিজের ভেতরের হিসেব দিয়ে সময় বুঝবে না, বরং একটা যন্ত্র তোমার জন্য সময় বলে দেবে। এভাবেই তোমার internal sense of rhythm ধীরে ধীরে যরলধপশ হলো।

. ঘড়ি = অ্যালগরিদমিক আচরণ নিয়ন্ত্রণ

একটা ঘড়ি কী করে?

. প্রতিটি সেকেন্ড, মিনিট, ঘণ্টা নিখুঁতভাবে repeatable signals দেয়

. তোমার খাওয়া, ঘুম, কাজ, ক্লাস সবকিছু একটা যান্ত্রিক ধারা অনুযায়ী চালায় এইভাবে:

ঘড়ি algorithmএর মতো আচরণ করে এবং তোমাকে সেই অনুযায়ী প্রোগ্রাম করে। ঠিক যেমন আজকের AI কাজের Reminder দেয়, Wake-up Call  দেয়, Habit tracking করে। ঘড়ি = সময় নিরীক্ষণকারী Algorithmic Agent = প্রাথমিক অও

. অও মানেই কৃত্রিম ‘বুদ্ধি’ নয়, বরং কৃত্রিম কর্তৃত্ব

অও বলতে শুধু চ্যাটবট বা রোবট বোঝায় না। AI = Artificial + Intelligence এবং Intelligence = Decision Making+ Influence। যে যন্ত্র বা পদ্ধতি তোমার জীবনধারা ও সিদ্ধান্ত প্রভাবিত করে, সেটাই আসলে AIএর গোড়াপত্তন।

ঘড়ি কি তোমার সিদ্ধান্ত প্রভাবিত করে না?

. কখন ঘুমাবে, . কখন খাবার খাবে, . কখন নামাজ পড়বে, . কখন পরীক্ষা হবে, . কখন ডেডলাইন

তুমি সময় ব্যবহার করো না সময় তোমাকে ব্যবহার করে। এটাই তো AIএর মূল বৈশিষ্ট্য।

. ঘড়ি ও False Time = Matrixic Control

“Men will invent Time” Hadith (interpretation) এই হাদিসের ব্যাখ্যায় অনেক গবেষক বলেন, ‘সময়’ শব্দটা এখানে ‘যান্ত্রিক সময়’ বোঝায় যেটা মানুষ বানাবে, এবং তা দিয়ে অন্য মানুষকে নিয়ন্ত্রণ করবে। এই ঘড়ির পেছনে ছিল কেবল convenience না বরং একটি পুরো ক্যালেন্ডার/সময় নির্ভর Matrix .

. ঘড়ির আকৃতি = ঈগল বা চোখ?

একটু খেয়াল করুন:

*Wall clockএর অনেক ডিজাইন চোখের মতো

*Sandclock দেখতে অনেকটা DNAএর মতো

*অনেক স্মার্টঘড়িতে অও সিস্টেম ইনবিল্ট থাকে যেমন Fitbit, Apple Watch

ঘড়ি আসলে একটা watcher, একটি ‘observer’। এটা শুধু সময় বলে না, তোমার আচরণ রেকর্ডও করে। “ঘড়ি = প্রথম বুদ্ধিমান নিয়ন্ত্রক” ঘড়ি দিয়ে AI শুরু হয়নি বরং ঘড়ি AIএর আদিম রূপ। একটি কৃত্রিমভাবে তৈরি সময়ের ধারণা, যা তোমার আচরণ, চেতনা, এবং পবিত্রতা পর্যন্ত প্রভাবিত করে সেটা তো অও

ইসলামে সময়: এক পবিত্র চক্র

ইসলামী দৃষ্টিকোণে সময় এক চক্রবৃদ্ধি পুনরাবৃত্তিমূলক, রহমতপূর্ণ, এবং পরকালমুখী। সালাতের সময় যেমন চক্রাকারে আসে, রোজা যেমন সূর্যোদয় থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত চলে, হজ্ব যেমন নির্দিষ্ট দিনে নির্দিষ্ট স্থানে। সময় এখানে দাস নয়, বরং এক পবিত্র আমানত। আলহাদীস কুদসীতে আল্লাহ বলেন: ‘আদদাহর (সময়) আমি নিজেই।’ অর্থাৎ সময়কে ‘মাপা’ নয় বুঝা উচিত, অনুভব করা উচিত।

আধুনিকতা: সময় কেড়ে নেয়া এক মালিকানা

কিন্তু আধুনিক সময়ের ঘড়ি’ বলছে:

. সময় মানে টাকা। ২. সময় মানে প্রতিযোগিতা। ৩. সময় মানে কর্মদাসত্ব। ৪. সময় মানে স্ক্রিন, ডেডলাইন, অ্যালার্ম।

আমাদের সকাল আজ আর ফজরের আলো নয় বরং এক যান্ত্রিক বীপে শুরু হয়। রাত আর চাঁদের আলোয় ঘুম আসে না বরং ফোনের স্ক্রিনে ডুবে যায়। এটাই সময়ের দাসত্ব।

আধুনিক মানুষকে ঘড়ি বলছে: . উঠো সকাল সাতটায়, . দৌড়াও কর্মক্ষেত্রে, . খাও, ঘুমাও, আবারো দৌড়াও।

তার পেছনে লেগে থাকে এক যান্ত্রিক হিসাবরক্ষণ ‘আপনি কতটা উৎপাদনশীল? কত ঘণ্টা ব্যয় করেছেন?’ এভাবে প্রতিদিন মানুষ ধীরে ধীরে সময়ের দাসে পরিণত হয়। সে আর আল্লাহর সময়ের গুণাবলি অনুভব করে না সে আর রাতের আকাশ দেখে না, সে আর ভোরের আলোতে আল্লাহর রহমত খোঁজে না।

কীভাবে মুক্তি?

ঘড়িকে ফেলে দেওয়া নয় বরং ঘড়ির মালিকানা ফেরত নেওয়া। সময়কে ফের আত্মিক করা। সালাতে, প্রকৃতিতে, নিঃশব্দ ধ্যানে। ঘড়ির কাঁটায় নয় হৃদয়ের তালে বাঁচা শেখা। আজকের আধুনিক মানুষ, যাকে তার সময়ের মালিক মনে হয়, আসলে সে এক ঘড়ির দাস। আর যতদিন না সে এই ঘড়িমূর্তি ভাঙে, ততদিন সে প্রকৃত সময় অর্থাৎ আল্লাহর সময় খুঁজে পাবে না। আমাদের ঘড়ি আছে, কিন্তু সময় নেই। আমরা দৌড়াচ্ছি, কিন্তু কোথায় যাচ্ছি জানি না। আমরা ঘড়িকে ঈশ্বর বানিয়ে ফেলেছি, অথচ ভুলে গেছি আসল সময়ের মালিক আল্লাহ। তাই আজকের দিনে সবচেয়ে বিপ্লবী সিদ্ধান্ত হতে পারে: আল্লাহর সময়চক্রে ফিরিয়ে আনা নিজের জীবন।

লেখক: প্রাবন্ধিক, কলামিস্ট

পূর্ববর্তী নিবন্ধকিশোর গ্যাং ও সামাজিক অস্থিরতা প্রসঙ্গে
পরবর্তী নিবন্ধইতিহাসের নৈর্ব্যক্তিক গতি প্রবাহ ও কর্তৃত্ববাদী শাসন