আদিমতম পেশা পতিতাবৃত্তি সমাজবাস্তবতারই অংশ

রোকসানা বন্যা | শনিবার , ১৮ জানুয়ারি, ২০২৫ at ৫:৫৬ পূর্বাহ্ণ

পতিতাবৃত্তিই বিশ্বের প্রাচীনতম পেশা যেটি এখনো টিকে আছে সমাজে। অর্থের বিনিময়ে যৌন কাজে লিপ্ত হওয়াকেই পতিতাবৃত্তি বলা হয়ে থাকে। এ পেশাকে বেশ্যাবৃত্তিও বলে অনেকে। অধুনা এদের যৌনকর্মী বলা হয়ে থাকে ।

পতিতাবৃত্তির বিভিন্ন রূপ রয়েছে এবং এর বৈধতাও আছে বিশ্বের প্রায় সবদেশে। সারা বিশ্বে প্রায় ৪২ মিলিয়ন পতিতা রয়েছে। বিশ্বে পতিতাবৃত্তির জন্য অধিকতর সুবিধাজনক অঞ্চল হচ্ছে পর্যটন নগরীগুলো। বিশ্বে এই বৃত্তির বাজার ১০০ বিলিয়ন ডলারেরও বেশি।

পতিতাবৃত্তি আইনের অবস্থান বিশ্বজুড়ে বিভিন্নভাবে পরিবর্তিত হয়, বিভিন্ন মতামতে প্রতিফলিত হয়। কিছু মতে পতিতাবৃত্তি এক ধরনের শোষণ বা নারীর ও শিশুদের প্রতি সহিংসতা । যা মানব পাচারের জন্য পরোক্ষভাবে সাহায্য করে। পতিতাবৃত্তির কিছু সমালোচক হলেন “নর্ডিক মডেলের” সমর্থক, যেখানে যৌন বিক্রি আইনত অপরাধ নয়, কিন্তু যৌন ক্রয় অবৈধ। এই পদ্ধতিটি কানাডা, আইসল্যান্ড, আয়ারল্যান্ড, উত্তরআয়ারল্যান্ড, নরওয়ে, ফ্রান্স এবং সুইডেন গ্রহণ করেছে। অন্যরা যৌনকর্মকে বৈধ পেশা হিসেবে দেখেন, যার মাধ্যমে কোনও ব্যক্তি অর্থের বিনিময়ে যৌন ক্রিয়াকলাপ বা বিনিময় করে। অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল পতিতাবৃত্তি থেকে দণ্ড অপসারণের আহ্বান জানিয়ে আসছে।

জাতিসংঘের একটি সমীক্ষায় বলা হয় সারা বিশ্বে ৪,৫ থেকে ৭,৫ বিলিয়ন ইউরো পতিতাবৃত্তির মাধ্যমে এই ব্যবসায় জড়িত ব্যক্তিরা আয় করে থাকে যা কালোবাজার এবং মাদকদ্রব্য ব্যবসার লভ্যাংশের চেয়ে বেশী। সারাবিশ্বে এক শ্রেণির সংঘবদ্ধ অপরাধীচক্রের মাধ্যমে নারীদের পণ্য বানিয়ে কোটি কোটি টাকা মুনাফা লুটছে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে বলপূর্বক যৌনদাসী বানিয়ে পতিতাবৃত্তিতে বাধ্য করা হচ্ছে ।

প্রতি বছর সারাবিশ্বে ৪০ লক্ষ নারী যৌনপণ্য হিসেবে বিক্রি হয়ে পতিতা বৃত্তিতে লিপ্ত হয়। জাতিসংঘ থেকে ১২৭টি দেশে অনুসন্ধান চালিয়ে তথ্যটির সত্যতা প্রমাণিত হয়েছে।

আফ্রিকার দেশ নাইজেরিয়াকে পতিতা পাচাররের ট্রানজিট দেশ হিসেবে সনাক্ত করা হয়েছে।

আইনি দিক থেকে জবরদস্তিমূলক কাজ বাংলাদেশে নিষিদ্ধ। বাংলাদেশের সংবিধানের ৩৪ অনুচ্ছেদে জবরদস্তিমূলক শ্রম আদায়কে নিষিদ্ধ করা হয়েছে। তবে এশিয়াটিক সোসাইটি কর্তৃক প্রকাশিত বাংলা একাডেমির বাংলাপিডিয়ার মধ্যে পরিষ্কার উল্লেখ রয়েছে রাষ্ট্র পতিতাদের কর্ম নিয়ন্ত্রণের জন্য তাদের নাম নিবন্ধন করবে এবং তাদের সুনির্দিষ্ট এলাকায় বসবাসে সীমাবদ্ধ রাখবে।

আমাদের দেশেও অনেকে স্বেচ্ছায় বা অনিচ্ছায় এই কাজ করে থাকেন। যারা এই পেশায় আসেন তাদের মধ্যে বেশিরভাগ অপারগ হয়ে এই পেশাকে বেছে নিয়েছেন।

একটি সত্য ঘটনা তুলে ধরি এবার। সুমিতা একজন খ্রিষ্টান নারী। স্কুলে পড়াকালে মুসলিম এক ছেলের সাথে প্রেম হয়। এসএসসি পরীক্ষার শেষের দিনে সেই ছেলের সঙ্গে পালিয়ে বিয়ে করে। বিয়ের কয়েকমাস যেতেই তার বর তাকে বন্ধুদের সাথে মেলামেশার জন্য চাপ দিতে থাকে। মারধরও করে। এক পর্যায়ে মেয়েটি রাজি হয়েও যায়। বছর ঘুরতে মেয়েটি অন্তঃসত্ত্বা হয়ে পড়ে। তারপরও অত্যাচারের মাত্রা আরো বাড়তে থাকে। একদিন ঘর ছেড়ে সে পালিয়ে মায়ের কাছে আসে। পরিবার তাকে ‘চেনে না’ বলে বের করে দেয়। রাস্তায় পড়ে থাকে মেয়েটি। এক ভদ্রমহিলা আশ্রয় দেয়। বাচ্চা জন্মানোর পর সেই মহিলাও একই কাজে বাধ্য করে। এভাবে সুমিতা শুধু হাত বদলই হতে থাকে। অনন্যোপায় হয়ে একটা সময়ে সে নিজেই পতিতাবৃত্তিকে বেছে নেয়। এমন বহু ঘটনা আছে পতিতালয়ে মেয়েদের জীবনে।

অন্যদিকে কেউ ইউনিভার্সিটিতে পড়ছেন। পরিবারে সচ্ছলতা নেই। নিজের খরচ মেটাবার জন্য, ভালোভাবে থাকার জন্য স্বেচ্ছায় এই পথে যায়। সমাজে অনেকেই পরিবারের অগোচরে এই কাজ করে থাকেন। এটাকে পেশা হিসাবে নিয়েছেন তারাও। তাই সুন্দর, স্বাভাবিক জীবন থেকে ছিটকে পড়ে নাম লেখান পতিতাদের তালিকায়। কখনো কখনো রাস্তায়, রেললাইনের পাশে কখনো সমাজের বিভিন্ন স্তরের মানুষের বাসায় কিংবা হোটেলে রাতযাপন করতে হয় নতুন নতুন খদ্দেরের সঙ্গে। আর এর সঙ্গে যুক্ত থাকে কিছু দালালচক্র। পতিতাদের জীবন বৃত্তান্ত নিয়ে এমন অনেক গল্প আছে।

বাংলাদেশে টানবাজারনিমতলী যৌনপল্লি উচ্ছেদের প্রতিবাদে হাইকোর্ট বিভাগে একটি রিট পিটিশন দাখিল হয়েছিল। এ পিটিশনের রায়ে বলা হয়, ‘নারী যৌনকর্মী অনূর্ধ্ব ১৮ বছরের হলে এবং যৌন ব্যবসাই তার একমাত্র আয়ের উৎস হিসেবে প্রমাণ করতে পারলে তিনি বৈধভাবে এ ব্যবসায় অংশগ্রহণ করতে পারবেন।’ কিন্তু আমাদের আইন ও সংবিধান যৌনকর্ম বিষয়ে পরস্পরবিরোধী অবস্থানে। হাইকোর্টের রায় অনুযায়ী, বাংলাদেশে যৌনকর্ম বৈধ। কিন্তু সংবিধানের ১৮() অনুচ্ছেদে বলা হচ্ছে, ‘রাষ্ট্র জুয়া এবং যৌন ব্যবসার বিরুদ্ধে কার্যকরী সুরক্ষা প্রদান করিবে।’ আইন প্রয়োগকারী সংস্থা এ সুযোগটি ব্যবহার করেই যুগ যুগ ধরে যৌনপল্লি উচ্ছেদ, নানাভাবে যৌনকর্মীদের নির্যাতন ও হয়রানি করে আসছে। অথচ এদের পুনর্বাসন করার কোনো উদ্যোগ নেয়নি রাষ্ট্র।

প্রাকৃতিকভাবে মানুষের যে কয়েকটি প্রয়োজন তা হলোক্ষুধা, ঘুম, লোভ, জৈবিক তাড়না ইত্যাদি । তারমধ্যে সবচেয়ে জোরালো হচ্ছে ক্ষুধা ও জৈবিক তাড়না । জৈবিক তাড়নার শক্তি আবার প্রচণ্ড। বিভিন্ন পরিবেশে তা বাড়ে বা কমে। স্বাভাবিকভাবে সমাজ স্বীকৃত পথে যখন মানুষ যৌনক্ষুধা নিবারণ করতে পারে না, তখনই সে অবৈধ পথে তা মেটাবার চেষ্টা করে প্রখ্যাত সাহিত্যিক ড. আবুল আহসান চৌধুরী কর্তৃক রচিত ‘অবিদ্যার অন্তঃপুরে, নিষিদ্ধ পল্লির অন্তরঙ্গ কথকতা’ প্রকাশিত বইটিতে তিনি লিখেছেন ‘বেশ্যাবাজি ছিল বাবু সমাজের সাধারণ ঘটনা। নারী আন্দোলনের ভারত পথিক রাজা রামমোহন রায়ের রক্ষিতা ছিল। এমনকি ওই রক্ষিতার গর্ভে তার একটি পুত্রও জন্মেছিল। জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুর পতিতা সুকুমারী দত্তের প্রেমে মজেছিলেন। সাহিত্যিক মীর মোশাররফ হোসেন নিয়মিত বেশ্যা পাড়ায় যেতেন তা তিনি নিজেই তার ডাইরিতে লিখে গেছেন। মরমি কবি হাসন রাজা, কথাশিল্পী শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় নিয়মিত পতিতালয়ে যেতেন।

রোমান ইতিহাস মতে, পৃথিবীতে প্রথম বেশ্যাবৃত্তি পেশার মতো লাইসেন্স বা নিবন্ধন দেওয়া ও কর ধার্য করা হয় রোমান আমলেই। সপ্তম শতকের রাজা হর্ষবর্ধনের সভাকবি ছিলেন বানভট্ট। বানভট্ট তার ‘কাদম্বরী’ গ্রন্থে লিখেছেন, সেকালে বেশ্যারাই দেশের রাজাকে স্নান করাতো। এমনকি রাজার পরনের সব পোশাক বেশ্যারাই পরিয়ে দিত।

প্রবীর কুমার চট্টোপাধ্যায় রচিত ‘কালিকা পুরোনোক্ত দুর্গাপূজা পদ্ধতি’ বইয়ের ৭২, ৮৬, ১০৮, ১২৭ পৃষ্ঠায় প্রকাশিত, হিন্দুরা মনে করে, বেশ্যারা এ সমাজকে নির্মল রাখে। আর সেই কারণেই দুর্গাপূজার সময় বেশ্যার দরজার মাটি অপরিহার্য। দুর্গাপূজার সময় দশ ধরনের মাটি প্রয়োজন হয়। তারমধ্যে বেশ্যার দরজার মাটি অপরিহার্য।

পতিতাবৃত্তির অপর নামসমূহ গণিকাবৃত্তি, যৌনবৃত্তি, বেশ্যাবৃত্তি। ইতিহাসের আদিকাল থেকে এদের বিভিন্ন নামেও ডাকা হয়। যেমনদেহপসারিণী, বেশ্যা, রক্ষিতা, খানকি, উপপত্নী, জারিণী, পুংশ্চলী, অতীত্বরী, বিজজব্রা, অসোগু, গণিকা, কুলটা, বারণবণিতা, কুম্ভদাসী, নটি, রূপজীবা ইত্যাদি। জর্জ স্কট তার ‘পতিতা বৃত্তির ইতিহাস’ নামক বইয়ে পতিতাবৃত্তির সংজ্ঞা দিতে গিয়ে বলেছেন– ‘পতিতারা হলো সেই সমপ্রদায়ভুক্ত নারী যারা পুরুষকে যৌন সুখ ভোগ করাতে নিজেদের দেহ দিয়ে জীবিকা অর্জন করে।’

সভ্যতার শুরু থেকে মানুষ খাদ্য, বস্ত্র ও বাসস্থানের জন্য কাজ করে আসছে। কারণ জীবন ধারণের জন্য এই তিনটি উপাদান অপরিহার্য। সমাজ বিবর্তনের বিভিন্ন পর্যায়ে কখনো পুরুষ, কখনো নারীসংসার নির্বাহের দায়িত্ব নিয়েছে।

এভাবে যুগের পর যুগ, শতাব্দির পর শতাব্দি, ধরে চলে আসছে পতিতাবৃত্তি । এক কথায় বলা যেতে পারে অর্থনৈতিক এবং সামাজিক দিক দিয়ে নারী ও পুরুষের মাঝে বিরাজমান চরম শোচনীয় পরিণতির নাম হচ্ছে পতিতাবৃত্তি। বাংলাদেশেও সেই ধারাবাহিকতা যথারীতি চলে আসছে বহুবছর ধরে । এদেশে বহু পতিতালয় ছিল । পতিতালয়ের সংখ্যা দিন দিন কমলেও পতিতার সংখ্যা কিন্তু বেড়েই চলছে।

এই কাজে নারীকে হেয়ভাবে না দেখে সমাজে স্বীকৃতি দিতে পারে। এটাও অন্য ব্যবসার মতোই ব্যবসা। অথচ এইকাজে নারীর চেয়েও দায়ী পুরুষ। যৌনক্ষুধা নিবারনের জন্য পুরুষ টাকার বিনিময়ে নারীর শরীর কিনে নেয়। আর নারী পেটের ক্ষুধা নিবারণের জন্য এই কাজ করে।

অথচ নারীকেই শুধু ভর্ৎসনা শুনতে হয় ‘বেইশ্যা’ বলে।

এই সমাজে যদি তাদের প্রয়োজন নাই থাকত তাহলে তারা অনেক আগেই হারিয়ে যেত।

জাতীয় কবি নজরুল ইসলামের বিখ্যাত ‘বারাঙ্গনা’ করিতার উদ্ধৃতি দিয়ে লেখাটি শেষ করব।

‘কে তোমায় বলে বারাঙ্গনা মা, কে দেয় থুতু ওগায়ে?

হয়ত তোমায় স্তন্য দিয়াছে সীতাসম সতী মায়ে।

নাই হ’লে সতী, তবু তো তোমরা মাতাভগিনীরই জাতি;

তোমাদের ছেলে আমাদেরই মতো, তারা আমাদের জ্ঞাতি;….

স্রেফ পশুর ক্ষুধা নিয়ে হেথা মিলে নরনারী যত,

সেই কামনার সন্তান মোরা! তবুও গর্ব কত!

শোন ধর্মের চাঁই

জারজ কামজ সন্তানে দেখি কোনো সে প্রভেদ নাই!

অসতী মাতার পুত্র সে যদি জারজপুত্র হয়,

অসৎ পিতার সন্তানও তবে জারজ সুনিশ্চয়!’

পূর্ববর্তী নিবন্ধদৃঢ়তার জয় গান: বিবিসি হানড্রেড উইম্যান ২০২৪
পরবর্তী নিবন্ধচট্টগ্রামে চুরি হওয়া স্বর্ণালংকারসহ গৃহকর্মী গ্রেপ্তার