চট্টগ্রাম আদালতপাড়ায় এক বছরে নারীসহ দুই ডজনের অধিক প্রতারক ধরা পড়েছে। আদালতপাড়ায় এরা ‘টাউট’ হিসাবে পরিচিত। এদের কেউ কেউ কারাগারে, আবার কেউ জামিনে বেরিয়েছে। আবার কেউ মুচলেকা ও জরিমানায় ছাড়া পেয়ে নিষ্ক্রিয় থাকলেও নতুন অনেকে আবার এসে যুক্ত হয় এ পথে। ফলে আদালতপাড়ায় টাউটদের উৎপাত রয়ে যায়। গত ২৯ নভেম্বর মেকাইল হোসেন প্রকাশ সবুজ (৪২) নামে আরো এক টাউটকে ধরে কোতোয়ালী থানা পুলিশের হাতে তুলে দেয়া হয়েছে। ওই ঘটনায় তার বিরুদ্ধে একটি মামলা দায়ের করা হয়। চট্টগ্রাম আদালতসহ দেশের বিভিন্ন আদালতে টাউটদের উৎপাতে অতিষ্ঠ হয়ে হাই কোর্ট সম্প্রতি বার কাউন্সিলকে চিঠি দিয়ে টাউট উচ্ছেদের বিষয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়ার নির্দেশ দিয়েছেন। টাউটদের উচ্ছেদের ব্যাপারে হাই কোর্টের এমন নির্দেশনা পেয়ে আরও নড়েচড়ে বসে চট্টগ্রাম জেলা আইনজীবী সমিতি। চলতি বছর শুরু থেকে এ পর্যন্ত ২৫ জনকে আটক করেছে সমিতির দুর্নীতি দমন ও টাউট উচ্ছেদ কমিটির লোকজন। এর আগে গত বছর ২৩ জন ও ২০১৮ সালে ১০ জন টাউট আদালতপাড়া থেকে আটক হয়েছিল। চট্টগ্রাম জেলা আইনজীবী সমিতির দুর্নীতি দমন ও টাউট উচ্ছেদ কমিটির তথ্যমতে, মামলায় জামিন বা খালাস করিয়ে দেয়ার কথা বলে আসামির স্বজনদের কাছ থেকে টাকা হাতিয়ে নেয়াই হচ্ছে টাউটদের মূল কাজ।
সাধারণ মানুষের পাশাপাশি শিক্ষানবিশ আইনজীবী, পেশকার, ক্লার্ক, উম্মেদার, মানবাধিকার কর্মী, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরাও এ ধরণের কর্মকাণ্ডের অভিযোগে ইতোপূর্বে আটক হয়েছেন। আবার আইনের ডিগ্রি না নিয়ে নিজেকে আইনজীবী পরিচয়ে বছরের পর বছর প্রতারণা করে আসছেন এমন নারীসহ অনেকেই আটক হয়েছেন।
এলএলবি পাস না করেও আইনজীবী পরিচয়ে বছরের পর বছর ধরে বিভিন্ন মামলায় সুপারিশ, অন্য আইনজীবীর লিন নম্বর ব্যবহার করা, পুলিশের চাকরি থেকে অবসরে যাওয়ার পর কখনও ব্যারিস্টার, কখনও পুলিশ, কখনোবা আইনজীবী পরিচয়ে আদালতপাড়ায় কোমরে পিস্তল ও হাতে ওয়াকিটকি নিয়ে ঘুরে বেড়ানোর পাশাপাশি বিভিন্ন মামলা পরিচালনায় যুক্ত থাকছে এসব প্রতারকেরা।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, বিভিন্ন সময় ধৃতদের মধ্যে বর্তমানে তিনজন কারাগারে রয়েছে। বাকীরা জামিনে বেরিয়ে গেছে।
জানতে চাইলে চট্টগ্রাম জেলা আইনজীবী সমিতির দুর্নীতি দমন ও টাউট উচ্ছেদ কমিটির আহ্বায়ক অ্যাডভোকেট মুহাম্মদ কবির হোসাইন আজাদীকে বলেন, আদালতপাড়ায় টাউট নির্মূল কার্যক্রম শুরুর পর থেকে ইতোমধ্যে অনেকেই গা ঢাকা দিয়েছে। এদেরকে এখন তেমনটা দেখা যায় না।
পূর্বের তুলনায় চট্টগ্রাম আদালতে টাউটদের উৎপাত অনেক কমে এসেছে বলে জানান তিনি।
কমিটির আহ্বায়ক বলেছেন, যারা আমাদের হাতে ধরা পড়েছিল তাদেরকে পরবর্তীতে এ কাজের সাথে জড়িত থাকতে দেখা যাচ্ছে না। আমাদের তালিকায় এখনো অনেকেই আছে যাদেরকে আমরা খোঁজ করছি। কিন্তু তাদের পাওয়া যাচ্ছে না।
জানা গেছে, চট্টগ্রাম আদালতে এ টাউটদের উৎপাত ও তৎপরতার পেছনে অন্যতম কারণ হিসেবে মূলত আইনজীবীদের প্রশ্রয় প্রদানের বিষয়টি বিভিন্ন সময় ওঠে আসছে।
অ্যাডভোকেট মুহাম্মদ কবির হোসাইন বলেন, এটা অত্যন্ত দুঃখজনক যে আমাদের আইনজীবীদের অনেকেই টাউটদের প্রশ্রয় দেন। মূলত টাউটদের মাধ্যমে মামলা নিয়ে পরবর্তীতে সে মামলা ঠিকভাবে পরিচালনা করা হচ্ছে না। এতে বিচারপ্রার্থীরা ক্ষতির শিকার হচ্ছেন। আমরা সংশ্লিষ্ট আইনজীবীদের এ বিষয়ে সতর্ক করে দেয়ার পাশাপাশি এসব কার্যক্রমের ওপর নজরদারি রাখছি বলে জানান তিনি।
আইনজীবীরা জানান, আদালত অঙ্গনে নিত্যনতুন চরিত্রের টাউট ধরা হচ্ছে। এখনও অনেকেই রয়েছে যারা শনাক্ত হননি এবং যারা আইনের ডিগ্রি না থাকলেও আদালতপাড়ায় কখনও আইনজীবী, কখনও ক্লার্ক, কখনও সাংবাদিক বা মানবাধিকার কর্মী পরিচয়ে চলাফেরা করছে। কখনো প্রকাশ্যে কখনো গোপনে তারা টাউট কাজের সাথে জড়িত থাকছে।
চট্টগ্রাম জেলা আইনজীবী সমিতির নির্দেশনাগুলোর মধ্যে অন্যতম একটি হচ্ছে, আইনজীবী ব্যতিত কেউ কোনো বিচারপ্রার্থী জনগণের কাছ থেকে মামলা-মোকাদ্দমা গ্রহণ, পরামর্শ প্রদান ও আর্থিক লেনদেন করলে তিনি টাউট হিসেবে গণ্য হবেন। তার বিরুদ্ধে সমিতি আইনগত ব্যবস্থা নেবেন।