‘আদর্শ জীবন হচ্ছে ভালো বন্ধু, ভালো বই আর ঘুমন্ত বিবেক’

রাশেদ রউফ | মঙ্গলবার , ৭ জানুয়ারি, ২০২৫ at ৮:৩০ পূর্বাহ্ণ

চোখের সৌন্দর্য আলাদা। কবি কবিতা লিখেছেন : ‘যে তুমি কথা বলো চোখের ভাষায়’। জনপ্রিয় একটা গানের কলি এরকম : ‘চোখ যে মনের কথা বলে’। সাহিত্যে, সংগীতে চোখ নিয়ে অসংখ্য লেখা আমরা পাই। সাহিত্যিক সৈয়দ মুজতবা আলী ভ্রমণকাহিনি ও রম্যরচনার জন্য সকলের কাছে জনপ্রিয় ও পরিচিত। তিনি তাঁর এক লেখায় চোখ নিয়ে বলতে গিয়ে লিখেছেন, ‘মাছিকে যেদিক দিয়েই ধরতে যান না কেন, সে ঠিক সময় উড়ে যাবেই। কারণ অনুসন্ধান করে দেখা গিয়েছে, দুটো চোখ নিয়েই মাছির কারবার নয়, তার সমস্ত মাথা জুড়ে নাকি গাদা গাদা চোখ বসানো আছে। আমরা দেখতে পাই শুধু সামনের দিক, কিন্তু মাছির মাথার চতুর্দিকে চক্রাকারে চোখ বসানো আছে বলে সে একই সময়ে সমস্ত পৃথিবীটা দেখতে পায়। তাই নিয়ে গুণী ও জ্ঞানী আনাতোল ফ্রাঁস দুঃখ করে বলেছেন, ‘হায়, আমার মাথার চতুর্দিকে যদি চোখ বসানো থাকতো, তাহলে আচক্রবালবিস্তৃত এই সুন্দরী ধরণীর সম্পূর্ণ সৌন্দর্য একসঙ্গেই দেখতে পেতুম।’

কথাটা যে খাঁটি, সেকথা চোখ বন্ধ করে একটুখানি ভেবে নিলেই বোঝা যায়। এবং বুঝে নিয়ে তখন এক আপশোস ছাড়া অন্য কিছু করবার থাকে না। কিন্তু এইখানেই ফ্রাঁসের সঙ্গে সাধারণ লোকের তফাৎ। ফ্রাঁস সান্ত্বনা দিয়ে বলেছেন, ‘কিন্তু আমার মনের চোখ তো মাত্র একটি কিংবা দুটি নয়। মনের চোখ বাড়ানোকমানো তো সম্পূর্ণ আমার হাতে। নানা জ্ঞানবিজ্ঞান যতই আমি আয়ত্ত করতে থাকি, ততই একএকটা করে আমার মনের চোখ ফুটতে থাকে।’ মূল কথা হলো সৈয়দ মুজতবা আলী মনের চোখ বাড়ানোর দিকে গুরুত্ব দিয়েছেন। মনের ভিতর আপন ভুবন সৃষ্টি করার ওপর জোর দিয়েছেন। বার্ট্রান্ড রাসেলও বলেছেন, ‘সংসারে জ্বালাযন্ত্রণা এড়াবার প্রধান উপায় হচ্ছে, মনের ভিতর আপন ভুবন সৃষ্টি করে নেওয়া এবং বিপদকালে তার ভিতর ডুব দেওয়া। যে যত বেশি ভুবন সৃষ্টি করতে পারে, যন্ত্রণা এড়াবার ক্ষমতা তার ততই বেশি হয়।’

আমরা যখন লেখালেখি শুরু করি, তখন আমাদের ভিতর এই ভুবন তৈরি করার জন্য অনেক অগ্রজ লেখক উদ্বুদ্ধ করেছেন। এই জীবনে ছোটো বড় অনেকের কাছে আমি ঋণী। তাদের কাছে আমার কৃতজ্ঞতার শেষ নেই। তাদের একজন অজয় দাশগুপ্ত। ১৯৮৫ সাল থেকে এ পর্যন্ত ৪০ বছর ধরে আমি আছি তাঁর সঙ্গে যুক্ত। তিনি আমার অন্যতম প্রিয় ছড়াসাহিত্যিক। আমি সমআদনা করেছি অসংখ্য সংকলন। সব ক’টি সংকলন সম্পাদনার সময় আমি পেয়েছি তাঁর আনুকূল্য। ১৯৮৯ সালে প্রথম জাতীয় ছড়া উৎসবের যখন উদ্যোগ গ্রহণ করি, তখন অন্যদের চেয়ে তিনিই আমাকে বেশি উৎসাহিত করেন। তিনি অনেক দিন ধরে অস্ট্রেলিয়ায় প্রবাস জীবন যাপন করছেন। দেশের বাইরে অবস্থান করেও এখনো আমাদের মধ্যে সেই সম্পর্ক বিদ্যমান, চুল পরিমাণ এদিক সেদিক হয়নি। এইতো সেদিন তিনি লিখলেন, ‘সিডনিতে এখন রাত বারোটা বেজে গেছে। ক্যালেন্ডার অনুযায়ী ওর জন্মদিন ১ জানুয়ারি। আমি যার কথা বলছি তাকে নতুন করে পরিচয় করানোর কিছু নাই। বাংলাদেশ, পশ্চিমবঙ্গ পেরিয়ে সে এখন আন্তর্জাতিক বলয়ে বাঙালির অহংকার। আমাদের স্বার্থপর, ক্ষুদ্রতার সমাজে এক বিরল উদাহরণও। লেখক তৈরি করা থেকে সংগঠন তৈরী সবকিছুতে একক ও অনন্য। চট্টগ্রামে জন্মেছি। চট্টগ্রামের ছড়া কবিতা সাহিত্য সংস্কৃতির আন্দোলনের নাড়ি নক্ষত্র জানি। ওর মতো এমন পরিশ্রমী সার্থক মানুষ হাতে গোণা। মাঝে মাঝে মনে হয় কুরুক্ষেত্রের একাকী অর্জুন। আমি যতবার চট্টগ্রাম যাই বা যাবো ওর ভরসায় থাকি, থাকবো। ওর যারা প্রতিপক্ষ তাদের একমাত্র অস্ত্র ইর্ষা। সে কারণেই ও অপ্রতিদ্বন্দ্বী। শুভ জন্মদিন রাশেদ রউফ প্রিয় অনুজ।’ লেখাটা উদ্ধৃত করেছি কেবল তাঁর উদারতার পরিচয় তুলে ধরার জন্য। তিনি এমন, যখন বলেন, তখন কেউ আর কথা বলতে পারেন না। সবাই তাঁর মুগ্ধ শ্রোতা হয়ে যান। সাহিত্যের নানা শাখায় বিচরণ সত্ত্বেও অজয় দাশগুপ্ত বাংলাদেশের ছড়াসাহিত্যে অনন্য একটি নাম। গত শতকের সত্তর দশকের অকুণ্ঠ মেধার অধিকারী ছড়াসাহিত্যিকদের অন্যতম তিনি। তাঁর ছড়ায় স্বপ্নের কথা আছে, আছে স্বপ্নভঙ্গের হাহাকারও। ছড়ার শৈল্পিক উৎকর্ষ ও বক্তব্যের স্পষ্টতার জন্য তিনি পাঠকের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে সক্ষম হয়েছেন। শব্দের বিন্যস্ততায়, জীবনবোধের গভীরতায়, ছন্দ ও বক্তব্যের শৈল্পিক নিপুণতায় উদ্ভাসিত হয়ে ওঠে তাঁর ছড়া। ছোটো বড়ো সকলের জন্য নানামুখী ছড়া লিখে তিনি পাঠক সমাজে খ্যাতি লাভ করেছেন। বলা যেতে পারে অজয় দাশগুপ্ত দেশের পাঠকপ্রিয় এক দক্ষ ছড়াশিল্পী।

স্বাধীনতা পতাকায়, স্বাধীনতা রক্তে

কারা আনে স্বাধীনতা, কারা বসে তখতে!

.

সংস্কৃতি মানে যদি লাকী খান নাচা

দেশ তবে দেশ নয় বানরের খাঁচা!

.

যারা করে চাষ, হৃদয়ের ঘাস

ফোটানো গোলাপ গালিচায়

সে বাগান জুড়ে কোথা থেকে উড়ে

উটকো লোকেরা তালি চায়!

.

ভালোবাসাহীন শহর গাঁয়ে

ভালোবাসা চাওয়া ঘর কা’র?

দাও দাও তাকে ভালোবাসা দাও

ভালোবাসা বড় দরকার।

এরকম অনেক জনপ্রিয় ছড়ার নির্মাতা অজয় দাশগুপ্ত। আমাদের ছড়াঅঙ্গন তোলপাড় করা লেখক তিনি। বর্তমানে প্রিন্ট মিডিয়া ও অনলাইন মিডিয়ায় অত্যন্ত সচল ও সক্রিয় লেখক। সমকালীন বিষয়ে কলাম লিখে তিনি পেয়েছেন ব্যাপক পরিচিতি ও খ্যাতি। দীর্ঘদিন প্রবাস জীবন যাপন করলেও নিরন্তর লেখালেখির জন্য দেশে তাঁর অনুপস্থিতি অনুমান করা যায় না। বাংলাদেশের রাজনৈতিক বাস্তবতা নিয়ে তাঁর মূল্যায়ন মূলধারার পাঠককে মোহিত করে। সমসাময়িক বিষয়ে তাঁর যৌক্তিক ও মননধর্মী বিশ্লেষণের কারণে তিনি সক্ষম হয়েছেন তাঁর নিজস্ব পাঠক ভুবন তৈরি করতে।

অতি সমপ্রতি ঘটে যাওয়া ঘটনার তাৎক্ষণিক শিল্পসম্মত প্রকাশ রীতিমত অভাবনীয় বিষয়। দেশের যে কোন সংকট সমস্যায় তিনি উচ্চকণ্ঠ, অন্যায় অনাচার অনিয়মের বিরুদ্ধে সোচ্চার। প্রায় প্রতিদিনই তিনি লিখেন। প্রতিটি লেখায় ফুটে ওঠে তাঁর সমকালীন ভাবনা। তাঁকে অভিনন্দন ও শ্রদ্ধা জানাই।

.

বলছিলাম নিজের ভিতর আপন ভুবন সৃষ্টি করা নিয়ে। আমরা অনবরত চেষ্টা করছি প্রতিনিয়ত একটা ভুবন তৈরির। গত ৫ জানুয়ারি উদযাপিত হয়েছে ‘জাতীয় ছড়া দিবস’। ছড়াকর্মীরা তাঁদের নিজেদের জন্য একটা দিন বাছাই করে নিয়েছেন, যে দিন ছড়ার দিন। জীবন্ত কিংবদন্তি ছড়াকার সুকুমার বড়ুয়ার জন্মদিনকে বাছাই করা হয়েছে ছড়া দিবস হিসেবে। ছড়া পড়ে, ছড়া লিখে, আলোচনা করে দিনটি কাটানোর প্রচেষ্টা প্রশংসাযোগ্য। এবার বাংলাদেশ শিশুসাহিত্য একাডেমির আয়োজনে চট্টগ্রামে ছড়া দিবসের কর্মসূচি উদ্বোধন করলেন সাহিত্যিক ওমর কায়সার। কর্মসূচির মধ্যে ছিল সেমিনার, ছড়া পাঠ ও আবৃত্তি। চট্টগ্রামে অবস্থানরত ছড়াসাহিত্যিকরা এ আয়োজনে সম্পৃক্ত ছিলেন। এদিন প্রকাশিত হলো ইসমাইল জসীমের সম্পাদনায় ‘কিশোরশৈলী’।

রাজধানী ঢাকায় ‘সাহিত্য সারথি বাংলাদেশ’ তাদের পুরানা পল্টনস্থ কার্যালয়ে আয়োজন করলো বিশেষ অনুষ্ঠান। এতে বক্তারা সুকুমার বড়ুয়ার জন্মদিনকে ‘জাতীয় ছড়া দিবস’ হিসেবে রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতির জন্য সরকারের প্রতি দাবি জানিয়েছেন। তাঁরা বলেন সুকুমার বড়ুয়ার সাহিত্যে বাংলাদেশের মানুষের জীবনচিত্র জীবন সংগ্রাম এবং বাংলাদেশের প্রকৃতি নানা আঙ্গিকে জীবন্ত হয়ে উঠেছে। সভায় সভাপতিত্ব করেন সাহিত্যিক সুজন বড়ুয়া। অতিথি ছিলেন শিশুসাহিত্যিক আহমেদ জসিম, বাংলা একাডেমির পরিচালক ড. তপন বাগচী, শিক্ষাবিদ হরিষদ বালা। শিশুসাহিত্যিক রমজান মাহমুদের উপস্থাপনায় অন্যান্যের মধ্যে আলোচনায় অংশ নেন শিশুসাহিত্যিক হুমায়ুন কবীর ঢালী, মালেক মাহমুদ, বাসুদেব নাথ, রশীদ এনাম, শিবুকান্তি দাশ, মোশতাক রায়হান, মো.মামুন প্রমুখ।

গত ২৭ ডিসেম্বর শিল্পকলা একাডেমির গ্যালারি মিলনায়তনে অনুষ্ঠিত হলো চেরাগ আয়োজিত প্রথম আঞ্চলিক ছড়া সম্মেলন। উদ্বোধন করে শিক্ষাবিদ অধ্যাপক ড. মো: আবুল কাসেম, প্রধান অতিথি ছিলেন শিক্ষাবিদ অধ্যাপক ড. মোহীত উল আলম। প্রবন্ধ পাঠ করেন সাহিত্যিক ওমর কায়সার। বক্তব্য রাখেন সাহিত্যিক বিশ্বজিৎ চৌধুরী, শিক্ষাবিদ প্রফেসর রীতা দত্ত, চেরাগ সম্পাদক উৎপলকান্তি বড়ুয়া, কবি সনজীব বড়ুয়া প্রমুখ। অন্যদিকে ৩১ ডিসেম্বর চট্টগ্রাম একাডেমি মিলনায়তনে অনুষ্ঠিত হলো অনন্য ধারার মিলনমেলা। সপ্তডিঙা আয়োজিত এ অনুষ্ঠানে ছিলেন শিক্ষাবিদ ড. আনোয়ারা আলম, . সেলিনা আখতার, অধ্যাপক এলিজাবেথ আরিফা মুবাশশিরা, . প্রণব কুমার চৌধুরী, বাচিক শিল্পী আয়েশা হক শিমু, প্রকাশক নাফে নজরুল, অনন্যধারা সম্পাদক রুনা তাসমিনা প্রমুখ।

এতো আয়োজন, তার সব কিছুর পেছনে আছে ভুবন তৈরির প্রেক্ষাপট। কিন্তু বড় বড় পণ্ডিতদের ভাষ্য হচ্ছে, ভুবন তৈরির মুখ্য মাধ্যম হলো বই। মার্ক টোয়েনের মতে, ‘আদর্শ জীবন হচ্ছে ভালো বন্ধু, ভালো বই আর ঘুমন্ত বিবেক।’ আমরা তাই ভালো বন্ধুর সঙ্গে থাকতে চাই, চাই ভালো বইয়ের সঙ্গে থাকতে এবং ঘুমন্ত বিবেককে জাগ্রত করতে। সবাইকে নিয়ে সেই আদর্শ জীবনের সন্ধানে আছি।

লেখক : সহযোগী সম্পাদক, দৈনিক আজাদী;

ফেলো (নম্বর ৪২২), বাংলা একাডেমি।

পূর্ববর্তী নিবন্ধসাহিত্য সংস্কৃতি রাজনীতি সংগ্রামে চট্টগ্রাম সবসময় অগ্রগামী
পরবর্তী নিবন্ধখাগড়াছড়িতে সেনাবাহিনীর বিনামূল্যে চিকিৎসা সেবা ও ওষুধ বিতরণ