“আমাদের দেশের কৃষকের জীবনধারণ এবং তারা যে খুব অল্প আহারী, খুব কষ্টের মধ্যে উৎপন্ন করে, এতে কোন সন্দেহ নাই। তাদের বেশি ভালোভাবে থাকার জন্য আকাঙ্ক্ষা নেই।… তারা যেন কোন ব্রতে ব্রতী রয়েছে– শুধু উৎপন্ন করে যাওয়ার জন্য”
গ্রাম বাংলার হাজার বছরের ঐতিহ্য ও কৃষ্টিকে এভাবেই দেখেছেন এস এম সুলতান। লালন করেছেন। এবং ছবি এঁকে তুলে ধরেছেন কৃষকদের। তাঁর ছবিতে পেশীবহুল ও ইস্পাত–দৃঢ়তায় ধান ক্ষেতে ফসল কাটে কৃষকেরা। এই বিষয়ে এস এম সুলতান বলেন: “আমার ছবিতে তাদের বলিষ্ঠ হওয়াটা মনের ব্যাপার।”
এস এম সুলতানকে নিয়ে নির্মত তথ্যচিত্র “আদমসুরত” দেখতে গিয়ে তাঁকে আবার নতুন করে ভাবতে হয়। সেই ১৯৯১ সালে প্রথম দেখেছিলাম। সম্প্রতি মৃন্ময় আর্ট গ্যালারী এবং বিস্তার– এর যৌথ আয়োজনে আবার দেখার সুযোগ হলো “আদমসুরত”।
তারেক মাসুদ দীর্ঘ আট বছর সময় নিয়ে এই তথ্যচিত্র নির্মাণ করেন। এটি তারেক মাসুদের প্রথম নির্মিত তথ্যচিত্র। এস এম সুলতান বাংলাদেশের এমন এক ব্যতিক্রমী চিত্রশিল্পী, যাঁর ছবি আঁকার বিষয় ও পদ্ধতি একেবারেই ভিন্ন। বাংলার ইতিহাস ও ঐতিহ্য, দ্রোহ ও প্রতিবাদ, বিপ্লব সংগ্রাম ইত্যাদি রঙের তুলিতে এঁকেছেন।
একেবারেই সাদাসিধে মানুষ সুলতান। তাঁর সুযোগ ছিল পাশ্চাত্যের কোনো দেশে স্থায়ীভাবে বসবাস করার। তিনি চলে এলেন নড়াইলে, চিত্রা নদীর পারে পুরুলিয়া গ্রামে। যেখানে আধুনিকতার ছোঁয়া নেই। আছে আদিম ও অকৃত্রিম রূপ। যেখানে সুলতান নিজেকে প্রকাশ করার মাধ্যম খুঁজে পেলেন। অথচ তাঁর সমসাময়িক শিল্পীরা শহুরে নাগরিকতায় অর্থেবিত্তে এগিয়ে গিয়েছিলেন অনেক দূর। কিন্তু সুলতান তা একেবারেই গায়ে মাখেননি। মনেও আনেননি। একেবারেই সাদামাটা জীবন কাটিয়েছেন গ্রামের মানুষের মাঝে। “আদমসুরত”–এ দেখলাম, কীভাবে এক বরেণ্য শিল্পী সাধারণ মানুষের সাথে থাকার সহজাত গুণের অধিকারী হলেন। সুলতান হয়ে উঠেছিলেন একেবারেই জাত শিল্পী। নিজস্বতায়, বৈচিত্র্যে এবং স্বকীয়তায়। যেখানে আর কোন চিত্রশিল্পীকে আজ অবধি পাইনি।
সুলতানের ছবি আঁকার দর্শন বলি কিংবা তাঁর দৃষ্টিভঙ্গি বলি তা তাঁর উপরের কথাতেই বলেছেন। জন্ম থেকেই তিনি দেখেছেন জন্মভূমির কৃষক সমাজকে। নদীর পারের মানুষের জীবন–জীবিকা, সংস্কৃতি। তিনি ছবিতে দেখিয়েছেন পৃথিবীতে খাদ্য যোগানকারী কৃষকেরাই মূখ্য ভূমিকা রেখে আসছে। তাঁরাই এই পৃথিবী চালিকা শক্তি। অথচ তাঁদের কথা তেমন কোথাও উল্লেখ করা হয় না। আর এই দর্শন থেকেই সুলতান ছবি এঁকেছেন কৃষক ও কৃষি নিয়ে। সবচেয়ে অবাক ও বিস্ময় লেগেছিল, কৃষক ও কৃষাণীর পেশীবহুল শরীর। এই বিষয়ে ১৯৯১ সালে চট্টগ্রাম চলচ্চিত্র সংসদের একটি কর্মশালায় অতিথি হিসেবে আগত চিত্রনির্মাতা তারেক মাসুদের কাছে সরাসরি জানতে চাইলে তিনি বলেছিলেন: “বাঙালি চিন্তায় ও মননে অসীম শক্তিশালী জাতি। দেখতে রুগ্ন হলেও এস এম সুলতানের কাছে তাঁরা অসীম বলশালী। আর এটাই তিনি তাঁর চলচ্চিত্রে এঁকেছেন।” আমি শিল্পী সুলতানকে সামনাসামনি দেখিনি। তারেক মাসুদের তথ্যচিত্রের মাধ্যমে দেখেছি। যেখানে তিনি মাটি, গাছ–গাছালিতে ঘেরা আদিমতায় ঘেরা এক অন্য জগতের মানুষ। নিজের ধ্যানে ছবি আঁকছেন। বিশাল বিশাল ক্যানভাস তৈরি করছেন। শহরে থেকে নয়। গ্রামেই তৈরি করছেন রঙ। সেই রঙে ছবি আঁকছেন। আর ক্যানভাসের উপরে বসে থাকা তাঁর নিত্যসঙ্গী বিড়ালও এসেছে প্রকৃতির অংশ হয়ে।
শুনেছিলাম, পঞ্চাশের দশকে ফ্রান্সে সালভাদর দালী, পাবলো পিকাসো– এর মতো শিল্পীদের সাথে এস.এম. সুলতানের আঁকা ছবির প্রদর্শনী হয়েছিল। কিন্তু সেই সুলতান চলে এলেন পাশ্চাত্যের আধুনিকতায় মোড়া জগত ছেড়ে পুরুলিয়া গ্রামে। অপার ভালোবাসায় ও শান্তিতে জীবনের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত কাটিয়েছেন। নগর সভ্যতা ও সংস্কৃতি সুলতানের মনে কোন দাগ কাটেনি। তাই শহর–জীবন থেকে দূরেই ছিলেন। কোন প্রদর্শনীতে আসতেন। দিন কয়েক থেকেই আবার ফিরে যেতেন গ্রামে। “আদমসুরত”–এ তাই দেখা গেছে।
তারেক মাসুদ দীর্ঘ সময় নিয়ে এই তথ্যচিত্র নির্মাণ করেছেন নানান সীমাবদ্ধতার মধ্যে। ১৯২৩ সালের ১০ আগস্ট তারিখে তিনি জন্মগ্রহণ করেছিলেন। শিল্পী এস এম সুলতানের জন্ম শতবার্ষিকী এই বছর। ইংল্যান্ডের কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয় যখন তাঁকে “ম্যান অব দি এচিভমেন্ট”
সম্মাননা প্রদান করলো, তখনও তিনি বলেন: “শিল্পের কোন পুরস্কার হয় না। শিল্পের ভার তো প্রকৃতি স্বীয় হাতে প্রদান করে।”
বংশীবাদক হিসেবেও সুলতানকে আমরা দেখেছি। প্রশান্ত মনে বাজাচ্ছেন বাঁশী। বিখ্যাত আলোকচিত্রী নাসির আলী মামুনও তাঁর সান্নিধ্যে এসেছেন। তিনিও এই মহান শিল্পীকে ফ্রেমবন্দী করেছেন। সেখানেও দেখি শিল্পী সুলতানের চোখের অসাধারণ দ্যুতি।
এমন মহান শিল্পী শেষ জীবনে এসে বলে গেলেন: “আমি সুখী। আমার কোনো দুঃখ নেই। সকল দিক দিয়েই আমি প্রশান্তির মধ্যে দিন কাটাই। আমার সব অভাবেরই পরিসমাপ্তি ঘটেছে।” এমন কথা কেবল এস এম সুলতানের পক্ষে বলা সম্ভব। যিনি আজও সেই চিত্রা নদীর পারে পুরুলিয়া গ্রামে শুয়ে আছেন।
জন্ম শত বার্ষিকীতে এই মহান শিল্পীর প্রতি জানাই গভীর শ্রদ্ধা।