খোশ আমদেদ মাহে রমজান। আরবি বর্ষপঞ্জী তথা হিজরি সালের শাবনের সমাপ্তির পরই প্রতিবছর রহমত, মাগফিরাত ও নাজাতের সাওগাত নিয়ে আসে ইবাদতের মাস রমজানুল মোবারক। এ গুরুত্ববহ তাৎপর্যময় মাসের আগমন সারাবিশ্বে মুসলিমদের দীর্ঘ এক মাসের সিয়াম সাধনার জন্যে বিশেষভাবে প্রস্তুত হওয়ার কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। মুসলিমদের জীবনে সারা বছরের মধ্যে রমজান মাসে আল্লাহর অসীম দয়া, ক্ষমা ও পাপ মুক্তির এক সুবর্ণ সুযোগ সৃষ্টি হয় বলেই এ পুণ্যময় মাসের গুরুত্ব ও মর্যাদা এতো বেশি। তাই বলা হয় রমজান মাস হচ্ছে ইবাদত, কোরআন তিলাওয়াত, জিক্র ও আল্লাহ তায়ালার নৈকট্য লাভের এক বিশেষ মৌসুম।
রোজা ফার্সি শব্দ। অর্থ উপবাস। রোজার আরবি শব্দ হচ্ছে ‘সাওম’। আভিধানিক অর্থ বিরত থাকা। শরিয়তের পরিভাষায়– আল্লাহ্ তায়ালার নির্দেশ পালনার্থে সুব্হি সাদিক থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত পানাহার ও স্ত্রী সহবাস থেকে বিরত থাকাই হচ্ছে ‘সাওম’।
এ রমজানে সিয়াম পালনের তাগিদ দিয়ে আল্লাহ্ তায়ালা ইরশাদ করেছেন– ‘রমজান মাস, যাতে কুরআন নাজিল করা হয়েছে মানুষের হিদায়াতের জন্য এবং হিদায়াতের সুসপষ্ট নিদর্শনাবলী ও সত্য–মিথ্যার পার্থক্যকারীরূপে। সুতরাং তোমাদের মধ্যে যে এই মাস পায় সে যেনো রোজা পালন করে। আর যে অসুস্থ হবে অথবা সফরে থাকবে তাহলে অন্যান্য দিনে সংখ্যা পূরণ করে নেবে। আল্লাহ্ তোমাদের জন্য সহজ করতে চান এবং কঠিন করতে চান না। আর যাতে তোমরা সংখ্যা পূরণ করো এবং তিনি তোমাদের যে হিদায়ত দিয়েছেন, তার জন্যে আল্লাহ্র শ্রেষ্ঠত্ব ঘোষণা করো এবং যাতে তোমরা কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করো।’ (সুরা আল–বাকারা, আয়াত– ১৮৫) যে ব্যক্তি রমজান মাসে রোজা পালন করবে, আল্লাহ্ তায়ালা তার অতীতের সমস্ত গুনাহ মাফ করে দেবেন। হাদিসে এসেছে, হজরত আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেছেন– ‘যে ব্যক্তি ঈমানের সাথে সাওয়াবের আশায় রমজানের রোজা রাখবে, তার পূর্ববর্তী গুনাহসমূহ ক্ষমা করে দেওয়া হবে।’-(সহিহ আল–বুখারি, হাদিস নং– ১৯০১)
হাদিসে এসেছে, হজরত আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেছেন– ‘রমজান মাসে আমার উম্মতের জন্য পাঁচটি বস্তু দান করা হয়েছে; যা আগের উম্মতদের দেওয়া হয়নি। ১. রোজাদারের মুখের গন্ধ আল্লাহ্ তায়ালার কাছে মিস্কের সুগন্ধির চেয়েও পছন্দনীয়। ২. ইফতার পর্যন্ত ফেরেশতাগণ তাদের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করেন। ৩. আল্লাহ্ তায়ালা প্রতিদিন জান্নাতকে রোজাদারদের জন্য সজ্জিত করেন এবং বলেন অচিরেই আমার সৎ বান্দাগণ ক্লেশ–যাতনা দূরে নিক্ষেপ করে আমার দিকে ফিরে আসবে। ৪. রমজানে শয়তানকে শৃঙ্খলাবদ্ধ করে রাখা হয়। যাতে তারা এসব পাপ কাজ করাতে না পারে যা অন্য মাসে করানো সম্ভব। ৫. রমজানে রোজাদারকে শেষ রাত্রে মাফ করে দেওয়া হয়।’ -(মুসনাদ আহমাদ ইব্ন হাম্বল, হাদিস নং– ৭৯০৪)
আমরা যে রোজা পালন করছি, আমাদের জন্য কতইনা সৌভাগ্যের। এ রোজা কিয়ামতের দিন আমাদের জন্য সুপারিশ করবে। হাদিসে এসেছে, আবদুল্লাহ ইব্ন আমর (রা.) হতে বর্ণিত। রাসুলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেছেন– ‘রোজা ও কুরআন বান্দার জন্য কিয়ামতের দিন সুপারিশ করবে। রোজা বলবে– হে রব! আমি তাকে পানীয় ও যৌন সম্ভোগ থেকে বিরত রেখেছি। অতএব তার ব্যাপারে আমার সুপারিশ গ্রহণ করুন। আল–কুরআন বলবে– আমি তাকে রাতের ঘুম থেকে বিরত রেখেছি (সে আমাকে তিলাওয়াত করেছে)। অতএব তার ব্যাপারে আমার সুপারিশ গ্রহণ করুন। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, অতঃপর তাদের উভয়ের সুপারিশ গ্রহণ করা হবে।’ -(মুসনাদ আহমাদ, হাদিস নং–৬৬২৬) রোজাদারগণ রোজার কারণে পিপাসার্ত থাকেন। পিপাসার্তগণকে আল্লাহ্ তায়ালা কিয়ামতের দিন পানি পান করাবেন। হাদিসে এসেছে, হজরত আবু মুসা আশআরি (রা.) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, ‘নিশ্চয় বরকতময় মহান আল্লাহ্ নিজের ওপর বিধিবদ্ধ করে দিয়েছেন, যে বান্দা তার জন্য গ্রীষ্মকালে (রোজার কারণে) পিপাসার্ত থেকেছে, তিনি তাকে পিপাসার্তের দিন (কিয়ামতের দিন) পানি পান করাবেন।’ -(মুসনাদ আল–বাজ্জার, হাদিস নং– ৪৯৭৪)
আমাদের কাছে রমজান মাস এসেছে। এ মাসে যদি আমরা আল্লাহ্র কাছে গুনাহ মাফ করাতে না পারি তাহলে আমাদের চেয়ে দুর্ভাগা আর কে হতে পারে? হাদিসের মধ্যে এসেছে, একবার রাসুলুল্লাহ (সা.) সাহাবিগণকে বললেন– ‘তোমরা মিম্বরের কাছে এসো। তখন সাহাবিগণ মিম্বরের কাছে আসলেন। তারপর রাসুলুল্লাহ (সা.) মিম্বরের প্রথম সিঁড়িতে পা রাখলেন। অতঃপর বললেন– আমিন। এরপর দ্বিতীয় সিঁড়িতে পা রাখলেন। তখন বললেন– আমিন। তারপর তৃতীয় সিঁড়িতে পা রাখলেন। তখনও বললেন– আমিন। যখন রাসুলুল্লাহ (সা.) খুতবা ও বয়ান শেষ করে মিম্বর থেকে নামলেন তখন সাহাবিগণ বললেন– হে আল্লাহ্র রাসুল (সা.)! আমরা আপনাকে মিম্বরে ওঠার সময় কিছু বলতে শুনেছি, যা আগে কখনও শুনিনি। উত্তরে রাসুলুল্লাহ (সা.) বললেন, এইমাত্র জিবরাইল (আ.) আমার কাছে এসেছিলেন। আমি যখন প্রথম সিঁড়িতে পা রাখি, তখন তিনি বললেন– ধ্বংস হউক ঐ ব্যক্তি, যে রমজান মাস পেলো; কিন্তু তার গুনাহ মাফ করাতে পারলো না। তখন আমি বললাম– আমিন। যখন দ্বিতীয় সিঁড়িতে পা রাখলাম, তখন জিবরাইল (আ.) বললেন– ধ্বংস হউক ঐ ব্যক্তি, যে ব্যক্তি আপনার নাম উচ্চারণ করে; কিন্তু সে আপনার ওপর দরুদ পাঠ করে না। তখন আমি বললাম– আমিন। যখন তৃতীয় সিঁড়িতে পা রাখলাম, তখন জিবরাইল (আ.) বললেন, ধ্বংস হউক ঐ ব্যক্তি; যে পিতা–মাতা উভয়কে অথবা তাদের কোনো একজনকে বৃদ্ধ অবস্থায় পেলো; কিন্তু তারা তাকে জান্নাতে প্রবেশ করালো না তখন আমি বললাম– আমিন।’ -(সুনান আল–কুবরা, হাদিস নং– ৮৫০৪)
আসুন, মুমিনের জীবনে বছরের মধ্যে রমজান মাসটি এক দুর্লভ সুযোগ এনে দেয়। তাই এই পুণ্যময় পবিত্র রমজান মাসে আমরা নামাজ, রোজা, সেহেরি, ইফতার, কোরআন তিলাওয়াত, তারাবিহ, তাহাজ্জুদ, জিক্র–আজ্কার, ইতিকাফ, তাসবিহ পাঠ, দোয়া–ইস্তিগফার, দান–সাদাকা ইত্যাদি পুণ্যময় কাজ করি। আল্লাহপাক আমাদের তাওফিক দান করুন।
লেখক: কলামিস্ট ও গবেষক; প্রফেসর, আরবি বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।