আত্মহত্যা : ভয়ানক এই প্রবণতাকে প্রতিহত করতে হবে

গোপা রাণী দে | সোমবার , ২১ নভেম্বর, ২০২২ at ১০:০৩ পূর্বাহ্ণ

আত্মহত্যা একটা ব্যাধি। হতাশা থেকে এর উৎপত্তি। মানুষ কতটা অসহায় হলে নিজের মৃত্যুর আয়োজন করে! অপমান-অত্যাচার-পরাজয় এসব যখন একজন মানুষকে গ্রাস করে তখন সে মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলে এবং আত্মাকে বধ করার সিদ্ধান্ত নেয়। কাজী নজরুল ইসলাম তাঁর ‘আর কত দিন’ কবিতায় বলেছেন -‘তোমার সত্য-পথভ্রষ্ট হয়েছে মানুষ ভয়ে, আত্মা আত্মহত্যা করেছে অপমানে পরাজয়ে’।

আত্মহত্যা নিয়ে গোটা বিশ্ব চিন্তিত। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার হিসাবে ২০২০ সাল নাগাদ প্রতিবছর প্রায় এক মিলিয়ন মানুষ আত্মহত্যার কারণে মারা যায়। ২০১৫ সালের ১০ সেপ্টেম্বর বিবিসির আত্মহত্যা বিষয়ক জরিপে বাংলাদেশ ১০ম স্থানে রয়েছে। অনৈতিক প্রেম, পরীক্ষায় ফেল, যৌতুক, অভাব, পরকীয়া, স্বপ্নভঙ্গ, পারিপার্শ্বিক অবস্থার সাথে খাপ খাওয়াতে না পারা ইত্যাদির কারণে আমাদের দেশের মানুষ আত্মহত্যা করে।

একজন মানুষ তার জীবনে অসংখ্যবার মৃত্যুর পথে হাঁটার চেষ্টা করে। আইন, জনগণের কাছে জবাবদিহিতা, মৃত্যু পরবর্তী ফলাফল, ধর্মপরায়ণতা এসব কিছু বিবেচনা করে মৃত্যুইচ্ছাকে মানুষ দমন করে। যুগে যুগে দেখা গেছে সাহিত্যিক, অভিনেতা -অভিনেত্রী, প্রচণ্ড ধনী, নাম যশ এর অধিকারী অনেক বিজ্ঞ ব্যক্তিরা আত্মহত্যা করেছেন। এমনকি মোটিভেশনাল গুরু ডেল কার্নেগীও আত্মহত্যা করেছেন। আর্নেষ্ট হেমিংওয়ে The old man and the sea তে বলেছেন -Man is not made for defeat. অনুপ্রাণিত হওয়ার মত এত সুন্দর কথাটি বলার পরও তিনি অনেকবার আত্মহননের চেষ্টা করেছেন।

প্রযুক্তির ছোঁয়ায় মানুষের জীবনের গতি বাড়লেও কমেছে সফ্‌টস্কিলগুলির পরিচর্যা ; যেমন -যোগাযোগ রক্ষা, দলগতভাবে কাজ করা,নেতৃত্ব দিয়ে সঠিক সিদ্ধান্ত দেয়া বা পরামর্শ দ্বারা আশেপাশের মানুষকে অনুপ্রাণিত করা,সহানুভূতি, সহমর্মিতা বা আশার বাণী দিয়ে ইতিবাচক ধারনা দেয়া, পাঠাগারে বই পড়া ও লিখালিখিতে উৎসাহ দেয়া ইত্যাদি। এইসব চর্চার দ্বারা সবার মাঝে সম্পর্কের টেকসই বুনন রচিত হলে আত্মহত্যার প্রবণতা কমে আসতে পারে।

২০২১ সালের এক জরিপে দেখা যায় ১০১ জন শিক্ষার্থী আত্মহত্যা করেছে প্রচণ্ড মানসিক চাপ ও স্বপ্নভঙ্গের কারণে। সম্প্রতি ফেইসবুক লাইভে এসে আত্মহত্যা করেছেন ব্যবসায়ী মহসিন খান। পুলিশের তদন্তে উঠে আসে একাকীত্ব, লোকসান ও মানসিক অসুস্থতার কারণে চরম অবসাদগ্রস্ত ছিলেন তিনি। যার কারণে আত্মহত্যার পথ বেছে নিয়েছেন বলে ধারনা করা হয়। কণ্ঠশিল্পী নিলয় অবসাদগ্রস্ত হয়ে আত্মহত্যা করেন সম্প্রতি।

পরিকল্পিতভাবে সুইসাইড নোট লিখে সুইসাইড করাকে বলা হয় ডিসিসিভ সুইসাইড। এর ইঙ্গিত আগেই পাওয়া যায়, এরা আত্মহননের কথা বলে, অস্থির হয়ে যায়, ঘুমায়না এবং অবসাদগ্রস্ত থাকে। ইমপালসিভ সুইসাইড করে আবেগের বশে হুট করে। আত্মহত্যা প্রতিরোধ করতে হলে শিশুকাল থেকে বুঝাতে হবে আত্মহত্যা গৌরবের নয়, এটা জীবনযুদ্ধে পরাজিত হওয়ার সামিল। বরং কণ্টকাকীর্ণ জীবনে লড়াই করে বেঁচে থাকাটাই গৌরবের। তাছাড়া ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে এটা যে অপরাধ এবং পাপকর্ম তাও বলতে হবে। ইসলাম ধর্মে ও সনাতন ধর্মে আত্মহনন নিষিদ্ধ। মানসিক আঘাতপ্রাপ্ত দুর্বল চিত্তের মানুষগুলিকে আশার বাণী শুনিয়ে কাছে টেনে নিতে হবে। সমাজে ব্যর্থতাকে গ্রহণ করার মানসিকতা গড়ে তুলতে হবে কেননা ব্যর্থতাই সফলতার চাবিকাঠি। পাশাপাশি কীটনাশক ও ঘুমের ঔষধের সহজলভ্যতা কমাতে হবে। মানসিক অবসাদগ্রস্তদের তাদের নিজ পরিবার থেকেই সর্বোচ্চ কাওন্সেলিং করতে হবে এবং দ্রুত মনরোগ বিশেষজ্ঞের সাহায্য নিতে হবে। রাষ্ট্র, সমাজ ও পরিবার একযোগে এগিয়ে আসতে হবে এই ভয়ানক প্রবণতাকে প্রতিহত করার জন্য।

মানসিক স্বাস্থ্যের উন্নয়ন, আত্মবিশ্বাস বাড়ানো, ব্যর্থতাকে মেনে নেয়া, বন্ধুত্ব করা ও দায়িত্ববান হওয়া, সর্বোপরি আত্মহননকে ঘৃণা করা ইত্যাদি বিষয়ে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পাঠদানের ব্যবস্থা থাকতে হবে।

লেখক : প্রাবন্ধিক; সহকারী অধ্যাপক,
বোয়ালখালী হাজী নুরুল হক ডিগ্রি কলেজ, চট্টগ্রাম

পূর্ববর্তী নিবন্ধঅসামপ্রদায়িক সমাজ গঠনে লেখকের ভূমিকা অপরিসীম
পরবর্তী নিবন্ধসামাজিক অবক্ষয়ের গল্প