চট্টগ্রামের কর্ণফুলী নদীর শিকলবাহা খাল থেকে গৃহবধূ দিলরুবা বেগম পীপার (৩৫) মরদেহ উদ্ধারের পর এটি আত্মহত্যা নাকি পরিকল্পিত খুন—এ নিয়ে নির্দিষ্ট কোনো তথ্য এখনো মেলেনি। পুলিশও কোন কূল কিনারা পায়নি। তবে এই মর্মান্তিক মৃত্যুকে ঘিরে নানা রহস্যের দানা বাঁধতে শুরু করেছে।
এরই মধ্যে গত শুক্রবার ভিকটিমের ভাই সেলিম উল্লাহ বাদী হয়ে কর্ণফুলী থানায় একটি হত্যা মামলা দায়ের করেন। যে মামলায় গৃহবধূর স্বামী ব্যবসায়ি আবদুল আলীম প্রকাশ আলম (৪০) গ্রেপ্তার হয়ে জেলহাজতে রয়েছেন। তারও আগে গ্রেপ্তার স্বামী কোতোয়ালী থানায় একটি নিখোঁজ ডায়েরি করেন।
সব মিলিয়ে ভিকটিমের পরিবার ও স্বামী পক্ষের লোকজনের পরস্পর বিরোধী বক্তব্যে এ ধূম্রজালের সৃষ্টি হয়। গত বৃহস্পতিবার চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে মৃতের ময়নাতদন্ত করা হয়। পরে লাশ পরিবারের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। পুলিশ বলছে, লাশের ময়নাতদন্তের পর জানা যাবে মৃত্যু রহস্য।
মামলার তদন্ত কর্মকর্তা ও কর্ণফুলী ওসি কী বলছেন
কর্ণফুলী থানার উপ-পরিদর্শক (এসআই) মুহা. আজিজুর রহমান বলেন, ‘এটা নিয়ে আমাদের ঊধ্বর্তন অফিসারসহ অনেকেই কাজ করছেন। পোস্টমর্টেম রিপোর্ট না আসা পর্যন্ত কিছু বলতে পারছি না। এটি হত্যা না আত্মহত্যা! কারণ ৪-৫ দিনের একটি লাশ পাওয়া গেছে। তাও খালে। চেষ্টা করতেছি ঘটনার রহস্য উদঘাটন করতে।’
কর্ণফুলী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মোহাম্মদ মনির হোসেন বলেন, ‘এখনো তেমন কিছু জানতে পারিনি। তবে এটা নিয়ে অফিসারেরা কাজ করছেন।’ তবে এটি আত্মহত্যা না পরিকল্পিত খুন তা জানতে ময়নাতদন্তের রিপোর্টের দিকে তাকিয়ে রয়েছে তদন্ত কর্মকর্তা।
যা বলছে ভিকটিম পীপার পরিবার
নিহত পরিবারের লোকজনের দাবি, গৃহবধূর স্বামী আবদুল আলীম দীর্ঘদিন ধরে পীপাকে শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন করে আসছিল। তাঁরা বলছেন, স্বামীই হত্যা করেছে পীপাকে। এতে পীপার মামা জসিম উদ্দিন জানান, গত রোববার থেকে পাওয়া যাচ্ছিলোনা পীপাকে। ওরা মোবাইল নিয়ে ফেলছে। স্বামী নিজেই কর্ণফুলীতে নিয়ে আমার ভাগ্নিকে হত্যা করছে। ভিকটিমের অপর ভাই (মামলার বাদি) সেলিম উল্লাহ কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলেন, ‘আমি বোনকে হারিয়েছি। আমি এর সুষ্ঠু বিচার চাই। ওর আমার গার্জিয়ান ছিলো।’
কী বলছে স্বামী আব্দুল আলীমের পরিবার
পারিবারিক কলহ থাকলেও পীপার মৃত্যুতে আব্দুল আলীম জড়িত নয় বলে তাদের দাবি। স্বামী আলীমের ছোট ভাই মো. জাহেদ আলম বলেন, সংসার করতে গেলে টুকিটাকি এদিক সেদিক হয়। তবে আমার জানা মতে বড় ধরনের কোন ঝগড়া হয়নি। সে আত্মহত্যা করেছে না কেউ খুন করেছে তা তদন্তে সাপেক্ষে সঠিক জানা যাবে। আমার ভাবির হত্যার বিচার আমিও চাই। যদি সেক্ষেত্রে তদন্তে বের হয় আমার ভাই আমার ভাবিকেই হত্যা করেছে, তাহলে উনারও বিচার চাই।’
যা বলছে পীপার কাছের বান্ধবীরা
গৃহবধূ পীপার খুব কাছের বান্ধবী ‘কামরুন নাহার’ এনকে মৃত্যুর খবর পেয়েই ফেসবুক স্ট্যাটাসে লিখেন- ‘৩০ বছর সম্পর্ক এভাবে কিছু না বলে চলে যাবে। আমার বেস্ট ফ্রেন্ড। আমি মানসিকভাবে ভালো নেই। আমকে কেউ মেসেজ কল দিবেন না। আমার কথা বলার মনমানসিকতা নাই। তুই আমার বাসায় আর আসবি না দিলরুবা। সবাই আমার বেস্ট ফ্রেন্ডের জন্য দোয়া করবেন। আল্লাহ যেন তাঁকে জান্নাতবাসী করুক (আমিন)।’
এ ও এন আদ্যক্ষরের পরিচিতজন দুজন বান্ধবী জানান, ‘পীপা মানুষ হিসেবে অত্যন্ত একজন ভালো মনের ছিলেন। কারো সাথে কখনোই খারাপ ব্যবহার করেনি। তবে কেন, কী কারণে এই ঘটনাটি ঘটেছে এখন পর্যন্ত জানতে পারিনি। কর্ণফুলী নদীতে রাত ৮টা বা ৯ টার সময় কেউ ঝাঁপ দিয়ে আত্মহত্যা করলে, কেউ না কেউ শুনতে পেত। এছাড়াও পীপার সর্বশেষ ফেসবুক স্টাট্যাসেও তেমন কোন তথ্য মিলেনি।
যা ছিলো সুরতহাল রিপোর্টে
সিএমপি কর্ণফুলী থানার উপ-পরিদর্শক (এসআই) মুহা. আজিজুর রহমানের তথ্য সূত্র জানায়, গৃহবধূর শরীরে কোন যৌন নিপীড়ন বা জখমের আলামত নেই। মৃত্যুর সম্পর্কে কোন সুনির্দিষ্ট কারণ জানা যায়নি। মৃতদেহ শিকলবাহা কালারপোল খালের পানিতে ভাসমান ছিল। তাঁর শরীরে বাহ্যিক কোন আঘাত বা আঁচড়ের চিহ্ন দৃশ্যমান হয়নি। মৃত্যুর সঠিক কারণ নির্ণয়ে ময়নাতদন্তসহ অন্যান্য ব্যবস্থা গ্রহণের অনুরোধ করা হয়েছে রিপোর্টে।
পীপার ঘটনার টুকরো তথ্য আর প্রতিবেদকের অনুসন্ধান
সিসিটিভি ফুটেজ বলছে, পীপা নগরীর আবেদীন কলোনির বাসা থেকে গত ২৭ তারিখ রাত ৭টা ২৪ মিনিটের সময় মোবাইল টিপতে টিপতে বের হন। তারপর সে সিএনজি নিয়ে ৮টা ৬ মিনিটের সময় বাকলিয়া পৌঁছে। তাঁর মানে বাসা থেকে সে বের হবার ঠিক ৪২ মিনিট পর নতুনব্রিজ চত্বরে পৌঁছে।
সেখানে তার ফোন এক্টিভেট ছিলো ৮ টা ২৮ মিনিট ১২ সেকেন্ড পর্যন্ত। এ সময় ফোনের লোকেশন চরপাথরঘাটা, মর্ডান পলি ও বাকলিয়া চর চাক্তাই দেখান বলে পুলিশের বিশেষায়িত একটি টিম সদস্যের মন্তব্য। যারা বিষয়টি নিয়ে কাজ করছেন।
এছাড়াও তিনি আরও জানান, ‘লাশ যেহেতু কর্ণফুলী নদীতে ভেসে শিকলবাহার কালারপোল খালে আসে। তাহলে আশপাশ যেমন বাকলিয়া ক্ষেতচর, বাকলিয়া নেভাল ঝোপঝাড় জঙ্গলে তল্লাশি দিলে হয়তো পীপার কাপড় বা জুতা পাওয়ার সম্ভবনাও উড়িয়ে দেওয়া যায় না। সেটাও তারা দেখছেন।’
এ বিষয়ে ক্রিমিনোলজি বিভাগে পড়ুয়া আইনজীবী আশিকুর রহমান সুমন বলেন, ‘কেউ যদি নদীতে লাফ দিয়ে আত্মহত্যা করে এবং ৪-৫ দিন পরে লাশ মিলে তাহলে নিশ্চয়ই মৃতদেহে কাপড় চোপড় থাকবে। লাশ উদ্ধার ও সুরতহাল রিপোর্ট গুরুত্বপূর্ণ বিষয় এক্ষেত্রে। এছাড়াও ভিকটিমের মোবাইল ফোন উদ্ধার ও সর্বশেষ কাদের সাথে কথা হলো তাঁদের জিজ্ঞাসাবাদ করা জরুরি মামলার স্বার্থে।’
বিষণ্নতার সঠিক চিকিৎসা প্রয়োজন
নিহতের পরিবারের এক সদস্য জানায় পীপা উচ্চ রক্তচাপ ও মানসিক রোগে ভুগছিলেন। নগরীর পাঁচলাইশ শেভরন হাসপাতালে চিকিৎসা নিতেন মাঝে মধ্যে। তবে কাগজপত্র পর্যালোচনা করার সুযোগ হয়নি।
এ প্রসঙ্গে মানসিক রোগ বিশেষজ্ঞ (সাইকিয়াট্রি) চিকিৎসক অধ্যাপক গিয়াস উদ্দিন বলেন, ‘মানসিক বিষণ্নতা থেকে আত্মহত্যার প্রবণতা দেখা যায়। বিষণ্নতার উপযুক্ত চিকিৎসার প্রয়োজন। এক্ষেত্রে পরিবার ও বন্ধুদের এগিয়ে আসতে হবে। তাঁরা যদি বুঝতে পারে তাঁদের বন্ধু বিষণ্নতায় আক্রান্ত তাহলে তাঁর পাশে দাঁড়াতে হবে। মানসিক রোগটিকে এড়িয়ে যাওয়া বা অবহেলার সুযোগ নেই।’
প্রতিবেদকের অনুসন্ধান বলছে, আপাতদৃষ্টে এটা আত্মহত্যার ঘটনা বলে মনে হচ্ছে না। তবে পুলিশও খুনের সম্ভাবনাকে পুরোপুরি উড়িয়ে দিচ্ছে না। তাঁরাও সর্বোচ্চ চেষ্টা করছেন সত্য পর্যন্ত পৌঁছাতে গভীরে গিয়ে তদন্ত করছেন। সবদিক থেকে তাঁরা খতিয়ে দেখছেন। তবে এ ধরনের একটি গুরুত্বপূর্ণ মামলা সদ্য ডিএমপিতে বদলি হওয়া কোন উপ-পরিদর্শক (এসআই) কে তদন্তের দায়িত্ব দেওয়া কর্ণফুলী ওসির উচিত হয়নি বলেও মামলা সংশ্লিষ্টদের মন্তব্য পাওয়া গেছে।
এ প্রসঙ্গে সিএমপি বন্দর জোনের উপ পুলিশ কমিশনার (ডিসি) শাকিলা সোলতানা বলেন, ‘বিষয়টি নিয়ে পুলিশের একাধিক টিম কাজ করছেন। এটি হত্যা না আত্মহত্যা তা এখন বলা যাবে না। যেহেতু তদন্তাধীন বিষয়। তবে সত্য উদঘাটন করতে পুলিশ কাজ করছে। শিগগিরই জানা যাবে।’
প্রসঙ্গত, নগরীর পুর্ব বাকলিয়া ১৮ নম্বর ওয়ার্ড আব্দুল লতিফ হাট আব্দুল্লাহ সওদাগর বাড়ির হাজী মো. মহসিনের মেয়ে দিলরুবা বেগম পীপার সাথে ২০১০ সালে আবদুল আলিম প্রকাশ আলমের বিয়ে হয়। তাঁদের ঘরে দুই সন্তান রয়েছে। আরশী আকতার (১৩) ও আজুয়া (৯)।