গত ১০ সেপ্টেম্বর বিশ্ব আত্মহত্যা প্রতিরোধ দিবস পালন করা হয়েছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সহযোগিতায় ইন্টারন্যাশানাল অ্যাসোসিয়েশন ফর সুইসাইড প্রিভেনশন (আইএএসপি) এবং ওয়ার্ল্ড ফেডারেশন ফর মেন্টাল হেলথ বিশ্ব আত্মহত্যা প্রতিরোধ দিবস পালন করে। আত্মহত্যা ঠেকাতে নানারকম উদ্দীপনামূলক কর্মসূচি উদযাপন করা হয়েছে। আজাদীতে প্রকাশিত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাড়ছে আত্মহত্যার প্রবণতা। কমছে জীবনের প্রতি ভালোবাসা। জানা গেছে, চট্টগ্রামে নগরীর তুলনায় জেলার বিভিন্ন এলাকায় আত্মহত্যার ঘটনা বেশি ঘটছে।
নানা কারণে প্রতিদিন অকাতরে ঝরছে প্রাণ। হত্যাকাণ্ডের চেয়ে আত্মহত্যার প্রবণতাও কম নয়। বিপদের চরম সীমায় পৌঁছে পরিণামে মৃত্যুকে আলিঙ্গন করে আত্মহত্যার মধ্য দিয়ে হতাশা থেকে মুক্তির পথ খুঁজে নেয়। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে, এভাবে আত্মহত্যা বা আত্মহননের মধ্য দিয়ে একজন মানুষের চিরবিদায় কখনো প্রত্যাশিত হতে পারে না। কারণ প্রতিটি জীবনেরই মূল্য আছে। প্রতিটি মানুষ সমাজ-সংসারে এবং দেশের উন্নয়নে এগিয়ে যাওয়ার পথযাত্রায় কোনো না কোনো ক্ষেত্রে অবদান রাখতে পারেন।
জানা যায়, গত বছর চট্টগ্রামে আত্মহত্যার প্রবণতা বেড়ে গিয়েছিল। প্রায় প্রতিদিনই চট্টগ্রামের কোথাও না কোথাও আত্মহত্যার ঘটনা ঘটছিল। চলতি বছরেও তা অব্যাহত আছে। সারা দেশের থানা, পুলিশ ফাঁড়ির দেয়া তথ্যানুযায়ী বিশেষ করে থানায় লিপিবদ্ধ মামলার তথ্যানুযায়ী দেশে প্রতিদিন গড়ে ৩০ থেকে ৩১টি মৃত্যুর ঘটনা ঘটে। এ হিসাবে মাসে এ ধরনের অপমৃত্যুর ঘটনা ঘটে ৯০০ জনের। আর বছরে আত্মহননে মৃত্যু ঘটে ১০ হাজার ৮০০ জনের। এসব মৃত্যুকে আত্মহত্যা বা আত্মহনন বলে থানায় প্রদত্ত এজাহারে উল্লেখ করা হয়। এ কারণে অনেক সময় প্রকৃত আত্মহত্যায় বা আত্মহননে মৃত্যুর পরিসংখ্যান জানা সম্ভব হয় না।
জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক ডা. হেলাল উদ্দিন আহমেদ তাঁর এক লেখায় বলেন, বাংলাদেশে যৌতুক ও পারিবারিক নির্যাতন, আবেগ নিয়ন্ত্রণের ব্যর্থতা, দাম্পত্য কলহ, উত্ত্যক্তকরণ, প্রেম ও পরীক্ষায় ব্যর্থতা, দারিদ্র্য ও বেকারত্ব, আত্মহত্যার উপকরণের সহজপ্রাপ্যতা, মানসিক অসুস্থতা ইত্যাদি কারণে বেশির ভাগ আত্মহত্যার ঘটনা ঘটে থাকে। প্রচারমাধ্যমে আত্মহত্যার সংবাদের অতিপ্রচার, অপপ্রচার বা অদায়িত্বশীল সংবাদ পরিবেশনের কারণেও কখনো কখনো আত্মহত্যার ঘটনা বাড়তে পারে। দুই ধরনের আত্মহত্যার ঘটনা ঘটে। এক. আগে থেকে পরিকল্পনা করে, আয়োজন করে, সুইসাইড নোট লিখে আত্মহত্যা করেন অনেকে। যেটাকে বলা হয় ডিসিসিভ সুইসাইড। দুই. হুট করে আবেগের রাশ টানতে না পেরে আত্মহত্যা করে ফেলেন অনেকে, যেটাকে বলা হয় ইমপালসিভ সুইসাইড। ডিসিসিভ সুইসাইড যাঁরা করেন, তাঁরা আগে থেকেই কিন্তু আত্মহত্যার ইঙ্গিত দিয়ে থাকেন। এ ধরনের মানুষ আত্মহননের আগে যেভাবে সেটা প্রকাশ করেন, তার মধ্যে আছে- তাঁরা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে মৃত্যু আর আত্মহত্যা নিয়ে নিজের ইচ্ছার কথা প্রকাশ করেন; আত্মহত্যা বা মৃত্যুবিষয়ক কবিতা-গান লিখতে, শুনতে বা পড়তে থাকেন; নিজের ক্ষতি করেন; প্রায়ই এঁরা নিজের হাত-পা কাটেন, বেশি বেশি ঘুমের ওষুধ খান। মনমরা হয়ে থাকা, সব কাজে উৎসাহ হারিয়ে ফেলা, নিজেকে দোষী ভাবা-এগুলো বিষণ্নতার লক্ষণ; যা থেকে আত্মহত্যা ঘটে; মাদকাসক্তি বা ইন্টারনেটে মাত্রাতিরিক্ত আসক্তি আত্মহত্যায় সহায়তা করে; সারা রাত জেগে থাকা আর সারা দিন ঘুমানো; নিজেকে গুটিয়ে রাখা, সামাজিক অনুষ্ঠানে অংশ না নেওয়া।
সমাজবিজ্ঞানী ড. অনুপম সেনের মতামত তুলে ধরা হয়েছে আজাদীর প্রতিবেদনে। তিনি বলেন, একটি মানুষের মানসিক গঠনে যেসব বিষয় ভূমিকা রাখে সেগুলোর কোনও একটি বিষয় যদি অনুপস্থিত থাকে তাহলে তার প্রভাব তার কার্যক্রমে দেখা যায়। একজন হত্যাকারীর ভেতর দেখা যাবে মানবিক অনেক কিছু অনুপস্থিত। তার গঠন ঠিকমতো হয়নি। সে অন্যের স্বার্থের চেয়ে নিজের স্বার্থকে বেশি প্রাধান্য দেয়। তার মূল্যবোধের জায়গাটিও তৈরি হয়নি। সঠিক শিক্ষার অভাব, অর্থনৈতিক, সামাজিক ও রাজনৈতিক কারণে একজন মানুষ হত্যাকারী হয়ে উঠেন। আবার যিনি আত্মহত্যা করেন তার পেছনেও অনেকগুলো কারণ আছে। মানসিক স্বাস্থ্যের খেয়াল রাখা উভয়ের জন্যই জরুরি।
বিশেষজ্ঞরা বলেন, আত্মহত্যা একটি প্রতিরোধযোগ্য বিষয়। সঠিক সময়ে উপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারলে অবশ্যই আত্মহত্যা ঠেকানো যায়। এ জন্য সবাইকে যার যার ক্ষেত্র থেকে একযোগে কাজ করে যেতে হবে।