আত্মসম্মানই ব্যক্তিত্বের প্রকৃত ভিত্তি

সাইফ চৌধুরী | সোমবার , ২৯ ডিসেম্বর, ২০২৫ at ৬:২৫ পূর্বাহ্ণ

মানুষের জীবনে আত্মসম্মান এমন এক নীরব কিন্তু শক্তিশালী গুণ, যা ধীরে ধীরে তার ব্যক্তিত্ব গড়ে তোলে, আচরণকে সংযত করে এবং সমাজে তার অবস্থানকে সুদৃঢ় করে। আত্মসম্মান কোনো বাহ্যিক জাঁকজমক বা প্রদর্শনের বিষয় নয়, এটি মূলত অন্তর্গত এক শক্তি। অনেকেই আত্মসম্মানকে অহংকারের সঙ্গে গুলিয়ে ফেলে, কিন্তু বাস্তবে আত্মসম্মান মানে নিজেকে অন্যের চেয়ে বড় মনে করা নয়, বরং নিজের মূল্য বোঝা, নিজের সীমা জানা এবং নিজের অবস্থান নিজেই নির্ধারণ করা। যে ব্যক্তি নিজের মর্যাদা সম্পর্কে সচেতন, সে কখনো নিজেকে হালকা করে দেখে না, আবার অন্যকেও ছোট করে দেখার প্রবণতা রাখে না। আত্মসম্মানহীন মানুষ সহজেই অবমূল্যায়িত হয়, কারণ সে নিজেই নিজের গুরুত্ব নষ্ট করে ফেলে। তাই বলা যায়, আত্মসম্মানই ব্যক্তিত্বের প্রকৃত ভিত্তি; এটি দুর্বল হলে ব্যক্তিত্বও দুর্বল হয়ে পড়ে।

আত্মসম্মানের শুরু হয় নিজের প্রতি দায়বদ্ধতা থেকে। একজন মানুষ যখন নিজের সময়, শ্রম, চিন্তা এবং অনুভূতিকে গুরুত্ব দিতে শেখে, তখনই তার আত্মসম্মানের ভিত্তি তৈরি হয়। যে ব্যক্তি নিজেই নিজের মূল্য বোঝে না, অন্যের কাছ থেকে সম্মান আশা করা তার জন্য অবাস্তব। জীবনে অনেক সম্পর্ক থাকে যেখানে একজন মানুষই সব সময় খোঁজ নেয়, যোগাযোগ রাখে, ছাড় দেয় এবং মানসিক বোঝা বহন করে। এই একতরফা সম্পর্ক ধীরে ধীরে আত্মসম্মানকে ক্ষয় করে দেয়। যারা প্রয়োজন ছাড়া যোগাযোগ করে না, যারা নিয়মিত খোঁজ নেয় না বা কেবল নিজের স্বার্থে কাছে আসে, তাদের পেছনে অযথা সময় ও আবেগ ব্যয় করা মানে নিজের মূল্য কমিয়ে দেওয়া। সম্পর্কের ক্ষেত্রে ভারসাম্য না থাকলে সেখানে প্রকৃত সম্মান কখনো স্থায়ী হয় না। আত্মসম্মানসম্পন্ন মানুষ জানে কোথায় থামতে হয়, কাকে অগ্রাধিকার দিতে হয় এবং কখন সম্মান বজায় রেখে সরে আসাই শ্রেয়।

অতিরিক্ত ভরসা এবং অযৌক্তিক প্রত্যাশা মানুষের আত্মসম্মানকে দুর্বল করে তোলে। যে ব্যক্তি সব সময় অন্যের ওপর নির্ভর করে চলে, সে ধীরে ধীরে নিজের সক্ষমতা ও আত্মবিশ্বাস হারিয়ে ফেলে। আত্মসম্মান মানে আত্মনির্ভরতা নিজের দায়িত্ব নিজে নেওয়া এবং নিজের সমস্যার সমাধান নিজেই করার চেষ্টা করা। জীবনে শিক্ষা অর্জন, দক্ষতা বৃদ্ধি, পেশাগত উন্নয়ন এবং মানসিক দৃঢ়তা গড়ে তোলা আত্মসম্মানের বাস্তব প্রকাশ। যে মানুষ নিজের উন্নতির পথে নিয়মিত কাজ করে, সে কারো দয়ার ওপর দাঁড়িয়ে থাকতে চায় না। এমন মানুষ সমাজে স্বাভাবিকভাবেই প্রভাব তৈরি করে এবং সম্মান অর্জন করে।

মানুষের কথা ও আচরণ তার ব্যক্তিত্বের সবচেয়ে স্পষ্ট পরিচয় বহন করে। অপ্রয়োজনীয় কথা বলা, গসিপে মেতে থাকা, অন্যের ব্যক্তিগত বিষয়ে নাক গলানো কিংবা অহেতুক সমালোচনা করা একজন মানুষের মর্যাদা কমিয়ে দেয়। যে ব্যক্তি নিজের কথার ওপর নিয়ন্ত্রণ রাখতে পারে না, সে নিজের সম্মানও ধরে রাখতে পারে না। সংযত ভাষা, পরিমিত আচরণ এবং সচেতন উপস্থিতি মানুষকে আলাদা করে তোলে। অনেক সময় একটি সংক্ষিপ্ত, ভদ্র এবং দৃঢ় বক্তব্য শত কথার চেয়েও বেশি সম্মান এনে দেয়। কখন কথা বলা প্রয়োজন এবং কখন নীরব থাকাই শ্রেয়। এই বোধ আত্মসম্মানের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ।

সম্পর্কে সীমা নির্ধারণ করা আত্মসম্মানের অন্যতম শর্ত। পরিবার, বন্ধুত্ব কিংবা পেশাগত সম্পর্ক সব ক্ষেত্রেই সুস্পষ্ট সীমা থাকা জরুরি। কেউ যদি বারবার অসম্মান করে, অবহেলা দেখায় বা একতরফা সুবিধা নিতে চায়, তাহলে নীরব থাকা আত্মসম্মান নয়, বরং আত্মঅবমূল্যায়ন। সম্মানজনক ও শান্তভাবে নিজের অবস্থান স্পষ্ট করা আত্মসম্মানের পরিচয়। অনেক সময় একপাক্ষিক সম্পর্ক থেকে সরে আসা কঠিন মনে হলেও, তা মানসিক শান্তি এনে দেয় এবং নিজের মূল্য অক্ষুণ্ন রাখে। যারা নিজের মূল্য বোঝে, তারা অন্যের প্রতিও শালীনতা ও নৈতিকতা বজায় রাখে।

চেহারা, পোশাক, চলাফেরা এবং সামাজিক ভঙ্গি আত্মসম্মানের বাহ্যিক প্রকাশ। পরিচ্ছন্নতা, পরিমিত পোশাক এবং ভদ্র আচরণ মানুষের মনে ইতিবাচক ছাপ ফেলে। আত্মসম্মান মানেই দামি পোশাক বা বিলাসী জীবনযাপন নয়; বরং প্রয়োজন সচেতনতা ও শালীনতা। সামাজিক বা পারিবারিক অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকলেও নিজের সীমা জানা জরুরি। অনাকাঙ্ক্ষিতভাবে কারো ঘরে যাওয়া, অকারণে দীর্ঘ সময় অবস্থান করা কিংবা নিজেকে অতিরিক্তভাবে চাপিয়ে দেওয়া ব্যক্তিগত মর্যাদা কমিয়ে দেয়। আত্মসম্মানসম্পন্ন মানুষ জানে কোথায় কতটুকু থাকা উচিত এবং কীভাবে নিজেকে উপস্থাপন করতে হয়।

সময় ব্যবস্থাপনা আত্মসম্মানের একটি মৌলিক দিক। যে ব্যক্তি নিজের সময়ের মূল্য বোঝে না, তার জীবনে শৃঙ্খলা থাকে না। অপ্রয়োজনীয় আড্ডা, অর্থহীন বিতর্ক এবং লক্ষ্যহীন কাজে সময় নষ্ট করলে জীবনের ভারসাম্য নষ্ট হয়। সময়কে গুরুত্ব দিয়ে ব্যবহার করা, নির্দিষ্ট লক্ষ্য নির্ধারণ করা এবং ধারাবাহিক অভ্যাস গড়ে তোলা আত্মসম্মানকে দৃঢ় করে। সময়ানুবর্তিতা ও দায়িত্বশীলতা মানুষের প্রতি অন্যের আস্থা বাড়ায়, যা সম্মানের একটি শক্ত ভিত্তি তৈরি করে।

দানশীলতা ও উদারতা আত্মসম্মানের অংশ, তবে তা হতে হবে সচেতন ও সীমাবদ্ধ। সাহায্য করা অবশ্যই একটি মহৎ গুণ, কিন্তু নিজের মর্যাদা বিসর্জন দিয়ে অন্যকে খুশি করার চেষ্টা আত্মসম্মান নয়।

যে ব্যক্তি নিজের মূল্য বোঝে, সে অপ্রয়োজনীয় যোগাযোগে নিজেকে ব্যয় করে না। সব মেসেজের সঙ্গে সঙ্গে উত্তর দেওয়া, সব ডাকে সাড়া দেওয়া কিংবা সব জায়গায় উপস্থিত থাকা আত্মসম্মানের পরিচয় নয়। যথাযথ সময়, উপযুক্ত প্রতিক্রিয়া এবং সীমিত যোগাযোগ ব্যক্তিত্বকে দৃঢ় করে। যারা সত্যিকার অর্থে গুরুত্ব দেয়, তাদের জন্য সময় বের করা হয়; আর যারা গুরুত্ব দেয় না, তাদের পেছনে নিজেকে নিঃশেষ করা হয় না। এই সচেতনতা আত্মসম্মানের বাস্তব রূপ।

কোনো কাজই ছোট নয়, কাজের মানই মানুষকে বড় করে তোলে। যে ব্যক্তি নিজের দায়িত্ব নিষ্ঠা ও মনোযোগ দিয়ে পালন করে, সে স্বাভাবিকভাবেই সম্মান অর্জন করে। পেশাগত দক্ষতা বৃদ্ধি, শিক্ষাগত উৎকর্ষ এবং ব্যক্তিগত লক্ষ্য অর্জনের প্রচেষ্টা আত্মমর্যাদাকে শক্তিশালী করে। দায়িত্বে অবহেলা, কাজে ফাঁকি দেওয়া এবং অজুহাত খোঁজা মানুষকে ধীরে ধীরে ছোট করে দেয়। আত্মসম্মান মানে নিজের কাজে সেরাটা দেওয়া, ফলাফল যাই হোক না কেন।

আত্মসম্মান ছাড়া জীবন অসম্পূর্ণ। যেখানে আত্মসম্মান থাকে, সেখানে সম্পর্ক হয় স্থিতিশীল, সামাজিক অবস্থান হয় সুদৃঢ় এবং মানসিক শান্তি বজায় থাকে। নিজের মর্যাদা বোঝা, নিজের প্রতি সৎ থাকা এবং সীমা রক্ষা করা আত্মসম্মানের মূল ভিত্তি। জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে আচরণের শালীনতা, কাজের মান, সম্পর্কের পরিমিতি এবং সময়ের সঠিক ব্যবহার আত্মসম্মানের অংশ। সবশেষে বলা যায়, আত্মসম্মান জীবনের সবচেয়ে মূল্যবান সম্পদগুলোর একটি। এটি হারালে মানুষ নিজেই নিজের চোখে ছোট হয়ে যায়, আর এটি রক্ষা করতে পারলে জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে দৃঢ়তা আসে। নিজের প্রতি সচেতন থাকা, নিজের মূল্য বোঝা এবং মর্যাদা অটুট রাখা সফল ও সম্মানজনক জীবনের মূল চাবিকাঠি।

লেখক: প্রাবন্ধিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠক

পূর্ববর্তী নিবন্ধদক্ষ পেশীজীবীদের জন্য সৌদি আরবে নতুন সম্ভাবনা
পরবর্তী নিবন্ধদূরের দুরবিনে