মাঝে কিছু দিন পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে ছিল। আইনশৃক্সখলা বাহিনীর ধরপাকড়, আটক করে অভিভাবকের জিম্মায় দেওয়া, আড্ডাস্থলে কান ধরে ওঠবস করানোসহ নানাবিধ উদ্যোগের পাশাপাশি রাজনৈতিক বড় ভাইদের ‘আশীর্বাদের হাত’ মাথার ওপর থেকে সরে যাওয়ার কারণে বেপরোয়া কিশোর, উঠতি তরুণদের লাগাম টেনে ধরা সম্ভব হয়েছিল। কিন্তু ছাত্র রাজনীতির নামে সাম্প্রতিক সময়ে আধিপত্য বিস্তারের জের ধরে কলেজ–বিশ্ববিদ্যালয় যেমন উত্তপ্ত হয়ে উঠেছে, একইভাবে নগরীর আড্ডাস্থলগুলোও উঠতি কিশোরদের দাপটের কাছে অসহায় হয়ে পড়েছে। আড্ডাস্থলগুলোকে ঘিরে দিব্যি চলছে মাদক ব্যবসা, মাদক সেবন, কিশোর ও উঠতি বয়সী যুবকদের নিয়ে বড় ভাইদের রাজনৈতিক বৈঠক, স্কুল কলেজগামী ছাত্রীদের ইভ টিজিং, রাজনৈতিক গ্রুপিং ও এলাকাভিত্তিক আধিপত্য বিস্তারের নামে রক্ত ঝরানো।
গুণীজনেরা বলছেন, এতে আড্ডার দোষ কোথায়? রাজনৈতিক বিশ্লেষকরাও রাজনীতির ওপর দায় চাপাতে চান না এজন্য। দোষ আড্ডা কিংবা রাজনীতির নয়, গলদ সামাজিক দায়বদ্ধতার, পারিবারিক অনুশাসনের বেড়াজাল ছিঁড়ে যাওয়ার প্রবণতার। সম্প্রতি এমন বেপরোয়া কিছু ঘটনা ঘটছে যে, অভিভাবকমণ্ডলী, সমাজ বিশ্লেষকগণ, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কর্মকর্তা– সকলেই শঙ্কিত। কলেজ–বিশ্ববিদ্যালয় ছাড়িয়ে ছাত্র রাজনীতির কালো থাবা গড়িয়েছে স্কুলেও। শিশু–কিশোর অপরাধ আইনের সুুবিধে এবং পুলিশের নজরদারি এড়াতে স্কুলছাত্রদের ব্যবহার করছে তারা। বিনিময়ে অপরাধ জগতের অর্থের লোভ ও নেতৃত্বের নামে আধিপত্য বিস্তারের দাপট ছড়াচ্ছে এসব স্কুলছাত্র।
বখাটেদের আড্ডা চলছে তো চলছেই; স্কুল কলেজ কোচিং সেন্টারের সামনে, কখনো আবার পাড়ায় পাড়ায় গলি–উপগলিতে। কে শোনে কার কথা? কারণ তারা জানেই যে, তাদের বড়জোর থানা পর্যন্ত নিয়ে যাওয়া হবে। সামান্য বকাঝকাও জুটতে পারে কপালে। এর চেয়ে বেশি কিছু আর হবে না। এই অতি আত্মবিশ্বাস তাদের প্রায়শই বিপদে ফেলে দেয়। যার খেসারত দিতে হয় সে সহ ঘরের অন্যান্য সদস্যদেরও।
সর্বশেষ গত ১৭ ফেব্রুয়ারি রাত ১২টার দিকে নগরীর চকবাজার চমেক (চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ) ছাত্রাবাস সংলগ্ন চট্টেশ্বরী রোডে আধিপত্য বিস্তারের জেরে কিশোর গ্যাংয়ের একটি গ্রুপের সদস্যদের হামলায় প্রতিপক্ষের পাঁচজন আহত হয়েছেন। ঘটনার সত্যতা নিশ্চিত করেছেন চকবাজার থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মনজুর কাদের। প্রত্যক্ষদর্শীদের তথ্য অনুযায়ী, চকবাজারের কিশোর গ্যাংয়ের নেতা রবিউল ইসলাম রাজুর নেতৃত্বে একদল কিশোর ধারালো কিরিচ, লাঠি, হকিস্টিক ও দেশীয় অস্ত্র নিয়ে অতর্কিতে হামলা চালায়। এদের মধ্যে জিকু নামে এক যুবককে মাটিতে ফেলে আঘাত করতে থাকে হামলাকারীরা। হামলার শিকার ও হামলাকারী উভয় গ্রুপ সরকার দলীয় রাজনীতির সঙ্গে জড়িত। এদের মধ্যে হামলাকারী দলের নেতা রাজু স্থানীয় কাউন্সিলর নুরুল মোস্তফা টিনুর অনুসারী হিসেবে এলাকায় পরিচিত। ২০২১ সালে চমেক হাসপাতালের এক ডাক্তারকে হত্যা চেষ্টার মামলায় পাঁচলাইশ থানা পুলিশের হাতে গ্রেপ্তার হয়েছিল রাজু। পরে জামিনে বেরিয়ে আসে। তার বিরুদ্ধে পাঁচলাইশ ও চকবাজার থানায় চাঁদাবাজি, অপহরণ, হত্যা চেষ্টার একাধিক মামলা ও অভিযোগ থাকার তথ্য পাওয়া গেছে।
এটি বিচ্ছিন্ন কোনো ঘটনা নয়। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ, চট্টগ্রাম কলেজ, মহসিন কলেজ, এমইএস কলেজ ক্যাম্পাস ও আশেপাশের এলাকায় বিভিন্ন গ্রুপ উপগ্রুপে বিভক্ত হয়ে নিয়মিত চলছে অস্ত্রের মহড়া, ধাওয়া পাল্টা ধাওয়া, রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ। গত এক বছরে উল্লেখিত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে অর্ধশতাধিক সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে। শহীদ দিবস, স্বাধীনতা দিবসে ফুল দেওয়াকে কেন্দ্র করে, আবার স্বরস্বতী পূজার আয়োজনে, র্যাগ ডে কিংবা ডিপার্টমেন্টাল কোনো অনুষ্ঠানে ‘পান থেকে চুন খসার’ আগেই শিক্ষার্থীদের শরীর থেকে ঝরে রক্ত। বিভাগের পিকনিক, প্রেমিকা বিষয়ক ঝামেলা, সালাম না দেওয়ার মতো তুচ্ছ বিষয়েও সহপাঠীর রক্ত ঝরাচ্ছে শীর্ষ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর ছাত্ররা।
একইভাবে বাংলা ও ইংরেজি মাধ্যমে পড়ুয়া কিশোরেরা বিকেল থেকে রাত দশটা–এগারোটা পর্যন্ত নগরীর চেরাগীর মোড়, জামাল খান, সিআরবি, গোল পাহাড় মোড়, জিইসি মোড়, ষোলোশহর ২ নম্বর গেট, অভয়মিত্র ঘাট, নেভাল, বহদ্দারহাট, গণি বেকারি, চকবাজার, আগ্রাবাদসহ আরও কয়েকটি স্থানে আড্ডা দেয়। সেখান থেকেই শুরু হয় গোলযোগের।