গত আড়াই মাসে নগরের বিভিন্ন থানায় পুলিশ ‘মিথ্যা অভিযোগে’ ৩০টির অধিক মামলা দায়ের করে দলের এক হাজার নেতাকর্মীকে গ্রেপ্তার করার অভিযোগ করেছে চট্টগ্রাম মহানগর বিএনপি। এছাড়া হয়রানি করতে দলীয় নেতাকর্মীর বাসায় তল্লাশি এবং পরিবারের সদস্যদের মারধর ও গ্রেপ্তার করা হচ্ছে বলেও অভিযোগ করা হয়।
গতকাল দুপুরে নাসিমন ভবনস্থ দলীয় কার্যালয়ে চট্টগ্রাম মহানগর বিএনপির উদ্যোগে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে এসব অভিযোগ করা হয়। এতে লিখিত বক্তব্য পাঠ করেন সংগঠনের আহ্বায়ক ডা. শাহাদাত হোসেন।
লিখিত বক্তব্যে বলা হয়, মামলার আসামি হলে গ্রেপ্তার করতে পারে। কিন্তু আত্মীয়–স্বজনকে থানায় ধরে নিয়ে গিয়ে শারীরিক নির্যাতন করার অধিকার পুলিশকে কে দিয়েছে? বিএনপিকে মাঠছাড়া করতে সরকারের অগণতান্ত্রিক নির্দেশে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী যা করছে তা চট্টগ্রামবাসী গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করছে। বাড়াবাড়ির পরিণাম অবশ্যই শুভ হতে পারে না। পুলিশ প্রজাতন্ত্রের কর্মচারী, আওয়ামী লীগের কর্মচারী নন। আপনারা আওয়ামী লীগের কর্মীর ভূমিকার অবতীর্ণ হবেন না।
দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের দিন চান্দগাঁওয়ে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের সঙ্গে বিএনপি নেতাকর্মীদের সংঘটিত ঘটনা প্রসঙ্গে ডা. শাহাদাত বলেন, ভোটকেন্দ্রে কেউ এলে তাকে প্রতিহত করার কোনো নির্দেশনা নগর বিএনপি দেয়নি। নির্বাচনের দিন কেন্দ্রঘোষিত হরতালের সমর্থনে বিএনপির নেতাকর্মীরা শান্তিপূর্ণ মিছিল বের করেছিল। মিছিলে পুলিশ হামলা চালিয়ে নেতাকর্মীদের আহত করে ১২ জনকে গ্রেপ্তার করে।
শাহাদাত বলেন, আমাদের সেদিন কেন্দ্রীয়ভাবে হরতাল ছিল। হরতালে শান্তিপূর্ণভাবে মিছিল করার জন্য সারা বাংলাদেশে। আমরা কাউকে বলিনি যে, নির্বাচনে ভোট সেন্টারে কেউ আসলে তাকে আমরা প্রতিহত করবো। আমরা বলেছি, নির্বাচন বয়কট করুন, এ ধরনের একটি অগণতান্ত্রিক নির্বাচনে আপনারা যাবেন না, বরং না গিয়ে বর্জনের মাধ্যমে এ নির্বাচনকে আপনারা না বলুন। আমাদের বক্তব্যে বারবার এটা বলেছি, লিফলেটে কিন্তু এটা লেখা আছে। কোথাও কোনো জায়গায় নির্বাচন প্রতিহত করার কথা আমরা বলিনি।
তিনি বলেন, অতীতে যত আন্দোলন হয়েছে, হরতালে মিছিল হয়েছে। মিছিল করার সাংবিধানিক অধিকার আমাদের আছে। কিন্তু মিছিল করে কাউকে মারার নির্দেশ আমাদের ছিল না। কিন্তু যখন তারা গণতান্ত্রিক মিছিল করেছে, সেখানে পুলিশ, র্যাব, বিজিবির সঙ্গে তাদের সংঘর্ষ হয়েছে। পুলিশ বাধা দিয়েছে, স্বাভাবিকভাবেই সংঘর্ষ হয়েছে। কিন্তু নির্বাচনকে প্রতিহত কর, কাউকে মারধর কর–এটা আমরা কখনও বলিনি।
লিখিত বক্তব্যে বলা হয়, বিএনপির ডাকা হরতাল অবরোধকে কেন্দ্র করে নগর বিএনপির সদস্য সচিব আবুল হাশেম বক্করসহ শত শত নেতাকর্মীদের নামে নগরীর প্রতিটি থানায় মামলা দায়ের করা হয়েছে। ডা. শাহাদাত দাবি করেন, ঘটনার সময় দক্ষিণ জেলা বিএনপির আহ্বায়ক আবু সুফিয়ান ও নগর বিএনপির আহ্বায়ক কমিটির সদস্য এরশাদ উল্লাহসহ অনেকে উপস্থিত না থাকার পরও তাদেরকে আসামি করা হয়েছে। এমনকি সেদিন বোয়ালখালী নিজ বাড়িতে থাকা চান্দগাঁও শরাফত উল্লাহ পেট্রোল পাম্পের ম্যানেজার জামাল উদ্দিনকে আসামি করা হয়। ক্যাশিয়ার মো. হারুনকে ২১ নম্বর আসামি করা হয়েছে। অথচ ঘটনার সময় পেট্রোল পাম্পের ভেতরে পুলিশ, র্যাব, বিজিবি, ডিবির গাড়ি পার্কিং করে রেখেছিল। সিসি ক্যামেরার ফুটেজ আছে, দেখলে সবকিছু পরিষ্কার হবে।
শাহাদাত বলেন, চান্দগাঁও থানা এলাকায় বিরোধী দলের নেতাকর্মী এবং সাধারণ জনগণ এখন একাত্তরের দিনগুলোর চেয়েও চরম সংকটকাল অতিক্রম করছে। এলাকার বিএনপি নেতাকর্মীদের অমানবিক নির্যাতন করা হচ্ছে। চান্দগাঁও থানা পুলিশ বিএনপি নেতাদের বাসায় না পেয়ে পরিবারের অন্য সদস্যদের অন্যায়ভাবে গ্রেপ্তার করছে। দিনে রাতে যে কোনো সময় নেতাকর্মীদের ধরতে বাড়িতে বাড়িতে হানা দিচ্ছে। টার্গেটকৃত ব্যক্তিকে বাসায় না পেয়ে তাদের পিতা, ভাই কিংবা অন্য সদস্যদের অন্যায়ভাবে আটক করে নিয়ে যাচ্ছে। আটককৃত নেতাকর্মী কিংবা তাদের আত্মীয় স্বজনদের থানায় নিয়ে গিয়ে অবর্ণনীয় নির্যাতন করা হচ্ছে। চান্দগাঁও থানা এলাকা এখন অনেকটা পুরুষ শূন্য। পুলিশের গ্রেপ্তারের ভয়ে সাধারণ মানুষও ঘরে থাকতে পারছে না।
সংবাদ সম্মেলনে দাবি করা হয়, ছাত্রদলের সাবেক সহসভাপতি নওশাদ আল জাসেদুর রহমানকে বাসায় না পেয়ে তার ভাই আবেদ মাহমুদ রহমান ও জাবেদুর রহমানকে আটক করে থানায় নিয়ে নির্যাতনের পর আবেদ মাহমুদ রহমানকে বিস্ফোরক মামলায় গ্রেপ্তার দেখিয়ে কারাগারে পাঠিয়ে দিয়েছে। একইভাবে চান্দগাঁও থানা যুবদলের যুগ্ম আহ্বায়ক এরশাদ হোসেনের বাবা আবদুর রাজ্জাক ও বড় ভাই মো. জাবেদ, ওয়ার্ড যুবদল নেতা মো. আবছারের মামা মো. মামুন, যুবদলের জিসানের বাবা মো. ইলিয়াস, মো. শাহিনের বড় ভাই মো. শামিমকে গ্রেপ্তার করেছে। যুবদল নেতা নয়ন মাহমুদকে না পেয়ে তার বৃদ্ধ বাবা মো. ইদ্রিসকে বেধড়ক মারধর করেছে পুলিশ।
নগরের তিনটি সংসদীয় আসনে প্রাপ্ত ভোটের বিশ্লেষণ করে শাহাদাত দাবি করেন, ভোট বর্জনের মাধ্যমে চট্টগ্রামবাসী নিরব প্রতিবাদ জানিয়েছে। তিনি বলেন, এ নির্বাচনে ব্যাপক অনিয়ম হয়েছে। ভোট উৎসবের পরিবর্তে চট্টগ্রামে ভোট বর্জনের এক নীরব প্রতিবাদ ফুটে উঠেছে। নগরের তিনটি আসনে প্রার্থীরা ভোটার আনার চেষ্টা করেছেন। কিন্তু সেখানে ভোট পড়েছে ২০–২৬ শতাংশ। কিন্তু সারা দেশে ভোটের হার দেখানো হয়েছে ৪১ শতাংশের বেশি। যেখানে এজেন্ট ছিল না সেখানে জাল ভোটের মহোৎসব হয়েছে। এর মাধ্যমে ভোটের কাস্টিং বাড়ানো হয়েছে। যেখানে নিজেরা নিজেরা ভোট করেছে সেখানেও ভোটের এ অবস্থা। তাতেই বোঝা যায় বিএনপি কী কারণে এ ভোট বর্জন করেছে।
এক প্রশ্নের জবাবে শাহাদত বলেন, প্রধান বিচারপতির বাসভবনে হামলার ঘটনায় বিএনপি মহাসচিব মীর্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, স্থাায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী, মীর্জা আব্বাস ও শাহজাহান ওমর গ্রেপ্তার হয়েছিল। কিন্তু সরকার শাহজাহান ওমরকে চাপ প্রয়োগ করে নির্বাচনে রাজি করিয়ে রাতারাতি বের করে আওয়ামী লীগে যোগদান করিয়েছেন। নির্বাচনে তাকে এমপিও বানানো হয়েছে। আমাদের প্রশ্ন, বিচার বিভাগ কোন দিকে ধাবিত হচ্ছে? বিচার বিভাগ একপেশে আচরণ করলে সাধারণ মানুষ কোথায় যাবে? আমাদের চাওয়া, রাষ্ট্রযন্ত্র কোন দলের নিজস্ব বাহিনীতে রূপান্তর না হয়ে যাতে তাদের কাঠামো মেনে চলে। সংবাদ সম্মেলনে স্বাগত বক্তব্য রাখেন নগর বিএনপির যুগ্ম আহ্বায়ক ইয়াছিন চৌধুরী লিটন। উপস্থিত ছিলেন কেন্দ্রীয় বিএনপির শ্রম সম্পাদক এ এম নাজিম উদ্দীন, গর বিএনপির যুগ্ম আহ্বায়ক কাজী বেলাল উদ্দিন, আবদুল মান্নান, আহ্বায়ক কমিটির সদস্য হারুন জামান, মাহবুব আলম প্রমুখ।