আটকা পড়া দুই জাহাজের কারণে ঝুঁকিতে বেড়িবাঁধ

আনোয়ারা গহিরা উপকূলে বিলীন হওয়ার পথে মসজিদ, কবরস্থান স্থানীয় অনেকে ছাড়ছেন বাপ-দাদার ভিটা

এম.নুরুল ইসলাম, আনোয়ারা | শুক্রবার , ১৩ জুন, ২০২৫ at ৫:৩৬ পূর্বাহ্ণ

আনোয়ারা গহিরা সমুদ্র উপকূলের এক কিলোমিটারেরও বেশি এলাকায় তীব্র ভাঙনের ঝুঁকি মানুষের ঘুম কেড়ে নিয়েছে। গত মাসে ঘূর্ণিঝড় ‘শক্তি’ পরবর্তী ঝড়ো হাওয়ায় উঠান মাঝির ঘাটের কাছে এসে উপকূলে আটকে যাওয়া দুটি জাহাজের কারণে স্রোতের গতিপথ বদলে ভাঙনের তীব্রতা বেড়ে গেছে। এতে ঝুঁকির মুখে পড়েছে বেড়িবাঁধ।

হুমকিতে আছে স্থানীয় জামে মসজিদ। তলিয়ে গেছে কবরস্থান ও বিদ্যুৎ সংযোগ ব্যবস্থা। আটকে পড়া জাহাজের ধাক্কায় ছিড়ে গেছে বালিভর্তি জিও ব্যাগ। এই অবস্থা চলতে থাকলে আগামী একমাসের মধ্যে মসজিদ ও কবরস্থান সম্পূর্ণ বিলীন হয়ে যেতে পারে বলে আশংকা স্থানীয়দের।

এদিকে আটকে পড়া মারমেইড৩ নামের বার্জ ও নাভিমার৩ টাগবোট জাহাজটি সরানোর বিষয়েও কোনো সুখবর নেই। বন্দর কর্তৃপক্ষের কাছে জাহাজ দুইটি গত তিন বছরের বেশি সময় ধরে জব্দ রয়েছে বলে জানা গেছে। জাহাজ দুটি বঙ্গোপসাগরে ভাসমান অবস্থায় জোয়ারভাটার স্রোতে কখনো কুতুবদিয়া, কখনো মগনামাসহ বঙ্গোপসাগরের বিভিন্ন এলাকায় ভেসে বেড়ায়। সর্বশেষ গত মাসে ঘূর্ণিঝড় ‘শক্তি’র আঘাতে গহিরা উঠান মাঝির ঘাট উপকূলে আটকে পড়ে। আর এতে কপাল পুড়েছে স্থানীয়দের। যার প্রভাবে ভাঙ্গনের তীব্রতা আগের চেয়ে আরো কয়েকগুণ বেড়েছে। বর্তমানে কোস্টগার্ড সদস্য ও বন্দর কর্তৃপক্ষের ওয়াচম্যানরা জাহাজ দুটির পাহারার দায়িত্বে রয়েছেন। স্থানীয়রা অতি দ্রুত জাহাজ দুটি সরিয়ে নেওয়ার দাবি জানিয়েছেন।

স্থানীয়রা জানান, গত মাসে ঘূর্ণিঝড় ‘শক্তি’ পরবর্তী ঝড়ো হাওয়ায় গহিরা উপকূলের উঠান মাঝির ঘাট এলাকায় মারমেইড৩ নামের একটি বার্জ ও নাভিমার৩ টাগবোট জাহাজ দুটি আটকে পড়ে। বাতাসের তীব্রতায় জাহাজ দুটি আছড়ে পড়ার সময় বেড়িবাঁধের ভাঙ্গন রোধে স্থাপিত জিও টিউবের ব্যাপক ক্ষতি হয়।

সরেজমিনে দেখা যায়, উঠান মাঝির ঘাট সংলগ্ন বেড়িবাঁধের এক কিলোমিটারের বেশি অংশজুড়ে পাথরের ব্লক নেই। কিছু কিছু অংশে ভাঙ্গন ঠেকাতে জিও ব্যাগ ও টিউব দিয়ে ঝুঁকি এড়ানোর চেষ্টা করেছে পানি উন্নয়ন বোর্ড। উঠান মাঝির ঘাটের মসজিদের অস্থায়ী বাঁধ ঘেঁষে জাহাজ আটকে যাওয়ায় সাগরের মোহনায় সৃষ্ট ঢেউ জাহাজের সাথে ধাক্কা লেগে ঘূর্ণায়মান স্রোত তৈরি করছে। এতে দ্রুতই সরে যাচ্ছে বেড়িবাঁধের গোড়ার মাটি। জোয়ারের সময় সাগরের ঢেউ এসে লাগছে স্থানীয় জামে মসজিদের দেয়ালের সাথে।

স্থানীয় বাসিন্দা ও উঠানমাঝি ঘাটের মৎস্যজীবী সংগঠনের সভাপতি মো. নাছির জানান, এক বছর আগেও এখানে সাগর ছিল ৩০০ ফুট দূরে। তীব্র স্রোত ও ভাঙ্গনে এখন তা বেড়িবাঁধে এসে ঠেকেছে। ৩৬০ পরিবারের বিশাল সমাজের শতাধিক মুসল্লি এখানে নামাজ আদায় করেন। ঘাটের মাছ ধরার মাঝিরাও এই মসজিদে নামাজ পড়েন। চোখের সামনে মসজিদটা বিলীন হওয়ার অবস্থা। বেড়িবাঁধের ভাঙ্গন বেড়ে যাওয়ায় স্থানীয় ৩৬০ পরিবারের অনেকে বাপ দাদার ভিটামাটি ছেড়ে যাচ্ছেন। দ্রুত আটকে পড়া জাহাজ দুটি সরানো না গেলে পরিস্থিতি খারাপ হবে বলে জানান তিনি।

স্থানীয় বাসিন্দা ও মৎস্যজীবী হেমন্ত জলদাস বলেন, এক দশক আগে ঘূর্ণিঝড়ে এখানে আরেকটি জাহাজ আটকা পড়েছিল। তখন তীব্র স্রোতে সাগরের গভীরতা বেড়ে যায়। বর্তমানে জাহাজ দুটি আটকে পড়ায় স্থানীয় মসজিদ কবরস্থান তলিয়ে যাচ্ছে। বেড়িবাঁধের ভাঙ্গন বেড়েছে কয়েকগুণ। যার কারণে স্থানীয়দের মাঝে বসবাসের ঝুঁকি বেড়েছে। আমরা এলাকাবাসীর পক্ষ থেকে অতি দ্রুত জাহাজ দুটি সরিয়ে নেওয়ার দাবি জানাচ্ছি।

স্থানীয় বার আউলিয়ার বাসিন্দা মাওলানা জালাল উদ্দিন বলেন, বেড়িবাঁধের কাজে অনিয়ম বন্ধ হচ্ছে না। জিও ব্যাগে বালি ভর্তি করার সময় বাঁধের গোড়া থেকে বালি তোলা হয়। এসব কারণে ভাঙ্গনের তীব্রতা বেড়ে গেছে। ’৯১ সালের পর থেকে শত শত মানুষের বসতঘর, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, মসজিদ মাদ্রাসা, কবরস্থান, দোকানপাট ও বিভিন্ন স্থাপনা, ফসলি জমি বিদ্যুতের খুঁটিসহ অনেক কিছুই সাগরের গর্ভে বিলীন হয়ে গেছে। এত কিছুর পরও উপকূলবাসী এখনো কেন টেকসই বেড়িবাঁধ পায়নি সরকারের কাছে এটাই আমার প্রশ্ন।

আটকে পড়া জাহাজের নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা কোস্টগার্ড সদস্য সত্তারুল জানান, জাহাজ দুটি আটকে পড়ার পরদিন থেকে কোস্টগার্ড সদস্যরা নিরাপত্তার দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছেন।

আটকে পড়া জাহাজে বন্দর কর্তৃপক্ষের সিকিউরিটি ওয়াচম্যান হিসাবে দায়িত্ব পালন করছেন রেজাউল। তিনি জানান, জাহাজ দুটির নিরাপত্তায় বন্দর কর্তৃপক্ষ তাদের নিয়োগ দিয়েছে। দুই শিফটে ৮ জন করে ওয়াচম্যান দায়িত্ব পালন করছেন। তিনি বলেন, জাহাজ দুটি ৩ বছর আগে বাঁশখালীর এসএস পাওয়ার প্ল্যান্টের নির্মাণ কাজের জন্য ভারত থেকে বড় পাথর নিয়ে আসত। এ সময় নাভিমার৩ টাগবোটে জ্বালানি সরবরাহ করলেও কোনো বিল দেয়নি টাগবোটটির মালিকপক্ষ। এ নিয়ে সৃষ্ট জটিলতায় তখন থেকে জাহাজ দুটি বন্দর কর্তৃপক্ষের কাছে জব্দ অবস্থায় রয়েছে। জাহাজ দুটি মহেশখালী, কুতুবদিয়া, মাতারবাড়ি উপকূলের আশপাশে রাখা হত। ঘূর্ণিঝড় ‘শক্তি’র আঘাতে জাহাজ দুটি ভেসে গহিরা উপকূলে আটকা পড়ে। এ দুটি জাহাজ কখন সরানো হবে জানি না, তবে ঈদের বন্ধের পর আগামী সপ্তাহে অফিস খুললে জাহাজ দুটির ব্যাপারে কর্তৃপক্ষ সিদ্ধান্ত নিতে পারে।

পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী শওকত ইবনে শাহীদ জানান, আনোয়ারার রায়পুর উপকূলে বেড়িবাঁধের উন্নয়ন কাজ চলমান আছে। ঝুঁকিপূর্ণ বাঁধের বিভিন্ন অংশে জিও টিউব বসানো হয়েছে। আটকে পড়া জাহাজ দুটির কারণে আমাদের স্থানীয় মসজিদ, কবরস্থান ও বেড়িবাঁধ চরম ঝুঁকিতে পড়েছে। জাহাজ দুটি যাতে দ্রুত সময়ে মধ্যে সরিয়ে নেওয়া হয় সে ব্যাপারে ঈদের ছুটির পর আমরা জাহাজ কর্তৃপক্ষের সাথে যোগাযোগ করে এ ব্যাপারে ব্যবস্থা গ্রহণ করবো।

পূর্ববর্তী নিবন্ধরাউজানে বিদেশি পিস্তলসহ গ্রেপ্তার ২
পরবর্তী নিবন্ধকালুরঘাট সেতুতে ট্রেন দুর্ঘটনা তদন্তে কমিটি গঠন ৪ রেলকর্মী বরখাস্ত