আওলাদে রাসূল রাহনুমায়ে শরীয়ত ও তরিকত আল্লামা হযরত সৈয়দ আহমদ শাহ্ ছিরিকোটি রাহমাতুল্লাহি আলায়হির সাথে ১৯২০ সালে ইঞ্জিনিয়ার আবদুল খালেকের বার্মায় মোলাকাত হয়। তখন ছিরিকোট হুজুর সেখানে একটা মসজিদে ইমামতি করতেন, যা বাঙালি মসজিদ হিসেবে খ্যাত। ১৯৪৭ সালে বস্ত্রব্যবসায়ী হালিশহর নিবাসী আবুল বশর কো–অপারেটিভ ও চিটাগাং আরবান কো– অপারেটিভের সেক্রেটারি আবদুল জলিল সহযোগে হুজুরকে চট্টগ্রাম আনেন। সে হিসেবে প্রথম খানকাহ কোহিনূর মঞ্জিল (১৯৩৮)। সেই থেকে বাংলাদেশে জামেয়া আহমদিয়া সুন্নিয়া আলিয়া’র যাত্রা শুরু। ‘আনজুমান–এ রহমানিয়া আহমদিয়া সুন্নিয়া’ উপমহাদেশের সমৃদ্ধ দ্বীনি প্রতিষ্ঠান। হযরত সৈয়দ আহমদ শাহ্ সিরিকোটি রহমাতুল্লাহি আলায়হির বাণী ছিলো, ‘মুঝে দেখনা হ্যায় তো মাদরাসাকো দেখো। পরবর্তীতে এই খানকাহ সাময়িকভাবে ঘাটফরহাদবেগস্থ বাংলাদেশ প্রেসে শিকলবাহার আব্দুল জলিল চৌধুরীর বাসভবন, বলুয়ার দিঘিরপাড়স্থ নূর মোহাম্মদ আল কাদেরির বাসভবনে স্থানান্তরিত হয়। পরে আরো বড় পরিসরে ষোলশহর জামেয়া মাদরাসা সংলগ্ন আলমগীর খানকাহ স্থাপিত হয়।
অপর এক তথ্যে জানা যায়, চট্টগ্রামের মুরীদরা, যাঁরা রেঙ্গুনে কাজের সুবাদে গিয়ে সিরিকোটি হুজুরের বিরল সাক্ষাৎ লাভ ধন্য হন এবং তাঁর হাতে বায়াত গ্রহণ করে নিজেদেরকে শরিয়ত–ত্বরিকতের এই মহা মিশনে উৎসর্গ করেছিলেন। এদের মধ্যে অধিকতর উল্লেখ যোগ্যদের মধ্যে রয়েছেন, ১৯২০ সনের প্রথম বি এস সি ইলেক্ট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার আলহাজ্ব আবদুল খালেক (পথিকৃৎ চট্টগ্রাম সংবাদপত্র শিল্প), ১৯২০ সনের অপর গ্র্যাজুয়েট মাস্টার আবদুল জলিল বিএ (রাউজান), ১৯২০ সনে এম বি ডিগ্রি অর্জন করা চিকিৎসক ডাক্তার মুজাফফরুল ইসলাম (নোয়াখালী), তফাজ্জল হক (সীতাকুণ্ড), মাস্টার আবদুল লতিফ (কাট্টলি), সুফি আবদুল গফুর (গশ্চি, রাউজান), খাদেম ফজলুর রহমান সরকার (ফটিকছড়ি), মোয়াজ্জেম হোসেন পোস্টমাস্টার সহ অনেকেই।
১৯৪৬’র ২৫ ফেব্রুয়ারি, সোমবার (২২ রবিউল আউয়াল, ১৩৬৫ হিজরি) চট্টগ্রাম থেকেই প্রকাশিত হয় সিলসিলায়ে আলীয়া কাদেরিয়ার শাজরা শরীফের প্রথম সংস্করণ। এতে পাওয়া যায়. সিরিকোটি হুজুরের এক পৃষ্ঠার একটি সংক্ষিপ্ত অসিয়তনামা। এই অসিয়ত নামার নিচে সিরিকোটি হুজুর নিজ পরিচয় দিয়েছেন ‘বান্দা সৈয়দ আহমদ, হাল সাং চট্টগ্রাম, ২২ রবিউল আউয়াল ১৩৬৫ হিজরি’। দেখা যায়, শাজরা শরীফটি প্রকাশিত হয়েছে– আনজুমান এ শূরায়ে রহমানিয়া, চট্টগ্রাম থেকে, আর মুদ্রিত হয়েছে চট্টগ্রম কোহিনূর ইলেকট্রিক প্রেস থেকে। এখানে মুদ্রিত অসিয়তনামায় হুজুর কেবলা যথাক্রমে মৌ আবদুল লতিফ (কাট্টলি), মৌ আবদুল জলিল মাস্টার বি এ (রাউজান) এবং সূফী আবদুল গফুর (গশ্চি)কে খেলাফত দানের ঘোষণা দিয়েছেন। এটির প্রাপ্তিস্থানে উল্লেখ আছে, কোহিনূর ইলেকট্রিক প্রেস, আন্দরকিল্লা, আবদুল লতিফ (কাট্টলি), আবদুল জলিল মাস্টার, ইঞ্জিনিয়ার আবদুল খালেক, সূফী আবদুল গফুর এবং সৈয়দ মুশতাক আহমদ (পাঠানটুলী) ‘র নাম।
চট্টগ্রাম সিরিকোটি হুজুর এবং আনজুমানে শূরায়ে রহমানিয়ার যাবতীয় কাজ এই সময় (দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর) থেকে ইঞ্জিনিয়ার সাহেবের আন্দরকিল্লা কোহিনূর ইলেকট্রিক প্রেসের দ্বিতীয় তলা থেকে সম্পন্ন হতো। বর্তমানে উক্ত রুমে সম্পাদক এম এ মালেক বসেন। হুজুর কেবলা ১৯৪৫–৪৬ থেকে ১৯৫৮ পর্যন্ত এখানেই থাকতেন। এর আগে হুজুর ইঞ্জিনিয়ার সাহেবের ভাড়া বাসায় (আন্দরকিল্লা নজির আহমদ চৌ: রোড), কাউলির আবদুল লতিফ সাহেবের বাড়ি, রাউজান সহ বিভিন্ন স্থানে থেকেছেন বলে জানা যায়।
প্রসঙ্গত, সিরিকোটি হুজুরের ১৯৪৯–৫০’র শীতকালীন সফর ছিল বাঁশখালিতে। হুজুরের রাতে অবস্থান হয় পুঁইছড়ি গ্রামে, তাঁরই অন্যতম খলিফা মাওলানা এজাহার আহমদ সাহেবের ঘরে। আর মাহফিলটি ছিল শেখের খিলে। তখন এই দুই গ্রাম ছিল শেখের খিল ইউনিয়নভুক্ত, (বর্তমানে পৃথক ইউনিয়ন)। যতটুকু জানা যায়, মাহফিলটি ছিল শেখেরখিল সরকার হাট বাজারে। আর এটি ছিলে আনোয়ারার বিশিষ্ট জমিদার বজলুর রহমান চৌধুরীর জামদারি ভুক্ত জায়গা। উল্লেখ্য, বজলুর রহমান চৌধুরী ছিলেন বর্তমান দৈনিক আজাদী সম্পাদক এম এ মালেক’র শ্বশুর, অর্থাৎ ইঞ্জিনিয়ার সাহেবের বেয়াই। তাঁরাও দরবারে সিরিকোটের একনিষ্ঠ মুরীদ এবং খেদমতগার ছিলেন। এই মাহফিলে সিরিকোটি হুজুরের বক্তব্যের শুরুতে কোরআনে করিমের আয়াত শরীফ—‘ইন্নাল লাহা ওয়া মালাইকাতাহু ইউসল্লুনা আলান্ নবী ইয়া আইউহাল লাগিনা আমানু সল্লু আলাইহি ওয়া সাল্লিমু তাসলিমা’– তেলাওয়াতের পর সমবেতদের নিয়ে যখনদরুদ শরীফ পড়তে শুরু করেন হুজুর, তখন যাঁরা হুজুরের সফর সঙ্গী তাঁরা ছাড়া, স্থানীয়দের একটি বড় অংশ দরুদ শরীফকে সম্মান না করে বরং বেআদবি মূলক আচরণ করতে থাকে । দরুদ শরীফের বিরুদ্ধে এমন অবমাননা আওলাদে রাসূল (সাল্লাল্লাহ আলাইহি ওয়াসাল্লাম) হয়ে তিনি কীভাবে সহ্য করবেন সেইদিন তিনি এতোটা ক্ষেপেছিলেন যে, কোথায় তাঁর নাওয়া–খাওয়া, কোথায় তাঁর বিশ্রাম–ঘুম, ছিল মুধু একটি কথা গোস্তাখ! বেআদব! ইত্যাদি। এভাবেই চলছিল লাগাতার। কেউ তাঁকে শান্ত করবে সেই সাহস হচ্ছিল না কারোও। অবশেষে একদিন তিনি নিজেই শান্ত হয়ে সবাই কে ডাকলেন, বললেন, ‘হাঁ এক মাদরাসা হো না চাহিয়ে’ – যেন তিনি সেই দিনের ঘটনার একটি খোদায়ী সমাধানের ইঙ্গিত পেয়েছেন। সবাইকে জায়গা দেখতে বলা হলো– বলা হলো, জায়গাটা এমন যেন হয়, শহর ভি নাহো, গাঁও ভি নাহো, মসজিদ ভি হ্যায়, তালাব ভি হ্যায় কেউ কেউ বলেন, তিনি নাকি আরো বলেছেন, ‘রেল লাইন ভি হ্যায়’। মনে হয়, তাঁকে এই তাৎপর্য পূর্ণ নির্দেশনার সাথে কাঙ্ক্ষিত জায়গাটির মানচিত্র, দেওয়া হয়েছে, যেমনটা ছিল খাজা বাবা রহমাতুল্লহি তা’আলা আলায়হির আজমি আগমন এবং শাহ জালাল রহমাতুল্লাহি তা’আলা আলায়হি’র আজমির আগমন এবং মাহ জালাল রহমাতুল্লাহি তা’আলা আলায়হির সিলেট আগমনের পথ ঘাট এবং নির্দিষ্ট স্থান সম্পর্কে। অবশেষে, ষোলশহর নাজির পাড়ার বর্তমান জায়গাটি দেকা মাত্রই হুজুর খুব উচ্চসিত কণ্ঠে জানান দিলেন– হুঁ হাঁ ইয়ে হ্যায়, ইয়ে জাগা হ্যায়, ইঁতা মাদরাসা হোগা! আলহামদুলিল্লাহ ।
আনজুমানে শূরায়ে রহমানিয়া (১৯২৫) — যা শতবর্ষ ঐতিহ্য ও গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাসের ধারকও বটে। আনজুমানে রহমানিয়া আহমদিয়া সুন্নিয়া কর্তৃক ১৯৫৮ সনে প্রকাশিত কার্যবিবরণী, যা ১৯৫৭ তে অডিট রিপোর্ট সহ সম্পন্ন হয়েছিল, এবং তা কোহিনুর ইলেকট্রিক প্রেস থেকে মুদ্রিত ছিল। এখানে অডিটর সাখাওয়াত হোসেন, তাঁর রিপোর্ট সম্পর্কে বলতে গিয়ে, ভাইস প্রেসিডেন্ট জনাব জয়নাল আবেদীন চৌধুরীর অনুরোধে তিনি এই দায়িত্ব পালন করেন বলে মন্তব্য করেন।
১৯৫৮ পর্যন্ত আনজুমানের কর্ণধার, সভাপতি প্রেসিডেন্ট) হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন আল্লামা সৈয্যদ আহমদ শাহ্ সিরিকোটি, সাধারণ সম্পাদক (জি এস) ছিলেন মাস্টার আবুদল জলিল বিএ, এবং অর্থ সম্পাদক (ফিন্যান্স সেক্রেটারী) ছিলেন ইঞ্জিনিয়ার আবদুল খালেক সাহেব। ১৯৫৮’র পর সিরিকোটি হুজুর আর এই দেশে আসেন নি। তিনি ২৭ এপ্রিল ১৯৬১ বৃহস্পতিবার (১১ জিলক্বদ ১৩৮০) জান্নতুল ফিরদাউসের বাসিন্দা হন। তাঁর চল্লিশা অনুষ্ঠান উপলক্ষে গাউসে জামান তৈয়্যব শাহ্ হুজুরের চট্টগ্রাম আগমন হয়। তিনি এখন থেকে (২৭ এপ্রিল ১৯৬১ হতে ৭ জুন ১৯৯৩ পর্যন্ত)- আনজুমানের একজন সুযোগ্য সভাপতি, সিলসিলাহর প্রধান কাণ্ডারী, এবং দরবারে সিরিকোটের সাজ্জাদানশীল হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।
পাকিস্তান আমলের শেষ সময়ে ১৯,২০,২১, জানুয়ারি ১৯৭০ (১০,১১,১২ জিলক্বদ ১৩৮৯) চট্টগ্রাম জামেয়া আহমদিয়া সুন্নিয়া আলীয়ার ১৪তম বার্ষিক সভা এবং শাহানশাহে সিরিকোট রহমাতুল্লাহি তা’আলা আলায়হি’র ৯ম বার্ষিক ওরস শরীফ উপলক্ষে জামেয়া ময়দানে অনুষ্ঠিত তিন দিনব্যাপী অনুষ্ঠানের সভাপতিত্ব করেন তৈয়্যব শাহ্ হুজুর। আনজুমানের তৎকালীন সাধারণ সম্পাদক (জিএস) ছিলেন আলহাজ্ব আবু মোহম্মদ তবিবুল আলম, তিনি আনজুমান এবং মাদরাসা পরিচালনা কমিটির পক্ষে সেই সময়ে একটি মুদ্রিত দাওয়াত নামা প্রচার করেছিলেন। তাঁর নিবেদনে প্রকাশিত এই প্রচার পত্র (হ্যান্ডবিল) থেকে তা জানা যায়। এটি মুদ্রিত হয়েছিলো কোহিনূর ইলেকট্রিক প্রেস চট্টগ্রাম থেকে। কোহিনুর ইলেকট্রিক প্রেসের প্রতিষ্ঠাতা বায়ান্নের ভাষা আন্দোলনের প্রথম কবিতা ‘কাঁদতে আসিনি ফাঁসির দাবী নিয়ে এসেছি’ মুদ্রণের সাহস দেখিয়েছিলেন। তেমনি ‘আজাদী’ পত্রিকার প্রকাশ ও সম্পাদনা করছেন। অপরদিকে ধর্মাচারী হিসেবে সুন্নিয়তের খেদমত করে গেছেন। কোহিনূর হলেকট্রিক প্রেস হুজুরের অবস্থানের কক্ষকে সুন্নিয়তের হেরিটেজ হিসেবে সংরক্ষণ করার প্রস্তাব করছি। সম্ভবত মোহাম্মদ আবদুল মালেক এর নাম হুজুর রেখেছেন। তদীয় পুত্র ওয়াহিদ মালেক আঞ্জুমান ট্রাস্টের বর্তমান সদস্য। পরম করুণাময় এই খেদমত জারি রাখুন। লেখক: কবি, প্রাবন্ধিক, নাট্যকার।