আঞ্চলিক গানের সম্রাট শ্যামসুন্দর বৈষ্ণব

নাসির উদ্দিন হায়দার | বৃহস্পতিবার , ৪ ডিসেম্বর, ২০২৫ at ৪:৫১ পূর্বাহ্ণ

শ্যামসুন্দর বৈষ্ণব চট্টগ্রামের আঞ্চলিক গানের মুকুটহীন সম্রাট। টানা তিন দশক তিনি শিল্পী শেফালী ঘোষের সঙ্গে জুটি বেঁধে গান গেয়েছেন, এই জুটি আমাদের আঞ্চলিক গানকে বিশ্ব দরবারে পৌঁছে দিয়েছেন। শ্যাম একাধারে গীতিকার, সুরকার ও শিল্পী। কবিয়াল রমেশ শীলের এই ভাবশিষ্য তার জাদুমাখা কণ্ঠে উন্মাতাল করেছেন সোনার বাংলার মানুষকে, সুরের খেয়ায় ভেসে গেয়েছেন জীবনজয়ের গান। আজ ৪ ডিসেম্বর এই কালজয়ী শিল্পীর ২৫তম মৃত্যুবার্ষিকী। মহাপ্রয়াণ দিবসে তার প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা।

শ্যামসুন্দর বৈষ্ণবের জন্ম ১৯২৭ সালে, হাটাহাজারীর ফতেয়াবাদ গ্রামে। বাবা জয়দাসই ছিলেন সংগীতে শ্যামের প্রথম শিক্ষাগুরু। পড়াশোনা বেশি ছিল না, তবে ছোটবেলা থেকেই গান গাইতেন। স্মর্তব্য যে, ছোটবেলা থেকেই শ্যামের একটা স্বতন্ত্র ভঙ্গি ছিল, তিনি গান গাওয়ার সময় ‘ভিংচা’র মতো অভিনয় করতেন। সেই অঙ্গভঙ্গি দর্শকদের মধ্যে ব্যাপক জনপ্রিয়তা পায়।

১৯৯৬ সালে মাসিক সরগমে (নভেম্বর সংখ্যা) এক সাক্ষাৎকারে শ্যামসুন্দর বৈষ্ণব তার ছোটবেলা সম্পর্কে বলেন, ‘ছোটবেলায় সর্দার প্রকৃতির ছিলাম। স্কুলে যাওয়ার সময় আমার বইপত্র বহন করতো অন্য ছেলেরা আর আমি সবার আগে হাঁটতাম। মানুষের গাছের ডাব, পুকুর থেকে লুকিয়ে মাছ ধরা ইত্যাদিতে নেতৃত্ব দিতাম। খেলাধুলায় আমার ছিল অগ্রাধিকার।’

গানবাজনা সম্পর্কে বলেন, গান ছিল তার প্রাণ বিশেষ করে কৈশোরে। স্কুল ছুটি শেষে কবিয়াল রমেশ শীলের গান গাইতেন, রেললাইনের ধারে বসে পাথর বাজিয়ে। মূলত সংগীতে শ্যামসুন্দর ছিলেন রমেশ শীলের ভাবশিষ্য।

১৯৪৭ সালে জীবিকার তাগিদে শ্যামসুন্দর বৈষ্ণব চট্টগ্রাম শহরে আসেন। শ্যাম আসলে ভাগ্যবান, কারণ জীবনের প্রথম কাজটা তিনি পেয়েছিলেন বিখ্যাত আর্ট প্রেসে। সৈয়দ মোহাম্মদ শফির মালিকানাধীন আর্টপ্রেস তখন সুপ্রতিষ্ঠিত প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান। সেখানে শ্যাম সহকর্মী ও বন্ধু হিসাবে পেয়েছিলেন কবি আল মাহমুদকে। কাজের অবসরে তিনি নীরদ বরণ বড়ুয়ার মতো ওস্তাদের কাছে তালিম নেন।

মানুষের জীবনে প্রতিষ্ঠার পেছনে একসময় কেউ না কেউ সূত্রধর বা ত্রাতা হিসাবে আসেন, শ্যামের জীবনে এসছিলেন আর্ট প্রেসের শফি সাহেব। দুপুরে শফির বাসায় গান করতেন শ্যাম, শফি সাহেব গুণী মানুষ, তাই গুণীর কদর বুঝতে তার সমস্যা হয়নি। সংগীতে শ্যামের আগ্রহ ও প্রতিভা দেখে তাকে চট্টগ্রাম বেতারের তখনকার আরডি (আঞ্চলিক পরিচালক) আশরাফুজ্জামানের সাথে পরিচয় করিয়ে দেন শফি সাহেব। কপাল খুলে গেল শ্যামের, প্রথমবারেই বেতারে গান করার সুযোগ পেলেন তিনি। বেতারে শ্যামের প্রথম গান ছিল অচিন্ত্যকুমার চক্রবর্তীর কথা ও সুরে ‘গুরা বউ বউরে, সন্ধ্যাকালে চেরাগ দিতে গেল্‌’।

সম্ভবত ১৯৬৩ সালে বেতারে শ্যামের কণ্ঠে গানটি প্রচারিত হয়েছিল এবং দারুণ জনপ্রিয় হয়েছিল। ফলে শ্যামকে আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। পরে নিউমার্কেটে শ্যাম ছোটখাটো একাট দোকান দিয়েছিলেন। সেখানে সংগীত জগতের ছোটবড় অনেকেই আসতেন। শিল্পী হিসাবে প্রতিষ্ঠার পেছনে সেই দোকান একটা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিল। ‘শ্যামশেফালী’ জুটির উত্থান যে দ্বৈত গানটি দিয়ে সেটির স্রষ্টা আবদুল গফুর হালী। এই ছোট্ট দোকানেই বসে শ্যাম আর গফুর, দুই বন্ধু চিরসবুজ এই গানটির জয়যাত্রায় শামিল হয়েছিলেন।

শ্যামসুন্দর বৈষ্ণব শুধু গাইতেন না, গান লিখতেন সুরও করতেন। কল্যাণী ঘোষের সংকলন ও সম্পাদনায় বাংলা একাডেমী থেকে প্রকাশিত চট্টগ্রামের আঞ্চলিক গান বইয়ে শ্যামসুন্দরের ১৬টি আঞ্চলিক গান সংকলিত হয়েছে। অনেক গান হয়তো হারিয়ে গেছে, কিংবা আমাদের অগোচরে রয়েছে।

শ্যাম কিন্তু নোয়াখালীর আঞ্চলিক গানেরও অন্যতম স্থপতি। এই অঞ্চলের গান হিসাবে তার প্রথম সৃষ্টি ‘বাইছা দুমরি আইয়েন দুমরি আইয়েন/ রেলে ফুত কইরছে’। এই গান এখনো অসম্ভব জনপ্রিয় নোয়াখালী অঞ্চলে। এছাড়াও ‘দেশে গেলে কইয়েন গো বাইছা/চাডিগাঁয়ে চাকরি একখান হাইছি’, ‘ওরে বেয়াইনরে ক্যানে আইলেন আউঙ্গ বাড়ি এতদিন হরে’, সুপারডুপার হিট। তবে একক গানে শ্যামসুন্দরের চিরসবুজ গান হলো ‘ও জেডা ফইরার বাপ/একদিন বুঝিবা জেডা/একদিন বুঝিবা…’ (গীতিকার ও সুরকার সৈয়দ মহিউদ্দিন)। শ্যামসুন্দরের মতো এমন দরাজ গলার শিল্পী চট্টগ্রাম খুব একটা দেখেনি। শ্যামসুন্দর বৈষ্ণব মারা যান ২০০০ সালের ৪ ডিসেম্বর।

অবিস্মরণীয় জুটি : ’৬০৮০ এর দশক পর্যন্ত চট্টগ্রামে আঞ্চলিক গানের জনপ্রিয় শিল্পী ছিলেন শেফালী ঘোষ, শ্যামসুন্দর বৈষ্ণব, এমএন আখতার, এম এর রশিদ কাওয়াল, আবদুল গফুর হালী, মিয়া মোহাম্মদ বদরদ্দিন, লক্ষীপদ আচার্য্য, সঞ্জিত আচার্য্য, কল্যাণী ঘোষ, কান্তা নন্দী, শিল্পী রাণী, আহমদ কবির আজাদ ও বুলবুল আকতারসহ অনেকে। তারও আগে আস্কর আলী পণ্ডিত, খায়রুজ্জামা পণ্ডিত, মোহাম্মদ নাসির, মোহাম্মদ হারুন, মলয় ঘোষ দস্তিদারসহ অনেকে আঞ্চলিক গানের ঝাণ্ডা উড়িয়েছেন।

১৯৬৪ সালে চট্টগ্রাম বেতারের সমপ্রচার কেন্দ্র কালুরঘাট থেকে আগ্রাবাদে স্থানান্তর হয়। ওই সময় কোনো একদিন আঞ্চলিক গানের কিংবদন্তী শিল্পী, গীতিকার ও সুরকার মলয় ঘোষ দস্তিদার তার কথা ও সুরে দ্বৈতকণ্ঠের একটি আঞ্চলিক গান আরডি আশরাফুজ্জামানকে দেন। ওই গানিট আরডি শেফালী ঘোষ ও শ্যামসুন্দরকে দিয়ে রেকর্ড করে প্রচার করেন। ওই গান গেয়ে শ্যামশেফালী জুটি দর্শকের ব্যাপক সাড়া পায়। আর সেই গানটি হলো ‘নাইয়র গেলে বাপর বাড়ি আইস্য তরাতরি’।

কাছাকছি সময়ে আশরাফুজ্জমানেরই চেষ্টায় শ্যামশেফালী জুটির আরেকটি দ্বৈতকণ্ঠের আঞ্চলিক গান বেতারে প্রচার হয়। সে গানটি ছিল আবদুল গফুর হালীর ‘ন যাইও ন যাইও আঁরে ফেলাই বাপর বাড়িত ন যাইও।’ সম্ভবত শ্যামশেফালীর প্রথম দ্বৈতকণ্ঠের গানটির সাফল্য গফুরকে উৎসাহিত করেছিল। মলয় ঘোষের গানটি শ্যামশেফালী জুটিকে প্রতিষ্ঠিত করলে গফুর হালীর গানটি এই জুটিকে দর্শকদের হৃদয়ের কাছাকাছি নিয়ে যায়। এরপর আর এই জুটিকে আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। তাদের জন্য একের পর এক একক ও দ্বৈতকণ্ঠের গান লিখেছেন এমএন আখতার, গফুর হালী, লক্ষীপদ আচার্য, কবিয়াল ইয়াকুব আলী, সঞ্জিত আচার্য ও সৈয়দ মহিউদ্দিন। কিছু গান তৈরি করেছেন শ্যামসুন্দর বৈষ্ণব নিজেই।

শ্যামসুন্দর বৈষ্ণব ও শেফালী ঘোষ, চট্টগ্রামের আঞ্চলিক গানের অবিস্মরণীয় জুটি। প্রায় তিন যুগ স্থায়ী কালজয়ী এই জুটি অসংখ্য চিরসবুজ গান উপহার দিয়েছে। তার মধ্যে উল্লেখ্য ‘বন্ধু আঁর দুয়ারদি যঅ’, ‘তুঁই যাইবা সোনাদিয়া বন্ধু’, ‘বানুরে…’, ‘আঁরে হত ভারাইবা’, ‘নঅ যাইও নঅ যাইও আঁরে ফেলাই বাপর বাড়িত নঅ যাইও’, ‘রেঙ্গুইন্যা সুন্দরী’, ‘বাইক্যা টিয়া দে’, ‘আঁর বউয়েরে আঁই কিলাইয়ুম আঁই হাবাইয়ুম’। ২০০৮ সালে সরকার কালজয়ী দুই শিল্পীকে একুশে পদক দেয়। চট্টগ্রামের আঞ্চলিক গানে শ্যামসুন্দর বৈষ্ণবের মতো আরেকজন শিল্পীর জন্য কান পেতে রই, তারা হয়তো উঠে আসবে মাটির গভীর থেকেই, তাদের বিচরণ হবে আকাশ সংস্কৃতির অন্তর্জালে।

লেখক : সাংবাদিক ও লোকসংগীত গবেষক।

পূর্ববর্তী নিবন্ধবাবা, তোমার সন্তানরা আজও তোমার জন্য কাঁদে
পরবর্তী নিবন্ধনতুন সিনেমায় অপু, সঙ্গী আদর আজাদ