আজ রূপসী বাংলার কবির ৬৬তম প্রয়াণ দিবস

| বুধবার , ২২ অক্টোবর, ২০২৫ at ১২:৪৭ অপরাহ্ণ

রূপসী বাংলার কবি জীবনানন্দ দাশ: এক নির্জনতম যাত্রা
বাংলা সাহিত্যের এক উজ্জ্বল নক্ষত্র জীবনানন্দ দাশ (ডাক নাম: মিলু) যিনি বাংলার পাঠক মহলে ‘রূপসী বাংলার কবি’ হিসেবে সমধিক পরিচিত। আজ, ২২ অক্টোবর, এই মহান কবির ৬৬তম প্রয়াণ দিবস। বরিশালের কীওনখোলা নদীর তীরে জন্ম নেওয়া এই কবি তাঁর কবিতায় গ্রামবাংলার অপরূপ সৌন্দর্য ও প্রকৃতির রূপ-লাবণ্যকে এমন এক ভিন্ন মাত্রায় তুলে ধরেছেন যে, অন্য কোনো কবির পক্ষে তার সমকক্ষ হওয়া কঠিন। এজন্যই তাঁকে ‘প্রকৃতি প্রেমিক কবি’ বা ‘বনলতা সেনের কবি’ নামেও ডাকা হয়।

সাহিত্যিক অভিধা ও অমর সৃষ্টি
জীবনানন্দ দাশকে তাঁর স্বাতন্ত্র্য ও গভীরতার জন্য সাহিত্য সমালোচকরা বিভিন্ন বিশেষণে ভূষিত করেছেন। কবি বুদ্ধদেব বসু তাঁকে ‘নির্জনতম কবি’ এবং অন্নদাশংকর রায় ‘শুদ্ধতম কবি’ হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। তবে, ‘রূপসী বাংলার কবি’ হিসেবেই তিনি বাংলা সাহিত্যে চিরস্মরণীয়। তাঁর কালজয়ী সৃষ্টি ‘বনলতা সেন’ কবিতাটি বাংলা ভাষার অন্যতম জনপ্রিয় কবিতা, যা তাঁকে বিশ্ব দরবারে পরিচিত করেছে। এই কবিতার বিখ্যাত লাইন— “হাজার বছর ধরে আমি পথ হাঁটিতেছি পৃথিবীর পথে…”— যেন তাঁর কাব্যিক যাত্রারই প্রতিধ্বনি।

পারিবারিক প্রভাব ও কাব্যযাত্রা
জীবনানন্দ দাশের মা কুসুমকুমারী দাশও ছিলেন একজন কবি। মায়ের কবিতা, যেমন— “আমাদের দেশে হবে সেই ছেলে কবে/ কথায় না বড় হয়ে কাজে বড় হবে”— তাঁকে শৈশব থেকেই লেখালেখিতে অনুপ্রাণিত করে। ১৯১৯ সালে ‘বর্ষা আবাহন’ কবিতা প্রকাশের মাধ্যমে তাঁর সাহিত্য জীবনের সূচনা। ইংরেজি সাহিত্যে কলকাতার প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে উচ্চশিক্ষা লাভ করলেও, তিনি অমরত্ব পেয়েছেন বাংলা কাব্যে। ১৯২৭ সালে তাঁর প্রথম প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ ‘ঝরা পালক’ বাংলা সাহিত্যকে এক নতুন পথের দিশা দেয়। জীবদ্দশায় প্রকাশিত তাঁর উল্লেখযোগ্য কাব্যগ্রন্থগুলো হলো: ‘ধূসর পান্ডুলিপি’, ‘বনলতা সেন’, ‘মহা পৃথিবী’, ‘সাতটি তারার তিমির’ এবং ‘জীবনানন্দ দাশের শ্রেষ্ট কবিতা’।

সংগ্রামমুখর জীবন ও পেশাগত অস্থিরতা
উচ্চশিক্ষার পর অধ্যাপনাকেই পেশা হিসেবে বেছে নেন জীবনানন্দ দাশ। কিন্তু ভাগ্য তাঁর প্রতি সহায় ছিল না। কলকাতার সিটি কলেজ, দিল্লির রামযশ কলেজ, বাগেরহাটের প্রফুল্ল চন্দ্র কলেজ ও বরিশালের ব্রজমোহন কলেজে শিক্ষকতা করলেও কোথাও তাঁর স্থায়ী চাকরি হয়নি। শিক্ষকতা জীবনের পাশাপাশি তাঁকে বেকারত্বের কঠিন দিন দেখতে হয়েছে, গৃহশিক্ষকতা করতে হয়েছে, এমনকি বীমা কোম্পানির এজেন্ট হিসেবে কাজ করা বা ব্যবসায় লোকসানের মতো সংগ্রামও করতে হয়েছে। লাবণ্য দেবীর সঙ্গে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হওয়ার পরও তাঁকে দীর্ঘ সময় ধরে আর্থিক ও পেশাগত অস্থিরতার মুখোমুখি হতে হয়েছে। একসময় তিনি কলকাতার দৈনিক স্বরাজ পত্রিকার সাহিত্য পাতা সম্পাদনার কাজও করেন।

অন্যান্য রচনা ও মরণোত্তর স্বীকৃতি
যদিও তিনি মূলত কবি হিসেবেই সমাদৃত, জীবনানন্দ দাশ কবিতা ছাড়াও অসংখ্য প্রবন্ধ, গল্প ও উপন্যাস রচনা করেছেন। তিনি প্রায় সাড়ে আটশরও বেশি কবিতা লিখেছিলেন, যার মধ্যে জীবদ্দশায় মাত্র ২৬২টি বিভিন্ন সংকলনে প্রকাশিত হয়েছিল। তাঁর প্রবন্ধের সংকলন ‘কবিতার কথা’ তাঁর মৃত্যুর পর প্রকাশিত হয়। একইভাবে, তাঁর উপন্যাস ও ছোটগল্পের অধিকাংশই জীবদ্দশায় অপ্রকাশিত ছিল। তাঁর বহুল পঠিত উপন্যাসের নাম ‘মাল্যবান’।

জীবদ্দশায় তিনি খুব সামান্যই খ্যাতি বা জনপ্রিয়তা পেয়েছিলেন। ১৯৫৪ সালের ১৪ অক্টোবর কলকাতার বালিগঞ্জে ট্রাম দূর্ঘটনার শিকার হয়ে হাসপাতালে আট দিন মৃত্যুর সঙ্গে লড়াই করে ২২ অক্টোবর তিনি পরলোকগমন করেন।

জীবনানন্দ দাশের খ্যাতি, সুনাম, ও জনপ্রিয়তা শুরু হয় তাঁর মৃত্যুর পর। বাংলা সাহিত্যকে তাঁর অমূল্য অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ তাঁর মৃত্যুর পর ‘জীবনানন্দ দাশের শ্রেষ্ঠ কবিতা’ বইটির জন্য তিনি ‘সাহিত্য আকাদেমি পুরস্কার’ লাভ করেন। আজ তাঁর জীবন ও কর্ম নিয়ে দেশে-বিদেশে গবেষণা হচ্ছে এবং তাঁর কবিতা ইংরেজি ও ফরাসিসহ একাধিক ইউরোপীয় ভাষায় অনূদিত হয়েছে। রূপসী বাংলার এই কবি আজও তাঁর কবিতার ফেরিওয়ালা হয়ে ধানসিঁড়িটির তীরে বার বার ফিরে আসেন।

পূর্ববর্তী নিবন্ধ১৫ সেনা কর্মকর্তাকে গ্রেপ্তার দেখিয়ে কারাগারে পাঠালেন ট্রাইব্যুনাল
পরবর্তী নিবন্ধরাঙ্গুনিয়ায় নানার বাড়ির ভবনের কার্ণিশে মিলল স্কুল ছাত্রের লাশ