বাবা বসে টিভিতে আইপিএল খেলা দেখছে। আমি চা নিয়ে ঢুকেছি রুমে। বাবা বললেন, ‘জানিস টিংকু, আজ একটা আশ্চর্যজনক ঘটনা ঘটেছে। অস্ট্রেলিয়ার এক প্লেয়ার (সম্ভবত ডেভিড ওয়ার্ণার) ওর পরিবার নিয়ে গেছে মনে হয় খেলা দেখতে এবার। ওর তিন মেয়ে আর বৌ একটা রুমে বসেছে। হঠাৎ ক্যামেরাতে দেখা গেলো বাচ্চা মেয়েটা আমার দিকে তাকিয়ে হাত তুলে হাসছে। আমিও হাত নাড়িয়ে সাড়া দেই। তুই বিশ্বাস করবি না, মেয়েটা খুশি হয়ে দু’হাত নাড়িয়ে নাড়িয়ে আনন্দ প্রকাশ করছিল। আমিও হাত নাড়িয়ে যাচ্ছিলাম। আমার মনটা আনন্দে ভরে গেছে। ভাবছি কি আশ্চর্য্য! টিভির মাধ্যমে কিভাবে ডাইরেক্ট ইন্টোরাঙন হলো! কোথায় চলে গেছে প্রযুক্তি! এর আগে কোন এক অনুষ্ঠানে অমিতাভ বচ্চন ধোনি’র সাথে কথা বলছিল। আমার দিকে তাকাতেই আমি হাত তুলে ‘ভি’ দেখাই, সাথে সাথে ধ্বনিও হাত তুলে আমাকে ‘ভি’ দেখায়। অবিশ্বাস্য!”
তারও আগে গাভাস্কার প্লেয়ার নিয়ে বাসে ওঠার সময় হঠাৎ বাবার দিকে নজর পড়ে যাওয়াতে, গাভাস্কার সব প্লেয়ারদের ডেকে বাবাকে দেখায়, তখন সবাই মিলে হাত নাড়াতে থাকে, বাবাও খুশি হয়ে হাত নাড়িয়ে সম্ভাষণ জানায়। ওরা বাসে উঠে যায় -আমি একটু অবাক হয়ে বাবার দিকে তাকিয়েছিলাম আর ভাবছিলাম, কিছুক্ষণ ভুল ভাঙাবার বৃথা চেষ্টা করে ক্ষান্ত দেই। কিন্তু ভুল ভাঙাবার আর দুঃসাহস করিনি। বাবা খুব সেন্টিমেন্টাল। এখন মাঝে মাঝে কোন যুক্তিই মানতে চায় না।
বাবার কথা শুনে আমার মনে হচ্ছিল, আজ হয়তো বাবার কথাটা অবাস্তব মনে হচ্ছে, কিন্তু একদিন এমনটা হতেও তো পারে! আবার এও ভাবছি, প্রযুক্তি যেভাবে এগুচ্ছে হয়তো বা সত্যি হবে একদিন বাবার এ ধারণা! তখন তো আর যেন তেন ম্যাঙি বা ড্রেস পরে টিভি লাইভ প্রোগ্রামগুলো দেখা যাবেনা! টিভি দেখতে হলে রেডি হয়ে বসতে হবে। কারণ টিভি’র লাইভ অনুষ্ঠানগুলোতে যারা থাকবেন, দর্শকদেরও তো দেখতে পাবেন তারা! কোনদিন কি কল্পনাও করেছি যে পৃথিবী হাতের মুঠোয় পেয়ে যাবো! স্বপ্নেও ভাবতে পেরেছি যে আঙুলের আলতো ছোঁয়ায় জানতে পারবো সকল অজানা তথ্য, দেখতে চাইলে দেখতেও পাবো, শুনতে চাইলে শুনতেও পারবো! প্রযুক্তি কতটা এগিয়েছে ভাবতেই অবাক হতে হয়।
মনে হয় এদিনের কথা, মামা ঢাকা যাওয়ার সময় মা’ বারবার বলে দিতেন গিয়ে সাথে সাথে পৌঁছার সংবাদ দেয়ার কথা চিঠির মাধ্যমে। চিঠি না পেলে উতলা হয়ে উঠতো সবাই। সময় করে চিঠি লিখে খবরাখবর জানানো একটা কর্তব্য ছিল। নববর্ষে, বিজয়াতে প্রণাম জানিয়ে দূরে থাকা গুরুজনের চিঠি লিখা ছোটদের দায়িত্ব ছিল। চিঠির জবাব এলে সবাই জানতে চাইতো, ‘আমার কথা কি লিখেছে’? নিজের কথা একটু লিখলে মনে অপার আনন্দ হতো। নির্মল আনন্দে মন ভরে উঠতো। পিওনকে দেখলেই চিঠির আশায় তাকাতাম তার দিকে। আর এখন বলে থাকি, ‘পৌঁছে একটা ফোন করিস’। দূরের মানুষগুলোর চিঠি ছুঁয়ে তাদের পরশ পাওয়ার জন্য মন আকুল হয়ে থাকতো। আগে দূরে থাকা স্বজনদের দেখার জন্য মনে যে আকুলতা থাকত, এখন ভিডিও সে আকুলতাকে নির্মূলে ধ্বংস করেছে, কমিয়েছে সম্পর্কের গভীরতা।
পেন-ফ্রেন্ডের কথা চাপা পড়ে গেছে অনলাইন ফ্রেন্ডের স্তুপে! ফোনের সংখ্যা ছিল অনেক কম। পাড়ায় একজনের বাসায় ফোন থাকলে, পাড়া-পড়শীর প্রয়োজনে ওই ফোন কাজে লাগতো। কয়েক বছর আগেও টিএন্ড টি’র একটা লাইন বাসায় আনতে প্রায় ৪০-৫০হাজার টাকা খরচ হতো, লাইন পেতেও সময় লেগে যেতো মাসের পর মাস। এখন! বাড়ির ফোনের প্রয়োজনীয়তা ফুরিয়েছে কারণ হাতে হাতে আছে মোবাইল। বছর চলে যায়, একটা ক্রিং ক্রিং আওয়াজও শোনা যায় না।
এরপর ধীরে ধীরে এলো, টিভি, টাইপরাইটার, টেলেক্স, ফ্যাক্স, সর্বোপরি মোবাইল, কম্পিউটার, ল্যাপটপ আরও কত কি –
আমার এখনও মনে আছে প্রথম যখন ডিস এন্টেনা দিয়ে টিভি’তে ইন্ডিয়ান চ্যানেল দেখেছিলাম-বাসা দোতলায়, এ্যান্টেনা ছিল চারতলার ছাদে। একজন দাঁড়াতাম টিভি’র সামনে, একজন নীচে, একজন ছাদের কিনারায়, আরেকজন বাঁশের আগায় লাগানো এ্যান্টেনা একটু একটু করে ঘুরিয়ে জিজ্ঞাসা করতো, দেখা যায়? ছাদের কিনারায় যে দাঁড়িয়ে থাকতো, সে প্রশ্নটা রিপিট করতো নীচে দাঁড়ানো জনের উদ্দেশ্য, তারপর নীচের জন বারান্দায় দাঁড়ানো জনকে, বারান্দার জন প্রশ্নটা ছুঁড়ে দিত যে টিভি’র সামনে দাঁড়ানো তাকে। ‘দেখা যাচ্ছে না বা দেখা যাচ্ছে’ জবাবটাও তেমনি টিভি’র সামনে থেকে বারান্দা, বারান্দা থেকে নীচে, নীচ থেকে ছাদের কিনারা, ফাইনালি পৌঁছাতো এ্যান্টেনা যে ঘুরাচ্ছে তার কাছে। রোদে পুড়ে এভাবে ঘন্টা কাজ করার পর একটু ছায়া ছায়া দেখা গেলেও এঙাইটেট হয়ে লাফিয়ে উঠতাম ‘দেখা যাচ্ছে…দেখা যাচ্ছে’।
প্রথম যখন অফিসে কাজ করি ফোনের পর ফ্যাঙ পেলাম। হাতে লিখে কাগজটা ফ্যাঙ মেশিনের একদিকে ঢুকিয়ে দিলে অন্যদিকে অন্যদেশে সাথে সাথে পৌঁছে ছাপা হয়ে বের হতো। সত্যিই অবাক হয়ে যেতাম দেখে। তবে বিদেশে ফ্যাঙ পাঠাতে হলে আইএসডি ফোন ব্যবহার করতে হতো। লাইন পেতে খুব কষ্ট হতো, খরচও ছিল অনেক বেশী।
হাতের লিখা পড়ার বিড়ম্বনা এড়াতে রাখা হয় একজন টাইপিস্ট আর একটা টাইপরাইটার মেশিন। আমরা হাতে লিখে কাগজটা টাইপিস্টকে দিয়ে টাইপ করিয়ে ফ্যাঙ করতাম। পরে তা রেফারেন্স নাম্বার দিয়ে ফাইল করা হতো। সাধারণ টাইপরাইটার যে চালায় সে বলতে পারে হাতে কতটা জোড় দিতে হতো টাইপ করতে। পরে আসে ইলেক্ট্রিক টাইপরাইটার যা তুলনামূলকভাবে সফ্টহাতে টাইপ করা যেত। সবাই বেশ খুশি, টাইপিস্ট তাড়াতাড়ি টাইপ করে দিতে পারে। আজকে বসে ভাবলে মনে হয় এই তো ফ্যাঙ এ লাইন না পাওয়ায় অনেক সময় কাউকে কাউকে রাত কাটাতে হয়েছে অফিসে এই এর ফ্যাঙ পাঠাতে। ফ্যাঙের আবার একটা অসুবিধা ছিল ফাইলে রাখা ফ্যাঙ পেপার কিছুদিন পর সাদা হয়ে যেতো, অর্থাৎ লেখাগুলো ভ্যানিস হয়ে যেতো। তাই যে ফ্যাঙগুলো আসতো তা আবার ফটোকপি করে ফাইল করতে হতো রেকর্ড যাতে মুছে না যায়। যাইহোক এর পরবর্তীতে আসে কম্পিউটার। সারা অফিসে ওই একটা কম্পিউটার, এলো ইন্টারনেট, রাখা হয় একজন কম্পিউটার অপারেটর।
এদিনের কথা- হাত দেয়া মানা কম্পিউটারে অন্য কারো। প্রসেস ওইটাই থাকলো, আমরা লিখে দিলে কম্পিউটারে অপারেটর টাইপ করে আমাদের দেখিয়ে তা ই’মেইলে পাঠিয়ে দিত। নেটের সমস্যা লেগেই থাকতো, লাইন পাওয়া যেত না সহজে। ধীরে ধীরে ইন্টারনেট শক্তিশালী হলো। একটা দুটো করে অফিসে সবার হাতে কম্পিউটার এলো। কোনরকম প্রশিক্ষণ ছাড়াই ঘাঁটাঘাঁটি করতে করতেই কম্পিউটারের ব্যবহার শিখে গেলাম।এখন তো হাতে হাতে ছোট্ট বাঙটাই পৃথিবী। হেন কাজ নেই যা এই ছোট বাঙে করা যায় না।এক কথায় মুঠোয় পুরো পৃথিবী।
লেখক : প্রাবন্ধিক, গল্পকার