আজ জাতীয় চা দিবস : সমৃদ্ধ হোক চা শিল্প

আমিনুর রশীদ কাদেরী | শনিবার , ৪ জুন, ২০২২ at ৫:০১ পূর্বাহ্ণ

এবার একটু আগে এসেছে মৌসুমের বহু প্রতিক্ষিত রিমঝিম বৃষ্টি। মৌসুমী বৃষ্টির ফোটায় ফোটায় সিক্ত হয় চায়ের পাতা; বের হয় নতুন কুঁড়ি। ‘দুটি পাতা একটি কুঁড়ি’ চয়নে নেমে যায় চা কন্যারা। ঝুড়ি ভর্তি পাতা ধাপে ধাপে প্রক্রিয়াজাত করে সবুজ পাতায় তৈরি হয় সৌরভময় রঙিন চা। বাংলাদেশ চা বোর্ডের পরিসংখ্যান অনুযায়ী দৈনিক দশ কোটি চল্লিশ লক্ষ চায়ের কাপে চুমুক দেয় বাংলাদেশের নাগরিক। কুঁড়েঘর পেরিয়ে বঙ্গভবন; ক্লান্তিনাশা চায়ের কাপে সর্বত্রই নান্দনিক চুম্বন। প্রতি কাপ চায়ের জন্য একজন চা কন্যাকে বারো থেকে পনেরো গ্রাম সবুজ পাতা চয়ন করতে হয়। গত মৌসুমে (২০২০) করোনা লক ডাউনে বাংলাদেশে চা উৎপাদন ব্যাহত হয়েছে। আগের মৌসুমে ২০১৯ উৎপাদিত চায়ের পরিমাণ ছিল নয় কোটি ষাট লক্ষ কেজি। এবারও বিশ্বব্যাপী করোনার ছোবল, দীর্ঘ মেয়াদী খরা, অনাবৃষ্টি। বৃষ্টিপাত রেকর্ডে দেখা যায় গত অক্টোবরে বৃষ্টিপাতের পর সুদীর্ঘ সময়ের পর কাপ্তাই রাঙ্গামাটি ও চট্টগ্রামে বৃষ্টির দেখা মিলেছে। এ রকম দীর্ঘ খরা ১৯৯১ সালে একবার হয়েছিল। বৃষ্টির সাথে ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাসে উপকুলীয় অঞ্চল ভেসে গিয়েছিল ২৯ এপ্রিল ১৯৯১ সালে। এবারও দীর্ঘ অনাবৃষ্টি।

চা শুধুমাত্র পানীয় নয়। প্রাচীন ভেষজ; পথ্য; ওষুধের অনুপান। প্রাচীন চীনে প্লেগ রোগ নিরাময়ের অব্যর্থ ঔষধ। বর্তমানে সর্দিকাশি, কফ তাড়ানো, মেদ কমানো, রক্তের কোলেস্টরয়েল কমানো, স্নায়ুর স্পন্দন, হৃদরোগের চিকিৎসায় চা নিয়ে গবেষণা চলছে। চায়ের ক্যাফিন কভিড তাড়াতে সক্ষম। করোনার অতিমারিতে নাগরিকের স্বাস্থ্য সুরক্ষায় আগামিতে দশ কোটি চল্লিশ লক্ষ কেজি চা উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা হাতে নিয়ে এগিয়ে চলছে চা শিল্প। আশা করি এগিয়ে চলবে চা শিল্প; এগিয়ে চলবে প্রিয় বাংলাদেশ।

আজ ৪ জুন ২০২২ সাল। চা শিল্পের জন্য একটি ঐতিহাসিক দিন। এইদিন হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি, মহান নেতা জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৫৪ সালে পাকিস্তান সরকারের প্রাদেশিক বাণিজ্য শ্রম ও শিল্প মন্ত্রণালয়ে মন্ত্রীর দায়িত্ব প্রাপ্ত হন। তৎকালীন কেন্দ্রীয় সরকারের স্মারক নং৩৩৫/৯১৩/৫৬ সিপি তারিখ ৪ জুন, ১৯৫৭ খ্রিঃ মূলে বঙ্গবন্ধুকে চা বোর্ডের চেয়ারম্যান পদে মনোনীত করা হয়। তিনি ৪ জুন, ১৯৫৭ খ্রিঃ থেকে ২৩ অক্টোবর, ১৯৫৮ খ্রিঃ পর্যন্ত চা বোর্ডের চেয়ারম্যান পদে দায়িত্ব পালন করেন।

বঙ্গবন্ধু ছিলেন চা শ্রমিকদের নিকট একজন প্রাণপ্রিয় ব্যক্তিত্ব। এদেশের চা শ্রমিকরা ছিল অবহেলিত, বঞ্চিত। তিনি লক্ষ করলেন, এদের কোনো ভোটাধিকার নেই। এটি তাঁর মনে খুবই কষ্ট দেয়। তিনি ১৯৭৩ সালে জাতীয় নির্বাচনে প্রথম ভোটাধিকার প্রদান করার মাধ্যমে চা শ্রমিকদের নাগরিকত্ব প্রদান করেন। চা শ্রমিকদের স্বাস্থ্য, শিক্ষা ও চিকিৎসার বিষয়ে তিনি ছিলেন নিবেদিত প্রাণ। প্রতিটি বাগানে বাধ্যতামূলকভাবে চিকিৎসাকেন্দ্রে স্থাপন, চিকিৎসক নিয়োগ, বিশুদ্ধ পানীয় জলের ব্যবস্থা, পয়ঃনিষ্কাশন এর সুবিধা, বাধ্যতামূলক প্রাথমিক শিক্ষা ইত্যাদি বিষয়ে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন। তাইতো চা শ্রমিকরা আজও তাঁকে স্মরণ করে শ্রদ্ধার সঙ্গে এবং হৃদয়ে স্থান করে নিয়েছে আপন করে। চা বোর্ডের চেয়ারম্যান থাকাকালীন অনেক চা বাগানের স্বত্বাধিকারী, প্লান্টার্স, ম্যানেজার, এমন কি চা শ্রমিকদের সঙ্গে তাঁর ব্যক্তিগত সুসম্পর্ক গড়ে উঠে। ফলে স্বাধীনতাযুদ্ধের সময় চা বাগানের স্বত্বাধিকারী, ম্যানেজার ও চা শ্রমিকগণ মুক্তিযুদ্ধে সক্রিয়ভাবে অংশ নেন। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ স্বাধীনতা যুদ্ধে ই.পি.আর এবং মুক্তিযোদ্ধারা কৌশলগত কারণে বিভিন্ন চা বাগানে আশ্রয় নেয়। চা বাগান শ্রমিকরা পাকিস্তান বিরোধী প্রতিরোধ গড়ে তোলে। নিজেদের পারিবারিক নিরাপত্তা ও আর্থিক অসচ্ছলতা সত্ত্বেও ই.পি.আর সদস্য এবং মুক্তিবাহিনীর আশ্রয় পানাহারের ব্যবস্থা করার মত দুঃসাহসিক কাজে ঝাঁপিয়ে পড়েন। এতে প্রতিশোধ সপৃহায় উন্মত্ত পাক সেনারা চা শ্রমিকদের উপর নির্যাতন নিপীড়ন ও বর্বরোচিত আচরণ করে। বোমা মেরে আগুন জ্বালিয়ে শ্রমিকদের আবাসিক কলোনি, কারখানা, বাংলো, অফিস ও বাগানের আবাদি এলাকা ধ্বংস করে দেয়। চা গাছের সবুজ কুঁড়ি আগুনে ঝলসে যায়। শ্রমিকদের অনেকে গুলিবিদ্ধ হয়ে প্রাণ হারায়। বাঙালি ম্যানেজার, কর্মকর্তা বন্দি হয়ে নির্যাতনের শিকার হন। চোখের সামনে আত্মীয় পরিজনদের অপহরণ লুটপাট ও বেয়নেটের আঘাতে আঘাতে রক্তপাতে মানুষের হাহাকারে ক্য্যামেলিয়ার সবুজ রাজ্য শ্মশানে পরিণত হয়। ১৬ ডিসেম্বর দেশ মুক্ত হয়। মরতে মরতে বেঁচে যাওয়া ক্ষত বিক্ষত মানুষেরা আবারো থমকে দাঁড়ায়। ঝলসে যাওয়া পুড়ে যাওয়া শতবর্ষজীবী ক্যামেলিয়ার বুকে আবারো নতুন কুঁড়ি গজায়।

জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ছিলেন আমাদের গর্ব, আমাদের অহংকার। এদেশের চা শিল্পের সার্বিক উন্নয়নের লক্ষ্যে ঞবধ অপঃ ১৯৫০ এর আওতায় ১৯৫১ সালে চা বোর্ড গঠিত হওয়ার পর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান চা বোর্ডের প্রথম বাঙালি চেয়ারম্যান হওয়ার পর দেশের চা শিল্পের উন্নয়নে আসে নতুন জোয়ার।

হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি, মহান নেতা জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান চা বোর্ডের চেয়ারম্যান পদে দায়িত্বে থাকাকালীন চা বোর্ডের কর্মকর্তা কর্মচারীদের জন্য কন্ট্রিবিটরি প্রভিডেন্ট ফান্ড চালু করেন। এছাড়াও চা বোর্ডের কর্মকর্তা কর্মচারীদের জন্য প্রতি বছর চাকরির জন্য একটি গ্র্যাচুয়েটির সুবিধা, আগ্রিম অর্থগ্রহণ এবং তা ফেরত দানের সুবিধা চালু করেন।

তিনি লক্ষ্য করেন যে, এদেশের চা বাগানগুলো অনেক অনেকটা অবহেলিত। মাটি পরীক্ষা, পোকামাকড় ও রোগ বালাই দমন, উপদেশমূলক পরামর্শ এবং গবেষণামূলক কাজ ভারতের টোকলাই টি রিসার্চ স্টেশনের সহায়তা নেয়া হতো। এরূপ পরাধীনতা বঙ্গবন্ধুর বিবেককে নাড়া দিল। তিনি এদেশের একটি চা গবেষণা কেন্দ্র স্থাপনের উদ্যোগ গ্রহণ করেন। ১৯৫৭ সালে টি রিসার্চ ইনস্টিটিউট (টিআরএস) প্রতিষ্ঠার জন্য বর্তমানে মৌলভীবাজার শ্রীমঙ্গল উপজেলায় ৮১.৯২ একর জমি অধিগ্রহণ করেন। তাঁরা অক্লান্ত পরিশ্রম ও প্রচেষ্টায় ১৯৫৭ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি মৌলভীবাজার জেলায় শ্রীমঙ্গল শহর থেকে ৩.২ কিলোমিটার পূর্বে পাহাড়বেষ্টিত এক মনোরম পরিবেশে প্রতিষ্ঠা করেন।

যুদ্ধে ক্ষতিগ্রস্ত চা বাগানগুলো পুনর্বাসনের জন্য তিনি সক্রিয় ভূমিকা পালন করেন। দেশের স্বাধীন হওয়ার পর ১৯৭৩ সালে চা গবেষণা কেন্দ্রের নাম পরিবর্তন করে বাংলাদেশ চা গবেষণা ইনস্টিটিউট (বিটিআরআই) নামকরণ করেন। বর্তমানে এ প্রতিষ্ঠানটি বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের অধীনে বাংলাদেশ চা বোর্ডের একটি অঙ্গপ্রতিষ্ঠান ও নার্সভুক্ত কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট সমূহের মধ্যে একটি গুরুত্বপূর্ণ গবেষণা ইনস্টিটিউট।

উন্নয়নের পথ নকশা : বঙ্গবন্ধুর অনুসৃত নীতিমালার আলোকে বাংলাদেশ চা শিল্প শিরোনামে একটি মহাপরিকল্পনা হাতে নিয়েছে; যা চা শিল্পকে ভবিষ্যতে দেশের একটি গুরুত্বপূর্ণ স্থানে পৌঁছাতে কার্যকরী ভূমিকা পালন করবে। বাংলাদেশের চা শিল্পের উন্নয়নের জন্য গৃহীত সরকারের এই কৌশলগত মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়নের লক্ষ্যে ২০২৫ সালের মধ্যে দেশের চা উৎপাদন ১৪০ মিলিয়ন কেজিতে উন্নীত করার পাশাপাশি চা চাষ সম্প্রসারণ, চা শ্রমিকদের জীবনমান উন্নয়ন এবং চা শিল্পকে একটি টেকসই ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠার কাজ ইতোমধ্যে শুরু হয়েছে। আশাকরি বঙ্গবন্ধু চা শিল্প নিয়ে যে স্বপ্ন দেখতেন তা সার্থক হবে এবং গড়ে উঠবে চা শিল্পে সমৃদ্ধ বাংলাদেশ।

লেখক : প্রাবন্ধিক, চা গবেষক

পূর্ববর্তী নিবন্ধগিওর্গি লুকাস : দার্শনিক ও সাহিত্য সমালোচক
পরবর্তী নিবন্ধহল্যান্ড থেকে