মিথ্যা তথ্য দিয়ে সাবেক সেনাপ্রধান আজিজ আহমেদের দুই ভাইয়ের জাতীয় পরিচয়পত্র নেওয়ার অভিযোগ তদন্তে কমিটি করার কথা জানিয়েছে প্রধান নির্বাচন কমিশনার কাজী হাবিবুল আউয়াল। গতকাল সোমবার নির্বাচন ভবনের মিডিয়া সেন্টারে নির্বাচন কমিশনের সংবাদ সংগ্রহে নিয়োজিত সাংবাদিকদের সংগঠন আরএফইডি টকে এক প্রশ্নের জবাবে তিনি এ কথা বলেন।
সিইসি বলেন, আজিজ সাহেবের ভাইবোন, হারিছ চৌধুরী (খালেদা জিয়া প্রধানমন্ত্রী থাকার সময় তার রাজনৈতিক সচিব), বঙ্গবন্ধুর খুনি মোসলেম উদ্দিনের পরিবার ভুল তথ্য দিয়ে এনআইডি করেছে জেনেছি। ২০–২৫ বছর পর হঠাৎ জানা গেল। এখন দুটো তদন্ত কমিটি করা হয়েছে।
এদিকে আজিজ আহমেদের দুই ভাইয়ের মিথ্যা তথ্যে ই–পাসপোর্ট ও এনআইডি জালিয়াতির অভিযোগের সত্যতা যাচাই করতে বলা হয়েছে জানিয়ে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) চেয়ারম্যান মোহাম্মদ মঈনউদ্দীন আবদুল্লাহ বলেছেন, এতে আজিজ আহমেদের দোষ নেই। তবে অভিযোগ দুটি খতিয়ে দেখতে নির্বাচন কমিশন ও পাসপোর্ট অধিদপ্তরে চিঠি দেওয়া হয়েছে বলে জানিয়েছেন তিনি। গতকাল রিপোর্টার্স অ্যাগেইনস্ট করাপশনের (র্যাক) সাংবাদিকদের সঙ্গে মতবিনিময়ে এক প্রশ্নের জবাবে তিনি এ কথা বলেন। খবর বিডিনিউজের।
গণমাধ্যমের তথ্য অনুযায়ী, আজিজ আহমেদের দুই ভাই হারিছ আহমেদ ও তোফায়েল আহমেদ (জোসেফ) নিজেদের নামের পাশাপাশি বাবা–মার নামও পরিবর্তন করেছেন। হারিছ আহমেদ তার নাম পাল্টে হয়েছেন মোহাম্মদ হাসান। আর তোফায়েল আহমেদ জোসেফ নাম পাল্টে পরিচিতি নিয়েছেন তানভীর আহমেদ তানজীল। তাদের এনআইডির তথ্য পরিবর্তনে আজিজ আহমেদ সুপারিশ করেছিলেন বলে অভিযোগ উঠেছে।
সিইসি বলেন, অপরাধ জানার পরও অপরাধ হচ্ছে। যিনি পাঁচটি (একাধিক) এনআইডি করছেন, তিনি অপরাধ করছেন। কোনো না কোনো ফঁাঁক ফোকরের সুযোগে অপরাধ করছে। কিন্তু তিনি (যিনি অপরাধ করেন) যে নির্মল ব্যক্তিত্ব, সেটা বলছি না, কোনো সাফাই করি না। তার বিরুদ্ধে তদন্ত কমিটি করা হয়েছে।
কোভিডের সময় রিপোর্ট জালিয়াতি ও সাম্প্রতিক সময়ে কারিগরি বোর্ডের সার্টিফিকেট জালিয়াতির প্রবণতার বিষয়টি তুলে ধরেন সিইসি। তিনি বলেন, এনআইডি একটা প্রযুক্তিগত দিক রয়েছে। এ প্রযুক্তির ফাঁক ফোকর থাকতে পারে।…একটা জিনিসের ৯৯.৯৯ শতাংশ লোক সুবিধা পেয়ে থাকে, ০.০১ শতাংশ লোক যদি এর অপব্যবহার করে; তাদের আইনের আওতায় আনতে হবে। এনআইডি জালিয়াতিতে অস্থায়ীভাবে নিয়োগ পাওয়া ডেটা এন্ট্রি অপারেটরদের দায় থাকতে পারেন বলে মনে করেন সিইসি। তিনি বলেন, স্থায়ী চাকরি করে তারা নয়, ডেটা এন্ট্রি অপারেটররা হয়ত প্রলুব্ধ হয়ে, লোভের বশবর্তী হয়ে কিছু কিছু কাজ করেছে। ব্যাপকভাবে হয়েছে তা কিন্তু নয়।
এ বিষয়ে যোগাযোগ করা হলে আজিজ আহমেদ কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি।
কী অভিযোগ : প্রথম আলোর প্রতিবেদন অনুযায়ী, মিথ্যা তথ্য দিয়ে মোহাম্মদ হাসান নামে ২০১৪ সালে জাতীয় পরিচয়পত্র (এনআইডি) নিয়েছিলেন হারিছ আহমেদ। ২০১৯ সালে তিনি এনআইডিতে নিজের ছবি পরিবর্তন করেন। আজিজ আহমেদের আরেক ভাই তোফায়েল আহমেদ ওরফে জোসেফ দুটি এনআইডি নিয়েছেন। এর একটি মিথ্যা তথ্য দিয়ে, তানভির আহমেদ তানজীল নামে। অন্যটি করেছেন তোফায়েল আহমেদ জোসেফ নামে। আইন অনুযায়ী, মিথ্যা তথ্য দিয়ে এনআইডি করা এবং একাধিক এনআইডি করা, দুটিই শাস্তিযোগ্য অপরাধ।
সাজা মওকুফ চেয়ে (জোসেফের জন্য) মায়ের করা আবেদনসহ সাজা মওকুফের সরকারি প্রজ্ঞাপনে হারিছ ও জোসেফের বাবার নাম আব্দুল ওয়াদুদ ও মায়ের নাম রেনুজা বেগম। কিন্তু হারিছ যে জাতীয় পরিচয়পত্র ও পাসপোর্ট নিয়েছেন, তাতে বাবার নাম সুলেমান সরকার এবং মায়ের নাম রাহেলা বেগম উল্লেখ করা হয়েছে।
২০১৪ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারি মোহাম্মদ হাসান নামে হারিছ আহমেদের জাতীয় পরিচয়পত্র ইস্যু করা হয়। ২০১৯ সালের ৫ আগস্ট তিনি এনআইডিতে নিজের ছবি পরিবর্তন করেন। ২০১৯ সালের ৫ আগস্ট ছবি পরিবর্তনের আবেদন করেন মোহাম্মদ হাসান (হারিছ)। ওইদিনই ছবি পরিবর্তনের পুরো প্রক্রিয়া সম্পন্ন করা হয়। তার আবেদনে রেফারেন্স হিসেবে লেখা আছে ‘জেনারেল আজিজ আহমেদ, সিএএস’। সিএএস হলো চিফ অব আর্মি স্টাফ।
নাম পাল্টে তৈরি করা জাতীয় পরিচয়পত্র ব্যবহার করে দুই ভাই পাসপোর্ট করেছেন। এই মুহূর্তে তারা দেশের বাইরে আছেন। তবে প্রথম আলোর প্রশ্নে আজিজ আহমেদ দাবি করেছেন, ওই অভিযোগ সত্য নয়।
যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞা : ২০১৮ সালের জুন থেকে ২০২১ সালের জুন পর্যন্ত তিন বছর বাংলাদেশের চিফ অব আর্মি স্টাফ ছিলেন জেনারেল আজিজ আহমেদ। তার আগে ২০১২ সাল থেকে চার বছর বাংলাদেশের সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিজিবির নেতৃত্ব দেন। সেনাপ্রধান হিসেবে মেয়াদের শেষ সময়ে আলজাজিরার এক প্রতিবেদনে আজিজ আহমেদের বিরুদ্ধে দুর্নীতিসহ নানা অভিযোগ তোলা হলে সরকার এবং সেনাসদর সে সময় প্রতিবাদ জানিয়েছিল। আজিজ আহমেদও অভিযোগ অস্বীকার করেছিলেন। অবসরে যাওয়ার প্রায় তিন বছর পর গত ২০ মে দুর্নীতিতে জড়িত থাকার অভিযোগে বাংলাদেশের সাবেক সেনাপ্রধান অবসরপ্রাপ্ত জেনারেল আজিজ আহমেদের ওপর নিষেধাজ্ঞা দেয় যুক্তরাষ্ট্র।
বঙ্গবন্ধুর খুনির পরিবারেরও একই কাজ : আজিজ আহমেদের ওপর যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞার পর তার ভাই ও ভাতৃবধূদের এনআইডি ও পাসপোর্ট জালিয়াতির বিষয়টি নিয়ে আলোচনা শুরু হয়। এর মধ্যে গত ৩০ মে প্রকাশ পায় জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হত্যার পলাতক আসামি রিসালদার মোসলেম উদ্দিনের চার ছেলেমেয়ে জাতীয় পরিচয়পত্রে (এনআইডি) তাদের বাবার নাম পাল্টেছেন। ভুয়া পরিচয়পত্র ব্যবহার করে তিন ছেলে–মেয়ে পাসপোর্ট এবং এক ছেলে ড্রাইভিং লাইসেন্স নিয়েছেন।
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগের অনুরোধে নির্বাচন কমিশনের (ইসি) এনআইডি শাখা এ তদন্তে নেমেছে।